Quantcast
Channel: রয়েসয়ে
Viewing all 119 articles
Browse latest View live

খুবরগুড়ে

$
0
0

এইভাবে হতে থাকে ক্রমাগত
কেউ মারে কেউ মার খায়
ভিতরে সবাই খুব স্বাভাবিক কথা বলে
জ্ঞানদান করে
এই দিকে ওই দিকে তিন চার পাঁচ দিকে
টেনে নেয় গোপন আখড়ায়
কিছু বা গলির কোণে কিছু অ্যাসফল্ট রাজপথে
সোনার ছেলেরা ছারখার
অল্প দু চারজন বাকি থাকে যারা
তেল দেয় নিজের চরকায়
মাঝে মাঝে খড়খড়ি তুলে দেখে নেয়
বিপ্লব এসেছে কতদূর
এইভাবে, ক্রমাগত
এইভাবে, এইভাবে
ক্রমাগত।
(ক্রমাগত, শঙ্খ ঘোষ)
বিল্লালের সঙ্গে বিপ্লবের কোনোদিন দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো না। বিল্লাল নম্র স্বভাবের নিরীহ আরামপ্রিয় মানুষ। তার প্রতিবেশী আর সহপাঠীদের মধ্যে যারা বিভিন্ন সময়ে বিল্লালের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ রেখেছে, তাদের অনেকেই শহুরে জীবনের নানা মোলায়েম ঘাত প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে যাওয়ার ফলে "টাফ"হয়েছে, যেভাবে কাঁচা লোহা হাপরে চুল্লিতে আগুনে পানিতে গরম আর ঠাণ্ডা হয়ে পেকে ইস্পাত হয়। বিল্লাল তেমনটা পারেনি। তার রমণীকুশল বন্ধুদের সঙ্গে অনিয়মিত আড্ডায় আর মাঝে মাঝে দৈনিক কচুবনে নারীপুরুষ সিরিজে নারী ও পুরুষ সম্পর্কে নানা তাত্ত্বিক আলোচনায় নারীর কথা মাথায় রেখে পুরুষের টাফ হওয়ার প্রয়োজনের কথা ঘুরে ফিরে বার বার উঠে এলেও বিল্লাল সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত জীবনটায় অনুভব করেছে, টাফের মতো টাফ সে নয়। হয়তো জীবনে সে কখনো টাফ হতেও পারবে না। আর বিপ্লবের সঙ্গে দেখা হতে গেলে মানুষকে একটু টাফ তো হতেই হবে, এটা তো সহজেই অনুমেয়। পেলব লোকজন কি বিপ্লব করে কখনো?
কিন্তু পেলব বিল্লালের সঙ্গেই বিপ্লবের দেখা হয়ে যায় প্রকৃতির খসড়াখাতার মার্জিনে লেখা অমোঘ নিয়মে। বিপ্লব অবশ্য তখন এক টং দোকানের সামনে পেতে রাখা প্লাস্টিকের টুলে বসে ঘোলা চীনামাটির কাপে চা খেতে খেতে হাপুস নয়নে কাঁদছিলো।
বিল্লাল বিপ্লবের পরিচয় প্রথমে ঠাহর করতে পারেনি। তার কাছে চে গেবারা বিপ্লবের সমার্থক, তাই বিপ্লবের চেহারা অনেকটা চে গেবারার মতো হওয়া বাঞ্ছনীয়, এমনটাই সে ধরে নিয়েছিলো। বিপ্লবের গায়ে চে গেবারার চেহারাখচিত একটি টিশার্ট, তার ওপরে একটা বহুলসংখ্যক পকেটোলা হাতাছাড়া জ্যাকেট আর নিম্নাঙ্গে জিন্স বা কর্ডুরয়ের প্যান্ট থাকবে, পায়ে থাকবে একজোড়া ঈষৎ কাদামাখা বুট, এমন একটা ধারণাও উপযুক্ত কারণ ছাড়াই তার মনে জায়গা করে নিয়েছিলো। ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দুলিয়ে মুখে জন হ্যানিবল স্মিথের মতো সিগার কামড়ে ধরে বিপ্লব হোহো করে হেসে উঠে তার পাঁচশো সিসি নরটন মোটর সাইকেলে চড়ে দূরান্তের উদ্দেশে যাত্রা করবে, আকাশে তখন মেঘ গুড়গুড় করে উঠবে, দর্শক থেকে নিরাপদ দূরত্বে বাজ পড়বে কোনো অভাগার ঘাড়ে, দশ-বারো সেকেণ্ড পর বাতাসে ভেসে আসবে তার মন্দ্রধ্বনি, আর দমকা বাতাসে রাস্তায় পড়ে থাকা বিড়ির প্যাকেট, সেলোফেনের টুকরো, দিয়াশলাইয়ের কাঠি পাক খাবে, আর রাস্তা ধরে ক্রমশ দিগন্তপটে ছোটো হয়ে মিলিয়ে যাবে মোটরসাইকেলের পেছনবাতি, এমন সব নাটুকে কল্পনা তছনছ করে বিপ্লব একটা ময়লা সুতির পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরে ফোঁস ফোঁস করে কাঁদতে কাঁদতে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলো।
দেখতে বিপ্লব মোটেও চে গেবারার মতো নয়। জুলফিতে পাক ধরেছে, মাথায় চুল পাতলা হয়ে এসেছে, আর সবচেয়ে আপত্তিকর হচ্ছে, তার বয়সটাও যুবকোচিত নয়। তাই যখন চায়ের কাপে চুমুকের ফাঁকে পাঞ্জাবির হাতায় নাক মুছে বিপ্লব বিল্লালকে জানালো, সে বিপ্লব, পরিচয়টুকু বিল্লালের বিশ্বাসের গালে যেন চড় কষিয়ে দিয়ে গেলো। বিপ্লব বুড়ো?
বিপ্লব শুধু বুড়োই নয়, রোগাও। তার অভুক্ত মুখটা তাই প্রথম দেখায় মনের উপরিতলে অভক্তিই জাগিয়ে তোলে। তবে সে অভক্তিকে পরে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ভেতর থেকে উঠে আসা অনুকম্পার ঢেউ। বিল্লাল তাই টংদারকে চায়ের সঙ্গে কয়েকটা সিঙারাও দিতে বলে। প্লাস্টিকের বয়াম থেকে হতাশাজনক রকমের ছোটো আকারের সিঙারা বার করে একটা প্লাস্টিকের থালার এক কোণে কুমড়োর সস ঢেলে টংদার যখন বিল্লালের দিকে বাড়িয়ে দেয়, বিপ্লব সাগ্রহে হাত বাড়িয়ে একটা সিঙারা তুলে নিয়ে কামড়ে খায়। বিল্লাল আরেকটা টুল টেনে নিজের আর বিপ্লবের মাঝামাঝি সুবিধাজনক দূরত্বে রেখে প্লেটটাকে সমীহভরে একটু ঠেলে দেয় সে টুলের ওপর। তারপর চায়ে চুমুক দিয়ে বলে, "কী হয়েছিলো বলুন তো?"
বিপ্লব প্রথম সিঙারাটাকে তুমুল গতিতে শেষ করে দ্বিতীয় সিঙারা তুলে নিয়ে অন্য হাতে চায়ের কাপটাকে ঠেলে দেয় টংদারের দিকে। বলে, "আরেক কাপ চা হোক, কী বলো?"
বিল্লাল মাথা ঝোঁকায়। হোক আরেক কাপ, ক্ষতি কী? তার কাছে কিছু টাকা আছে, হাতে সময়ও আছে। সবচেয়ে বড় কথা, সে বিপ্লবের দেখা পেয়েছে, প্রয়োজনমাফিক টাফ না হয়েও। তার রমণীমোহন বন্ধু শুকবর যতোই রাফ অ্যান্ড টাফ হোক না কেন, বিপ্লবকে চা-সিঙারা খাওয়ানোর সুযোগ তো সে পায়নি। দৈনিক কচুবনের নারীপুরুষ সিরিজের নারীদের ফিতায় বিল্লালের টাফনেসের আস্তিন কোনোদিনই ২৬ ইঞ্চি পর্যন্ত যাবে না, কিন্তু বিপ্লবের দেখা তো সে-ই পেলো শেষ পর্যন্ত?
টংদারের হাত থেকে নিয়ে বিপ্লব আবার কাপে চুমুক দিয়ে চুক চুক করে চা খায়। সিঙারাগুলো টপাটপ ফুরিয়ে আসে ছুটির দিনের মতো। বিল্লাল নিজের চায়ের কাপে রয়েসয়ে চুমুক দেয়।
"উমর আল বদরের কাছে গিয়েছিলাম,"খিদেটাকে একটু বাগে এনে বলে বিপ্লব। "ভাবলাম, এসেই যখন পড়েছি, দেশের সবচেয়ে পাকনা বিপ্লবীর কাছে যাই।"
বিল্লাল সন্তর্পণে টংদারের দিকে খালি প্লেটটা বাড়িয়ে ধরে ইশারা করে। প্লাস্টিকের বয়াম ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে উঠে আসে আরো কয়েকটি কৃশকায় সিঙারা। বিল্লাল একটা মুখে দেয়, বিপ্লব দেয় দুটো।
"উনি ঘুমোচ্ছিলেন।"সিঙারা চিবাতে চিবাতে অভিমানভরে বলে বিপ্লব।
"ভোর বেলা গিয়েছিলেন?"বিল্লাল শুধায়।
"না। দিনে দুপুরে। নিজের শোবার ঘরে শুয়ে সে দিব্যি ঘুমাচ্ছিলো। আমি পানির পাইপ বেয়ে তার ঘর বরাবর উঠে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখি, ফ্যান ঘুরছে সিলিঙে, ক্যালেন্ডারের পাতা উড়ছে তার বাতাসে, আর বিছানায় শুয়ে নাক ডাকাচ্ছেন উনি। আমি তাকে ফিসফিসিয়ে ডাকলাম, ও বদর সাহেব, উঠুন, আমি এসেছি। তার আর ঘুম ভাঙে না।"
বিল্লাল সিঙারা খায় আর বলে, "তারপর?"
বিপ্লবের চেহারাটা অভিমানে ভরে ওঠে। "ওঠে না তো আর ওঠেই না। কয়েক বার ডাকার পর গোঁ গোঁ করে স্বপ্নের ঘোরে কী যেন বকে বকে উল্টো পাশ ফিরে শুলো সে। শেষে আমি জানালার গ্রিলের ভেতর হাত গলিয়ে পানির গ্লাসটা তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মেরে বললাম, উমর আল বদর, আমি ডাকিতেছি তুমি ঘুমাইছো নাকি?"
বিল্লাল বিপ্লবের অভিমানের বাড়ির ঠিকানা খুঁজে পেয়ে যায়। বলে, "সে কী?"
বিপ্লব আরেকটা সিঙারার আলুতে গুঁজে অভিমানটুকু পিষে মারতে চায়। বলে, "লোকটা ধড়ফড়িয়ে উঠেই আমাকে গালাগালি করতে লাগলো। আমি যতোই বলি, আমি বিপ্লব, চিনতে পারো হে ... সে ততোই ক্ষেপে ওঠে। দুপুর বেলা তার ভাতঘুমটা ভাঙালাম কেন, কোন অধিকারে পানি ছুঁড়ে মারলাম, নিউমোনিয়া হলে কে বাঁচাবে আর কে পথ্যবদ্যির বিল দেবে, এইসব বুর্জোয়া কথাবার্তা শুরু করে দিলো। আমি তাকে যতোই পরিচয় দিয়ে বলি, আমি বিপ্লব, এসে পড়েছি, ওঠো তুমি, প্যান্টটা পরে নাও, এখন অনেক কাজ অনেক দৌড়ঝাঁপ, অনেক অনেক পাহাড় ঠেলা বাকি, সে ততোই বলে, আমিই সব নষ্টের গোড়া, নইলে ১৯৭৩ সালেই সে কী যেন একটা করে ফেলতো। আমার কারণেই নাকি জাবদুল হক আর মোহাব্বত তোহাকে সে বাগে আনতে পারেনি। আর আমিই নাকি ভুলিয়ে ভালিয়ে নিলাজ শিকদারকে লেলিয়ে দিয়েছিলাম তার পেছনে। নইলে সে নাকি সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া বামকে এক জায়গায় জড়ো করে এনে ...।"বিপ্লবের গলা বুঁজে আসে।
"জড়ো করে এনে?"বিল্লাল জাবদুল হক আর মোহাব্বত তোহার নাম শোনেনি, নিলাজ শিকদারের নামটা মাঝে মাঝে বাতাসে ভাসতে শুনেছে সে।
বিপ্লব চায়ের কাপে নীরবে চুমুক দিয়ে বলে, "জড়ো করে এনে ... বিপ্লব করতো।"
বিল্লাল মাথা চুলকায়। "তাহলে কী রকম হলো ব্যাপারটা? বিপ্লবের কারণে উমর আল বদর সাহেব আর বিপ্লব করতে পারেননি?"
বিপ্লবও মাথা চুলকায়। "অনেকটা সেরকমই। আমি এদিকে পানির পাইপ ধরে কোনোমতে তার জানালা বরাবর আটকে আছি, আর সে বসে বসে আমাকে গালমন্দ করছিলো। আমি যতোই তাকে বলি, কিছু দোষ তারও ছিলো, নইলে কেন সে ফণী সিংহ আর ধ্যান চক্রবর্তীকে বাগ মানাতে পারেনি ... ততোই সে আরও ক্ষেপে উঠছিলো। শেষটায় আমাকে মুখের ওপর শেখ মুজিবের চামচা ডেকে এক রকম গলাধাক্কা দিয়ে জানালা থেকে হটিয়ে, জানালা বন্ধ করে, পর্দা টেনে আবার সে ঘুমোতে চলে গেলো।"বিপ্লবের মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে ওঠে শেষে।
বিল্লাল কী বলবে বুঝতে না পেরে চায়ের কাপে চুমুক দেয়।
বিপ্লব টংদারের প্লাস্টিকের জগ থেকে ঢেলে প্লাস্টিকের গ্লাসে করে ঢক ঢক করে পানি খায়, তার কণ্ঠার হাড় ওঠে নামে, কিছু পানি গড়িয়ে পড়ে চিবুক বেয়ে। বিল্লাল চেয়ে দেখে, সিঙারার প্লেট ফাঁকা।
বিপ্লব পাঞ্জাবির হাতায় মুখ মুছে বলে, "আর কেউ আছে?"
বিল্লাল বলে, "আর কেউ মানে?"
বিপ্লব মিটমিট করে তাকায় তার দিকে। তার বসে যাওয়া, কালিপড়া চোখে টিমটিম করে জ্বলে আশার আলো। এদিক সেদিকে একবার চোখ বুলিয়ে গলা নামিয়ে সে বলে, "বিপ্লবী কেউ আছে আর?"
বিল্লাল চায়ের কাপ আর সিঙারার প্লেট টংদারকে ফিরিয়ে দিয়ে বলে, "বিপ্লবী? মানে ... বাম?"
বিপ্লব মাথা ঝাঁকায়। "আছে আর?"
টংদার বিরস গলায় বলে, "বেয়াল্লিশ টেকা।"
বিল্লাল মানিব্যাগ বার করে টাকা মিটিয়ে দিয়ে বিপ্লবকে বলে, "চলেন আমার সাথে।"
রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা, অল্প কয়েকটা বাস চলছে, তাতে দুরুদুরু বুকে বসে অনন্যোপায় খেটে খাওয়া মানুষ। বাতাসে জমে থাকা শঙ্কা চিরে নিরাপদে জীবিত ও অদগ্ধ অবস্থায় প্রেস ক্লাবের সামনে নেমে পড়ে বিল্লাল আর বিপ্লব। বিপ্লব অবশ্য সারাটা রাস্তা আনমনে জানালার পাশে বসে ঢুলছিলো, বিম্পিজামাতের পাণ্ডারা মলোটভ ককটেল মেরে বাসে চড়ার অপরাধে তাকে পুড়িয়ে খুন করবে, এই দুর্ভাবনা তাকে খুব একটা স্পর্শ করেছে বলে বিল্লালের কাছে মনে হয়নি। বিল্লাল মনে মনে বিপ্লবের প্রশংসা করে। হাজার হোক, বিপ্লব বলে কথা।
প্রেস ক্লাবের সামনে চোখ ডলতে ডলতে বিপ্লব ডানে বামে তাকিয়ে বিপ্লবী খোঁজে। মনমতো কাউকে দেখতে না পেয়ে সে বিল্লালকে বলে, "কই?"
বিল্লাল বিপ্লবকে আঙুল তুলে সামনের দিকে দেখায়। বিপ্লব গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাগত মানুষের ছোটো জটলার দিকে।
প্রথম জটলাটি কুড়ি-পঁচিশজনের। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবির নিচে ম্যাজেন্টা রঙের স্যাণ্ডো গেঞ্জি পরা এক বয়স্ক ভদ্রলোক এক হাত পেছনে ভাঁজ করে আরেক হাত উঁচিয়ে বলছিলেন, "এই সাম্রাজ্যবাদী সরকারের হাতে এ দেশ নিরাপদ নয়। এরা বেলা শেষে সাম্রাজ্যবাদের সহচর। কিন্তু বিরোধী দলও ভারি দুষ্টু। তারাও সাম্রাজ্যবাদেরই সহচর। সাম্রাজ্যবাদের দালালির টেণ্ডার নিয়ে দুই সহচরে লেগেছে সংঘাত, মাঝখান দিয়ে জনতার অবস্থা হালুয়া টাইট। আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, সংঘাত নয়, সমঝোতা চাই।"
একটা মৃদু হাততালির রোল ওঠে সমাবেশের সামনে সমাগত মানুষদের মাঝে। তাদের পরনে ধবধবে সাদা কিন্তু অস্বচ্ছ পাঞ্জাবি। তবে তাদের পাঞ্জাবির গলায় বগলে ঘামের পিঙল দাগ।
বিপ্লব সেই ভিড়ের পেছন থেকে হঠাৎ হেঁকে বলে, "আনজিরুল মহসিন খান সাহেব, ফণী সিংহের শিষ্য হয়ে আজ তুমি এ কথা বলছো? হ্যাঁ? সংঘাত নয়, সমঝোতা চাই? সাম্রাজ্যবাদের দালালদের মাঝে সমঝোতা হলে প্রোলেতারিয়েতের লাভটা কী?"
ভাষণরত বিপ্লবী ভদ্রলোক উসখুস করে ওঠেন। তিনি আবার ভাষণ চালু করেন, "এ দেশের মালিকানা খেটে খাওয়া সাধারণ জনগণের, সংবিধানে তেমনটিই বলা আছে। কিন্তু সেই জনগণ যখন তাদের দেখভালের জন্য সাম্রাজ্যবাদের দালালদের ক্ষমতায় পাঠায়, তখন সংবিধান হয়ে পড়ে এক টুকরো তুচ্ছ দস্তাবেজ ...।"
বিপ্লব তার পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে হাত উঁচু করে গর্জে ওঠে, "আনজিরুল মহসিন খান, রাখো তোমার সংবিধান! সাম্রাজ্যবাদের দালালদের মধ্যে সমঝোতা করে কী হবে আগে বলো! লেনিন কি সমঝোতা করেছিলেন? মাও কি সমঝোতা করেছিলেন? ফিদেল কাস্ত্রো কি সমঝোতা করেছিলেন? হো চি মিন কি সমঝোতা করেছিলেন?"
আনজিরুল মহসিন খান মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলেন, "ইয়ে ... কী যেন বলছিলাম, এখন দেশে যা চলছে, তা হচ্ছে চর দখলের সংস্কৃতি ...।"
বিপ্লব তবুও বাঘের মতো গর্জায়, "বলো, কবে কোন বিপ্লবী সমঝোতা করেছিলেন?"
আনজিরুল মহসিন খান এবার চটে গিয়ে বলেন, "আরে কী জ্বালা, শান্তিতে দুইটা বক্তব্য দিতে পারবো না নাকি? কে রে ভাই, হট্টগোল করো?"
বিপ্লব তবুও বার বার নেহারির ঝোলের মতো টলটলে ভিড়ের ভেতর থেকে তড়পায়, সমঝোতা করা বিপ্লবীর নাম জানতে চায়, সাম্রাজ্যবাদের দালালদের মাঝে বিম্পি নেতা নিজামরুল ইসলাম খান কেন আনজিরুল মহসিন খানের ভায়রা, সে কথা জানতে চায়।
আনজিরুল মহসিন ফুঁপিয়ে ওঠে, "আরে বাল আমি কি দুনিয়ার সব বিপ্লবীকে চিনি? এই ডালিম, তোমার হাতে পার্টি দিলাম, কী লোকজন ঢুকাইছো পার্টিতে? এইসব কী কোচ্চেন করে?"
জিহাদুল আসলাম ডালিম চেয়ারে বসে বসে ঢুলছিলেন, আনজিরুল মহসিনের খোঁচা খেয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে তিনি বলেন, "সব সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত। এ সংঘাত সাম্রাজ্যবাদের খেয়ে যাওয়া রোস্টের ফেলে যাওয়া হাড্ডির টুকরার দখল-বখরা নিয়ে সংঘাত। জনগণ এ সংঘাত চায়নি, চায় না। সংঘাত নয়, সমঝোতা চাই ...।"
আনজিরুল মহসিন খান আবার খোঁচান, "আরে এই লোক এগুলি কী জিগায়?"
জিহাদুল আসলাম ডালিম হাত নাড়ে, "এই লোক, চলে যাও। চলে যাও এখান থেকে। সাম্রাজ্যবাদের দালালি ছেড়ে দাও। সংঘাত কোরো না। সমঝোতা চাইলে এসে বসো, বক্তৃতা শোনো। ডাস কাপিটাল পড়েছো?"
বিপ্লব শূন্যে মুষ্ঠি হেনে বেরিয়ে আসে সে ভিড় থেকে, পিছু পিছু বিল্লাল।
বিপ্লব বিড়বিড় করে জোর পা চালিয়ে সামনে এগোতে থাকে। "ফণী সিংহের শিষ্য এরা? এদের হাতে পার্টি? কীভাবে আসবো এ দেশে? কারা আনবে আমাকে? এরা তো আমাকে খেদিয়ে দিচ্ছে।"
বিল্লাল চুপচাপ পিছু পিছু হাঁটে। সে দেখতে পায়, সেই দুবলা রোগাটে ভাবটা বিপ্লবের শরীর থেকে চলে গেছে। পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরা চিতাবাঘের মতো বিপ্লব গটগট করে যেন হেঁটে চলে ইতস্তত ভেড়ার পালের মাঝে।
কয়েক কদম এগোতেই চোখে পড়ে আরেক জটলা। সেখানে আঙুল উঁচিয়ে এক প্রৌঢ় বিপ্লবী গর্জন করে চলছেন।
"সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াদের মোকাবেলা করার আগে নিজেদের প্রস্তুত হতে হবে। আমরা যদি খামোকা অহেতুক হুদা বিতর্কে ব্যস্ত থাকি, আমাদের সংগ্রাম ঢিলা হয়ে যাবে। এ নিয়ে আমি ভ্যানগার্ডের গত সংখ্যায় লিখেছি। কমরেড মনিবুল হালদার ও অসিতাংশু চক্রবর্তী অহেতুক দলকে কমজোর করেছেন। অহৈতুকী বিতর্কে আমাদের দুর্বল করেছেন। পিছিয়ে দিয়েছেন। আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, আমরাই প্রকৃত বাঁশদ। তারা দলত্যাগী মোনাফেক মাত্র।"
সমাগত কয়েক ডজন তরুণ তরুণী প্রবল হাততালি দিয়ে চেয়ারে ঢুলতে থাকা এক প্রৌঢ়ের ঘুমের চটকা ভেঙে দেয়।
আলেক মওলা দৃপ্ত কণ্ঠে বলেন, "গণচাঁদার টাকায় সম্পত্তি কেনা নিয়ে এতো তর্কের কী আছে? পার্টির সম্পত্তি তো ভূতের নামে থাকতে পারে না। মানুষের মতো মানুষের নামেই তা থাকতে হবে। আর পার্টিতে আমার চেয়ে উপযুক্ত মানুষ কেউ আছে? থাকলে তার নাম শুনতে চাই।"
বিপ্লব পেছন থেকে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে গর্জন করে ওঠে, "বিপ্লবী রাজনীতির প্রাণ, উন্নত চারিত্রিক মান!"
আলেক মওলা চটে ওঠেন, "আরে রাখো তোমার উন্নত চারিত্রিক মান। একটু আধটু যৌথ জীবন যাপন করতে না দিলে বিপ্লবীরা থাকবে? সব কয়টাই তো দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের পর পটাপট বিয়েশাদি চাকরিবাকরি বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে পগারপার হয়ে যায়। দিনকে দিন বিপ্লবী কমে যাচ্ছে। তার ওপর চরিত্র নিয়ে এতো রশি টানাটানি হলে তো দলই থাকবে না। আবার বিপ্লব!"
বিপ্লব এবার লুঙ্গি মালকোঁচা দিয়ে হুঙ্কার দেয়, "কমরেড আলেক মওলা, তুমি কীভাবে বিপ্লব করবে? তোমার হাতে পড়ে বাঁশদ শুধু ভাঙছে আর ভাঙছে। ছাত্রফ্রন্টিয়ারের বিপ্লবীরা আট বছর আগে কে এক নারী কমরেডের বিয়ের আসরে তোমার মুখে চুনকালি দিয়ে বেরিয়ে গেলো, তুমি ভুলে গেছো? দুই বছর আগে জাবদুল্লাহ সরকার তোমার কান মলে দিয়ে চলে গেলেন। আবার তুমি গিয়ে ভিড়েছো ডালিম-আনজিরদের সাথে, মোর্চা থেকেও তোমার দলকে বাকি বিপ্লবীরা খেদিয়ে দিয়েছে। এরপর তুমি কাদের নিয়ে বিপ্লব করবে?"
আলেক মওলা ক্ষেপে গিয়ে বলেন, "মনিবুল হালদারের হয়ে দালালি করতে এসেছো আমার মিটিঙে, তাই না? সাম্রাজ্যবাদের দালালদের চেয়ে বড় শত্রু এই মনিবুল হালদারের দালালরা। এই কে আছো কমরেড, ধরো তো এটাকে! কোনো সমঝোতা নাই, সংঘাত করতে এসেছে, দেখিয়ে দাও সংঘাত কী জিনিস!"
বিপ্লব খপ করে বিল্লালের হাত চেপে ধরে ছুট লাগায়, বলে, "পালাও!"
বিল্লাল হতচকিত হয়ে দৌড়ায়, পেছন পেছন তাড়া করে আসে কয়েকটি উত্তেজিত তরুণী কমরেড।
বিপ্লব শ'খানেক গজ ছুটে থামে, থেমে ঘাম মোছে। পেলব বিল্লালের এতো দৌড়ঝাঁপের অভ্যাস নেই, সে ধপ করে ফুটপাথে বসে পড়ে হাঁপরের মতো হাঁপাতে থাকে। সব কিছুই তার কাছে উল্টো মনে হয়। বিপ্লব কেন পালিয়ে যাবে?
বিপ্লব যেন বুঝে ফেলে তার মনের কথা। বলে, "পালানো মানেই প্রস্থান নয়। পশ্চাদপসরণ বিপ্লবীর জীবনের নিত্য কৌশল। উমর আল বদরের বাড়ি থেকে তো পশ্চাদপসরণই করলাম, তাই না? সব সময় সবকিছুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকলে বিপ্লব হবে না।"
বিল্লাল হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, "সংঘাত নয়, সমঝোতা চাই?"
বিপ্লব মাথা চুলকায়। "না ... তা তো বলিনি।"
বিল্লাল বলে, "তাহলে?"
বিপ্লব একটু ক্ষেপে ওঠে। বলে, "সমঝোতা তো পশ্চাদপসরণ নয়। সমঝোতা মানে নেকড়ের পালের সঙ্গে ভিড়ে গিয়ে পাতিনেকড়ে হওয়া। সংঘাত মানে নেকড়ের সঙ্গে লড়াই করা। আর পশ্চাদপসরণ হচ্ছে লড়াইটা আজ না করে কালপরশুর জন্যে রেখে দিয়ে প্রস্তুত হওয়া।"
বিল্লাল বড় শ্বাস নিয়ে বলে, "সমঝোতা করে প্রস্তুত হওয়া যায় না?'
বিপ্লব মাথা নাড়ে। "না। সমঝোতা মানে লোহা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া। আর লোহা না তাতালে আমার আর আসা হবে না।"
বিল্লাল বলে, "তাহলে সামনে আগাই, কী বলেন?"
বিপ্লব পা চালায়।
কিছু দূরে আরেকটা জটলা শেষ বিকেলের রোদ পোহাচ্ছে। কাছে গিয়ে বিল্লাল বক্তাকে চিনে ফেলে। এনাকে সে টকশোতে নিয়মিত দেখে।
সাদামাটা পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে ফেননিভ খান মেনন, যাকে সবাই একটু মশকরা করে ফেনোমেনন বলে আড়ালে বা প্রকাশ্যে ডাকে, চোখ বুঁজে বলে যাচ্ছিলেন, "স্বাধীনতার শত্রুদের সঙ্গে কোনো বোঝাপড়া আমরা হতে দেবো না। যদিও আমরা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের সঙ্গে জোট করেছি, কিন্তু নিজেদের পরিচয়, স্বাতন্ত্র, লক্ষ্যকে আমরা বিকিয়ে দিইনি। আমরা খেটে খাওয়াদের দল। আর খেটে খাওয়াদের শত্রুরাই স্বাধীনতা শত্রু। তারা এখন ফাঁসির দড়ি গলায় নিয়ে আমাদের গায়ে আগুন দিচ্ছে, বোমা মারছে, রাতে ঘরে ঢুকে কুপিয়ে মারছে। কীভাবে তাদের এতো স্পর্ধা হলো? এই সাম্রাজ্যাবাদীদেরই প্রত্যক্ষ ও্ পরোক্ষ প্ররোচনায়। এরাই এই কালসাপকে বুকে জড়িয়ে পেলে পুষে বড় করেছে ...।"
বিপ্লব অস্থির হয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা পোস্টার বার করে আনে, বিল্লাল তাতে উঁকি দিয়ে চমকে ওঠে। মইত্যা রাজাকারকে বুকে জড়িয়ে ধরে তৃপ্তির হাসি হাসছেন ফেনোমেনন। পোস্টারের নিচে লেখা, মাত্র ১৯ বছর পর।
ফেনোমেনন কী যেন বকে যাচ্ছিলেন, বিপ্লব গর্জে ওঠে, "এতো খেটে খাওয়া মানুষ থাকতে তোমাকে সাম্রাজ্যবাদের দালালের সঙ্গে জোট করতে হয় কেন? কেন তুমি খেটে খাওয়া মানুষদের নিয়ে বিপ্লব করো না? আর এই পোস্টারে এটা কাকে জাবড়ে ধরে বিটকেল হাসছো তুমি, হ্যাঁ?"
ফেনোমেনন চুপ করে চশমার ফাঁক দিয়ে ভাবুক চোখে বিপ্লবকে দেখেন।
বিপ্লব আবারো তড়পায়, বলে, "আমি সারা দেশ ঘুরে দেখেছি। সেখানে মানুষ খাটতে খাটতে মুখে রক্ত তুলে ফেলছে। কিন্তু তুমি খেটে খাওয়ার দলের নাম ভাঙিয়ে গিয়ে জোট পাকাচ্ছো সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গেই। লেনিন কি জারের সঙ্গে জোটে ঢুকেছিলেন? মাও? কাস্ত্রো?"
ফেনোমেনন অলস হাত নেড়ে বলেন, "য়্যায় কে আছো একটু দেখো তো।"
কয়েকজন খেটে খাওয়া রাগী চেহারার যুবক এগিয়ে আসে ভিড় ঠেলে। বিপ্লব চিৎকার করে বলে, "পালাও পালাও!"
এবার বিল্লালকে আগের চেয়ে আরো শ'খানেক গজ বেশি ছুটতে হয়, বিপ্লবও একটু হাঁপিয়ে ওঠে এবার। বিল্লাল ফুটপাথের রেলিং ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, "আরেকটু হলেই সংঘাত হয়ে যেতো, বাপ রে!"
বিপ্লব বলে, "একটু পানি পাওয়া যাবে কোথাও?"
বিল্লাল বলে, "নাহ, এদিকটায় তো কিছু নেই, সচিবালয়ের ওদিকে গেলে হয়তো দোকানপাট খোলা পাওয়া যেতে পারে ...।"
বিপ্লব জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট চাটে, আর বলে, "আর কেউ নেই?"
বিল্লাল কিছু বলতে যাবে, এমন সময় কাছেই একটা মাইক ঘড়ঘড় করে ওঠে, "হ্যালো, হ্যালো, সোনায়েদ জাকি কলিং অল ইনসাফ ড্যুডস, সোনায়েদ জাকি ডাকছে সব ইনসাফিকে, ডু ইউ কপি ড্যুডস?"
একটা হুল্লোড় ওঠে কাছেই, "কপি, কপি।"
বিপ্লবের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সে বিল্লালকে টেনে রেলিং থেকে ছাড়িয়ে সামনে এগোয়। "আছে, আরো আছে!"
বিল্লাল বিপ্লবকে বুঝিয়ে বলতে চায়, কিন্তু বিপ্লব তাকে টানতে টানতে এগিয়ে যায় সামনের জটলার দিকে।
এ জটলা আগের তিন জটলার চেয়ে ঘন, জটলার তরুণরাও অন্যদের চেয়ে বেশি ধোপদুরস্ত। মাইকের সামনে দাঁড়ানো বক্তা সুবেশী, তার চুলগুলো দামি সেলুনে ছাঁটা, পরনে আড়ঙের পাঞ্জাবি আর চাদর। সে বলে, "এতোক্ষণ তোমরা শুনলে আমাদের প্রিয় ইনসাফ সংগ্রামী ফারুক গুয়েবাড়ার মর্মস্পর্শী বক্তৃতা। এখন তোমাদের উদ্দেশে সুন্দরবন নিয়ে কিছু বলবে তোমাদের প্রিয় ইনসাফ সংগ্রামী কলু মুস্তফি। ভাইসব, কলু মুস্তফি।"
কলু মুস্তফি নামের তরুণ গটগট করে এগিয়ে আসে মাইকের সামনে। প্রত্যয়ী কণ্ঠে সে বজ্রমুষ্ঠি উঁচিয়ে ধরে বলে, "আমাদের দেশের তেল গ্যাস কয়লার মালিক আমাদের জনসাধারণ। সাম্রাজ্যবাদী টাউট বাটপারের হাতে এসবের মালিকানা আমরা ছেড়ে দেবো না। শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও আমরা সুন্দরবনের হরিণশিশুকে রক্ষা করবো। সে যাতে তার মায়ের সঙ্গে ভোরবেলা নিশ্চিন্ত মনে চরে বেড়াতে পারে পশুর নদীর পারে। সে যেন বনের ঘাসপাতা চিবিয়ে আর নদীর পানি পিয়ে বড়টি হতে পারে। তারপর একদিন যেন নাদুস শরীরে ভরা যৌবনে সে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের একটি বাংলাদেশী বাঘের হাতেই ঘাড় মটকে মারা পড়ে। এটিই সুন্দরবনের হরিণের সমুচিত নিয়তি। কিন্তু কী হচ্ছে এসব ভাইসব? সাম্রাজ্যবাদের দালাল নব্য রাজাকার আম্লীগ তার শয্যাসঙ্গী ভারতকে নিয়ে সুন্দরবনের মাঝে এ কী গড়ে তুলছে? হরিণশিশুর চোখ দিয়ে দেখুন ভাইসব। দূরে ওটা কীসের ধোঁয়া? নদীতে এটা কীসের কালি? বনের সুস্বাদু টসটসে গাছের পাতায় জমা হওয়া গুঁড়াগুঁড়া ভুসিভুসি এগুলো কী রে? বনের পাশ দিয়ে নদীতে এ কী ভোঁভোঁ শব্দ আর আলো? এ কী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্বন ডায়োক্সাইড? নদীতে এটা কি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য? এ কি গাছের পাতায় জমা কয়লার কাজলরেখা? এ কী কয়লাবাহী জাহাজের ভেঁপু আর বাতি? আমি বেচারা হরিণশিশু রাতে ঘুমাবো কীভাবে? খাবো কী? শরীরে গোস্তো জমবে কী করে? আর শরীরে গোস্তো না জমলে সুন্দরবনের বাওয়ালি মৌয়ালি খাবে কী? আর বাওয়ালি মৌয়ালিরা খেতে না পেলে তাদের শরীরে গোস্তো জমবে কী করে? আর তাদের শরীরে গোস্তো না জমলে সুন্দরবনের বাঘ খাবে কী? আম্লীগ, তুই সুন্দরবনের বাঘ হরিণ সব মারলি।"
কলু মুস্তফি কান্নায় ভেঙে পড়ে।
বয়স্ক এক সৌম্যকান্তি ভদ্রলোক দু'পায়ে প্লাস্টার বেঁধে একটি চেয়ারে বসে ছিলেন, তিনি হাততালি দিয়ে বলেন, "কলু মুস্তফি গোটা ব্যাপারটি সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে বলেছে। সাবাশ ইনসাফি সংগ্রামী, সাবাশ।"
কলু মুস্তফি চোখ মুছে ধরা গলায় বলে, "অধ্যাপক ঝানু মোহাব্বতকে ধন্যবাদ। ঝানু স্যার কিছুদিন আগেই সাম্রাজ্যবাদী ভারতে কীভাবে লোকে কয়লাখনির বিষে আক্রান্ত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে, তা সরজমিন পরখ করে দেখতে গিয়েছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী ভারত স্যারকে পুলিশ দিয়ে কয়লাখনি থেকে বন্দী করে, তারপর নির্মমভাবে প্রহার করে, অত্যাচার নির্যাতন করে, তাঁকে ডিম দেয়। দেখুন স্যারের পায়ে প্লাস্টার দেখুন।"
ঝানু মোহাব্বত প্লাস্টার করা পা দুটি টর্চ লাইট জ্বেলে সকলকে দেখান। ফারুক গুয়েবাড়ার পাশে ভিডিও ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা এক গম্ভীরবদনা মহিলা সে দৃশ্য ভিডিও করেন।
বিপ্লব গর্জে ওঠে, "ডিম দিলে পায়ে কেন প্লাস্টার করতে হবে?"
কলু মুস্তফি পাল্টা গর্জন করে, "আরে ডিম দিয়েছে অন্য জায়গায়। সঙ্গে পাও ভেঙে দিয়েছে। ডিমের জায়গার প্লাস্টার কি সবাইকে দেখানো যাবে?"
অন্যান্য ইনসাফ সংগ্রামীরাও হুঙ্কার দেয়, "দেখানো যাবে?"
ঝানু মোহাব্বত ভুরু কুঁচকে বিপ্লবকে দেখেন আপাদমস্তক।
বিপ্লব পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে বলে, "ফেব্রুয়ারি মাস থেকে জামাতশিবিরবিম্পির লোকজন সারা দেশে হাজার হাজার গাছ কেটেছে। সেটা নিয়ে ঝানু মোহাব্বত সরজমিন পরখ করতে যায় না কেন?"
ঝানু মোহাব্বত টর্চ নিবিয়ে দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসে অন্য দিকে তাকান।
কলু মুস্তফি পাত্তা দেয় না বিপ্লবের কথায়, সে আবার তর্জনী উঁচিয়ে গর্জন করে, "সাম্রাজ্যবাদী ভারতের অত্যাচারের ভয়েই অধ্যাপক ঝানু মোহাব্বত দীর্ঘ তিনটি মাস ধরে সুন্দরবন নিয়ে আর কিচ্ছু বলছেন না। আমরা যারা তাঁর ভাবশিষ্য, আমরাও আপাতত চুপ আছি। কারণ যারা একজন প্রবীণ গবেষককে ডিম দেয়, তারা একজন নবীন গবেষককেও ছাড়বে না। আর দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর ভুখা নাঙা আমজনতার মালিকানা বুঝে নেওয়ার জন্য, রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ইনসাফের জন্য কাউকে না কাউকে তো গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে। তাই ভাইসব ...।"
বিপ্লব আবারও গর্জায়, "ভুখানাঙা আমজনতার মালিকানাধীন সামাজিক বনায়নের কয়েকশো কোটি টাকা দামের হাজার হাজার গাছই তো জামাতশিবিরবিম্পির লোকজন কেটে নিয়ে সড়ক অবরোধ করেছে। এটা নিয়ে তোমরা কিছু বলো না কেন?"
ইনসাফ ড্যুডরা চুপ করে যায়। সোনায়েদ জাকি উদাস মুখে ঘড়ি দেখে, ফারুক গুয়েবাড়া মোবাইলে কাকে যেন কল দেয়, আর ঝানু মোহাব্বত ইতস্তত কাশেন।
কলু মুস্তফি কিছুক্ষণ ভাবগম্ভীর মুখে চেয়ে থেকে বলে, "হাজার হাজার গাছ?'
বিপ্লব গর্জে উঠে বলে, "হ্যাঁ!"
কলু মুস্তফি শরীরের ভর এক পা থেকে অন্য পায়ে নিয়ে বলে, "কয়েকশো কোটি টাকা দাম?"
বিপ্লব বলে, "হ্যাঁ!"
কলু মুস্তফি পকেট থেকে একটা ক্যালকুলেটর বার করে কী যেন পার্সেন্টেজ হিসাব করে আড়চোখে সোনায়েদ জাকি আর ফারুক গুয়েবাড়ার দিকে তাকায়। তারাও পাল্টা কড়া চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। ঝানু মোহাব্বত হাত তুলে গৌতম বুদ্ধের বরাভয় মুদ্রা দেখান তাকে।
কলু মুস্তফি ক্যালকুলেটরটিকে পকেটস্থ করে বলে, "হুমমম, আচ্ছা ... বেশ বেশ। এখানে আমাদের বুঝতে হবে, সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় কে। গাছ যে কাটে, সেও প্রোলেতারিয়েত। এখানে জামাতশিবিরবিম্পিকেও ভুখানাঙা আমজনতা ধরতে হবে। তারা নিজেরা নিজেদের গাছ কাটছে। বরং রাষ্ট্রের গলা টিপে ধরা বুর্জোয়া আম্লীগ ঐ গাছগুলিকে যাতে সাম্রাজ্যবাদী ভারতের কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রে পাচার করতে না পারে, তাই তারা আগাম নিজেদের মাল নিজেরা বুঝে নিয়েছে।"
বিপ্লব ঘাবড়ে গিয়ে বলে, "এ কেমন কথা?"
সোনায়েদ জাকি বজ্রনির্ঘোষে হাততালি দেয়, "এনকোর, এনকোর!"
কলু মুস্তফি উৎসাহ পেয়ে তর্জনী উঁচিয়ে বলে, "সুন্দরবনের হরিণশিশু যদি নিজেই সুন্দরবনের মাঝে কয়লাবিদ্যুতের কেন্দ্র খুলে বসতো, আমরা কিছু বলতে পারতাম? চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে করবো কী? জামাতশিবিরবিম্পির গাছকাটাকেও সুন্দরবনের হরিণশিশু কর্তৃক সুন্দরবনে কয়লাবিদ্যুৎ খুলে বসা হিসাবে দেখতে হবে। যেহেতু এই গাছগুলো কাটায় ভারতের ক্ষতি হয়েছে, তাই এখানে কোনো সমস্যা হয়নি। সর্বোপরি ...।"সে থেমে যায়।
বিপ্লব চিৎকার করে বলে, "ভারতের কীভাবে ক্ষতি হলো?"
কলু মুস্তফি আড়চোখে অধ্যাপক ঝানু মোহাব্বতের দিকে তাকায়, তিনি শব্দ না করে হাততালির ভঙ্গি করেন। ভরসা পেয়ে কলু বলে, "হয়েছে। এটা আপনি বুঝবেন না। অর্থনীতি বলে, ভারতেরই ক্ষতি হয়েছে। ঠিক যেভাবে সুন্দরবনের মাঝখানে সুন্দরবনেরই হরিণশিশু কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র খুললে ভারতের ক্ষতি হতো। জামাতশিবিরবিম্পি এখানে সেই হরিণশিশু।"
বিপ্লব বলে, "গাছ কাটলো বাংলাদেশে, টাকা মার গেলো বাংলাদেশের গরিবের, জামাতশিবিরবিম্পির ক্যাডাররা এখানে সুন্দরবনের হরিণশিশু হয় কীভাবে?"
ঝানু মোহাব্বত প্লাস্টার চুলকাতে চুলকাতে তৃপ্ত গলায় বলেন, "হয়, হয়, zানতি পারো না!"
বিপ্লব তোতলাতে থাকে, "মানে কী এসবের?"
কলু মুস্তফি আবার শুরু করে, "সর্বোপরি, এই গাছ কাটা হচ্ছে চাইনিজ কুড়াল ও চীন হতে আমদানি করা বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে। যেহেতু এতে করে দেশের কুড়াল ও করাতের বাজারে সংগ্রামী চীনা ইনসাফি ভাইদের অংশগ্রহণ বাড়ছে, তাই এতে করে ভারতের আবারও ক্ষতি হচ্ছে। অতএব এই সামান্য গাছকাটা নিয়ে আমরা বেশি সময় নষ্ট করবো না। ফিরে যাই সুন্দরবনের হরিণশিশুর জুতো পায়ে দিতে ...।"
বিপ্লব লাথি দিয়ে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার উল্টে দিয়ে বলে, "এসব কী বাকোয়াজ? কীভাবে হয়? ব্যাখ্যা কই? প্রমাণ কই? তথ্যসূত্র কই?"
কলু মুস্তফি এবার শার্টের হাতা গুটিয়ে চোখ পাকিয়ে শীতল গলায় বলে, "ব্যাখ্যা? প্রমাণ? তথ্যসূত্র? আপনি কোথাকার কোন হরিদাস পাল যে আপনাকে এসব দিতে যাবো? বাংলায় কথা বলি বোঝা যায় না?"
ফারুক গুয়েবাড়া দুই পা এগিয়ে এসে ধমক দিয়ে বলে, "বাড়ি কই আপনার? গোপালি?"
সোনায়েদ জাকি ধমকে বলে, "য়্যায়, কে আপনি?"
অধ্যাপক ঝানু মোহাব্বত দাঁত খিঁচিয়ে বলেন, "ঐ তুই কে রে?"
বিপ্লব এবার সামনে পড়ে থাকা সব প্লাস্টিকের চেয়ার লাথি মেরে ছিটকে ফেলে দিয়ে আকাশ কাঁপানো গর্জনে বলে, "আমি বিপ্লব!"
এবার সবাই চমকে ওঠে।
ফারুক গুয়েবাড়া কাছে এগিয়ে আসে, সোনায়েদ জাকি পকেট থেকে দূরবীণ বার করে বিপ্লবকে খুঁটিয়ে দেখে, কলু মুস্তফি দ্রুত মঞ্চ ছেড়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। অধ্যাপক ঝানু মোহাব্বত বিপ্লবের মুখে টর্চের আলো ফেলেন।
বিল্লাল পেছনে অস্ফূট গুঞ্জন শুনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে, আনজিরুল মহসিন, জিহাদুল ইসলাম ডালিম, আলেক মওলা, ফেনোমেনন, সবাই গুটি গুটি পায়ে এসে হাজির। তাদের সবার চোখে অস্বস্তি।
ঝানু মোহাব্বত প্লাস্টারমোড়া পা নিয়ে থপথপিয়ে হেঁটে এসে ক্রুদ্ধ বিপ্লবের চেহারাটা টর্চের আলোয় ভালো করে দেখেন।
ফারুক গুয়েবাড়া চমকে উঠে সোনায়েদ জাকি আর কলু মুস্তফির পেছনে গিয়ে লুকায়।
এক এক করে প্রবীণ বামেরা বিপ্লবকে ভালো করে দেখেন। বিকেল নিংড়ে পৃথিবী শেষ রোদটুকু ঢেলে দেয় বৃদ্ধ বিপ্লবের অবয়বে। ইনসাফিরা অপরাধীর চোখে একে অন্যের দিকে আড়ে আড়ে তাকায়।
বড়রা বিড়বিড় করে নিজেদের মধ্যে কথা বলেন, বিপ্লব একটা প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে ধপ করে তার ওপর বসে পড়ে। তাকে আরো বুড়ো দেখায়। বিড়বিড় করে সে বলে, "কতো জায়গায় গিয়েছি আমি! একদিনের জন্যে হলেও গিয়েছি! শুধু ডাক পাই না তোমাদের কাছ থেকে। ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে বসে বসে ভাবি, এই বুঝি ডাক আসে। কীসের কী! তোমরা করবে বিপ্লব? তোমাদের পাঞ্জাবির ভিতর দিয়ে রংবেরঙের নকশা করা গেঞ্জি ফুটে থাকে, এক একজনের পকেটে স্মার্টফোন, হাতে ভিডিও ক্যামেরা, বুক ভর্তি কুযুক্তি টোকা চিরকুট, মুখে হাসি আর মিথ্যা কথা। তোমরা কীভাবে আমাকে ডাকবে? আমাকে ডাকার কেউ নেই।"
সবাই বিপ্লবকে ঘিরে ধরে, কিন্তু সে চেয়েও দেখে না। আনমনে বকে যায় নিকারাগুয়ার জঙ্গলে তাকে ডাকতে গিয়ে সামোজার ন্যাশনাল গার্ডের তাড়া খাওয়া কিশোরের গল্প, নেপালের সিমিকোটের পাহাড়ে গুর্খা রেজিমেন্টের মুখোমুখি হওয়া ত্রস্ত কিশোরীর হাতে ধরা স্টেনে শেষ বুলেটটির লক্ষ্য নিয়ে দ্বিধার গল্প, ঝাড়খণ্ডের গহীন অরণ্যে রাজ্য পুলিশের রেইডের মুখে আসন্নপ্রসবা গেরিলার হাত ধরে তার মুখ চেপে ধরে রাখা প্রৌঢ় পিতার শুকনো চোখের গল্প। তার এক একটা এলোমেলো গল্পের কাছে ফিকে হয়ে আসে মাইকে ভেসে আসা অদূরে অন্য কোনো বাম নেতার একঘেয়ে হুঁশিয়ারি, সাম্রাজ্যবাদের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান, সংঘাত নয় সমঝোতা চাই, দুনিয়ার মজদুর এক হও এক হও, সোনায়েদ জাকি কলিং ইনসাফি ড্যুডস অ্যাকশন অ্যাকশন ডাইরেক্ট অ্যাকশন।
অ্যাকশনের কথা শুনে বিল্লালের সম্বিত ফেরে, সে বিপ্লবের মুখ থেকে চোখ সরিয়ে আশেপাশে তাকায়। দেখে, সবাই ঘিরে ধরেছে বিপ্লবকে।
তারপর অ্যাকশন শুরু হয়। আনজিরুল মহসিন খান আর জিহাদুল আসলাম ডালিম মারে ডাস কাপিটাল দিয়ে, আলেক মওলা মারে ভ্যানগার্ডের বাণ্ডিল দিয়ে, ফেনোমেনন মারে দুর্নীতি দুবৃত্তি সাম্প্রদায়িকতার হার্ড কভার দিয়ে, আর ঝানু মোহাব্বত পকেট থেকে বার করে ইস্পাতের মলাটে বাঁধাই করা ফরহাদ মগবাজারের মোকাবেলা। একটু পেছনে দাঁড়িয়ে হ্যা হ্যা করে হাসে আর উৎসাহ দেয় ফারুক গুয়েবাড়া, মার, মার শালারে, মার।
বিপ্লব লুটিয়ে পড়ে পথে। বাম নেতারা তাকে জামাতশিবিরের হিংস্রতা নিয়ে মারে। বিপ্লবের গরম রক্ত ছিটকে পড়ে তাদের সফেদ পাঞ্জাবিতে।
বিল্লাল শুনতে পায়, দূরে কোথায় যেন ঢাকের কাঠি বেজে উঠেছে। সূর্য অতি দ্রুত মুখ লুকিয়ে আড়াল করতে চায় এই হত্যাকাণ্ডকে, অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে কয়েকজন প্রবীণ বামপন্থীর ধবধবে সাদা পোশাকে জ্বলন্ত রক্তের ফোঁটা। বুক ভরা অব্যক্ত গল্প নিয়ে বিপ্লব খুন হয়।
পেলব বিল্লাল হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। বলে, আপনারা বিপ্লবকে মেরে ফেললেন?
সবাই এবার ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকায়। বিল্লাল ভয় পায় না এতটুকুও। সে আবারও বলে, আপনারা বিপ্লবকে মেরে ফেললেন?
এবার বামেরা সবাই নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে আলাপ করেন। ডাস কাপিটাল, ভ্যানগার্ড, দুর্নীতি দুর্বৃত্তি সাম্প্রদায়িকতা আর মোকাবেলা থেকে টপ টপ করে রক্ত ঝরে পড়ে পথে। নিথর স্তুপ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে বিপ্লব।
ঢাকের কাঠির গুড়গুড় শব্দ একটু একটু করে আরো জোরালো আর স্পষ্ট হয়। তাকে ছাপিয়ে অধ্যাপক ঝানু মোহাব্বত এবার এগিয়ে এসে মিষ্টি করে বলেন, "কই, না তো?"
বিল্লাল হাহাকার করে বলে, "আপনারা বিপ্লবকে মেরে ফেললেন?"
ইনসাফ সংগ্রামীরা বিপ্লবের মৃতদেহ চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে রমনা পার্কের এঁদো জলাশয়ের দিকে এগিয়ে যায়। ঢাকের শব্দ সেদিক থেকেই ভেসে আসছে। ক্রমশ সে শব্দের প্রাবল্যে বিসর্জন যাত্রা একটা ছন্দ পেয়ে যায়। অচেনা সংগ্রামীদের কাঁধে চড়ে মৃত বিপ্লব এগিয়ে যায় জলের দিকে।
বামেরা সবাই সার বেঁধে দাঁড়ায় ঝানু মোহাব্বতের পেছনে। ঝানু মোহাব্বত হেসে বলেন, "এ বিপ্লব সে বিপ্লব নয়!"
[মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়োজিত ভারতীয় কূটনীতিক দেবযানী খোবরাগাড়েকে নিয়ে কয়েকটা দিন প্রচুর কথাবার্তা হয়েছে। এই গল্পে খোবরাগাড়ে প্রাসঙ্গিক নন। তার নামটা অপ্রচলিত বলে সামান্য বদলে নিয়ে নতুন একটা শব্দ কয়েন করলাম, খুব-রগুড়ে। অর্থাৎ, অনেক রগড় ঘটায় যা, বা রগড় ঘটান যিনি। রগড়ের অর্থের মধ্যে কৌতুক, ঘর্ষণ, পেষণ, ইত্যাদি যেমন আছে, তেমনি আছে ঢাকের কাঠির আওয়াজ।]

সর্বোচ্চ দেশপ্রেম

$
0
0
ইস্কাটন থেকে পাক মোটর সামান্য পায়ে হাঁটা রাস্তা, তবুও আনিসুল হাইয়ের ভয় লাগে। যদি কিছু হয়?
জুন মাস নাগাদ এসে ছাত্রলীগের গুণ্ডাপাণ্ডারা সেনাবাহিনীর মার খেয়ে অবশ্য অনেকটাই ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, কদাচিৎ সীমান্তবর্তী এলাকায় কিছু দুমদাম ঠুশঠাশের উড়ো খবর কানে আসে কেবল। ঢাকায় দমবন্ধকরা পরিস্থিতি খুব মন্থর গতিতে আবার স্বাভাবিকের দিকে এগোচ্ছে।
পাক মোটরে আনিসুল হাইয়ের সামনে দিয়ে শোঁ-শোঁ করে চলে যায় জলপাই রঙের একটি সৈন্যবাহী ট্রাক। ভয়ে হাইয়ের হাত পা জমে আসে। যদি ট্রাকটা থামে? খাকি উর্দি পরা সেনারা নেমে এসে যদি তার দৈনিক কচুবনের ডাণ্ডি কার্ড দেখে সন্তুষ্ট না হয়? যদি ধরে নিয়ে যায় তাকে? বদি ভাইয়ের কাছ থেকে আনিসুল হাই শুনেছে, প্রায়ই নাকি রাস্তাঘাট থেকে যুবকদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।
তারা আর ফিরে আসে না।
ট্রাকটা এগিয়ে যায় ইন্টারকন্টিনেন্টালের দিকে, থামে না। আস্তিনে কপালের ঘাম মুছে আনিসুল হাই পা চালায়।
মেহফিলে মুনাওয়ারার ছায়া ঘেরা উঠানটা যতো কাছে আসে, হাইয়ের মনের চিমনিতে জমে থাকা দুর্ভাবনার কালিও আস্তে আস্তে মুছে যায়। কী যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণ আছে এখানে, একটা প্রাণ জুড়িয়ে যাওয়া মধুর শীতলতা ছড়িয়ে আছে এর আমগাছের ছায়ায়, লাইব্রেরি ঘরের বারান্দায়, দরবার ঘরের সামনের উঠোনটায়। দেশজুড়ে আম্লীগের লোকেরা যে ভয়ানক অস্থিরতার আগুন ছড়িয়ে দিয়েছে, তার বিপরীতে এ যেন এক টুকরো স্নিগ্ধ মরূদ্যান। আনিসুল হাইয়ের মনে হয়, এই বুঝি একটি মরুর দুম্বা পানি পান করতে এসে দাঁড়াবে মেহফিলে মুনাওয়ারার উঠোনে।
এর কৃতিত্ব দিতে হবে আবদেল আবু সাঈদী হুজুরকেই। আনিসুল হাইয়ের মনে হয়, ভদ্রলোক জাদু জানেন। মাদ্রাসা শিক্ষক হয়েও দুনিয়ার হেন বিষয় নেই, যা নিয়ে তিনি কথা বলতে পারেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও তার সঙ্গে বাহাসে জড়াতে ভয় পায়, এই বুঝি জ্ঞানের পাতলা আস্তর খসে গিয়ে ভেতরের মূর্খতার ইঁটগুলো অট্টহাসি দিয়ে বেরিয়ে আসে! অতি পাষণ্ড নাস্তিকও তাঁর বয়ান শুনে ভক্ত আশেক বনে যেতে বাধ্য। আনিসুল হাই মেহফিলে মুনাওয়ারাতে প্রায়ই আসে আবদেল আবু সাঈদী হুজুরের বয়ান শুনতে। তার ভেতরের অস্থিরতার অপনোদনে আবু সাঈদী হুজুর কখনো ব্যর্থ হননি।
আবু সাঈদী লাইব্রেরি ঘরের বারান্দায় আরামকেদারায় শুয়ে একটি কিতাব পাঠ করছিলেন, আনিসুল হাইকে আসতে দেখে মিষ্টি তাবাসসুমে তার মুখ ভরে ওঠে। আনিসুল হাই ইস্কাটন থেকে পাক মোটরের বিপদজনক ঝুঁকিসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে আসার ক্লেশ বিস্মৃত হয়, সে তসলিম জানিয়ে তৃপ্ত মুগ্ধ চিত্তে বলে, আসসালামু আলাইকুম হুজুর। কেমন আছেন?
আবদেল আবু সাঈদী মেহমান এলে খুশি হন, আরো খুশি হন যদি মেহমানের হাতে কিছুমিছু থাকে। তাই আনিসুল হাইয়ের শূন্য হাত দুটিতে তার স্নিগ্ধ দুটি চক্ষুর দৃষ্টিপাত ঈষৎ দীর্ঘায়িত হয়। কিন্তু আমীর-ফকির সবার প্রতি তিনি সমান উদার, তাই বলেন, ওয়ালাইকুম সালাম আ্নিসুল হাই। কেমন আছো তুমি?
হাই মোড়া টেনে আবু সাঈদী হুজুরের পায়ের কাছটায় বসে পড়ে ধপ করে। এই একটি মানুষের কাছে এসে সে হৃদয়ের কথা উজাড় করে বলতে পারে, তার সব গ্লানি এই মানুষটির ছায়ায় এসে দূর হয়।
"ভালো নেই হুজুর। দেশের এই রাজনৈতিক হানাহানি, ক্ষমতার জন্য এই কুৎসিত মারামারি, আমাকে বড় তকলিফ দেয় হুজুর।"হাই কথা শেষ করতে গিয়ে একটু ফুঁপিয়ে ওঠে।
আবু সাঈদী হুজুর রেডিও পাকিস্তানে একসময় নিয়মিত ইসলামী ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান করতেন, তিনি সুললিত কণ্ঠে সামান্য সুর করে বলেন, "ভালো থাকা, আর না থাকা, সবই তো নির্ভর করে তোমার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। তুমি কী মনে করো যুবক, আল্লাহ তোমাকে খারাপ রাখতে চান? কখনোই না। তিনি চান তুমি ভালো থাকো। কিন্তু তুমি যদি তোমার নজরকে ঠিক জায়গা থেকে ঠিক জায়গায় ফেলতে শেখো, তাহলেই দেখবে আর খারাপ লাগছে না। আমাকে বাতাও, কী নিয়ে তোমার এতো তকলিফ?"
আনিসুল হাই মন খুলে বলে যায় তার কষ্টের কথা। সিরাজউদ্দৌলার মামাকে নিয়ে তার লেখা কিতাব "মামা"মানুষের মাঝে সমাদৃত হওয়ার পর দৈনিক কচুবনের সম্পাদক বদি ভাই রহমান তাকে আরেকটি উপন্যাস লিখতে বলেছিলেন, কিন্তু তার কলম দিয়ে লেখা আসছে না। দেশের রাজনৈতিক হানাহানি বড় বেশি দাম নিয়ে নিচ্ছে। মাঝে মাঝে বদি ভাই রহমান তাকে জিজ্ঞাসা করেন, নতুন উপন্যাস কতোদূর এগোচ্ছে, সে কোনো সাড়া দিতে পারে না।
আবু সাঈদী হুজুর মন দিয়ে শোনেন, তারপর শুধান, "তোমার নতুন উপন্যাস কী নিয়ে লিখছো?"
আনিসুল হাই মাথা নিচু করে বলে, "তিতু মীরের বাঁশের কেল্লা নিয়ে হুজুর।"
তৃপ্তির হাসিতে আবদেল আবু সাঈদী হুজুরের মুখ আলোকিত হয়ে যায়। তিনি বলেন, "য়্যায় নওজোয়ান, তুমি সহী রাহে অগ্রসর হচ্ছো। উপন্যাস লিখতে গেলে নজর দিতে হবে চারপাশের ডামাডোল থেকে নিরাপদ দূরত্বে। আনেওয়ালা কাল কেমন হবে, আমরা জানি না, তা নিয়ে কল্পনা বিলাসিতায় ওয়াক্ত বরবাদ করার কোনো মানে হয় না। আমাদের নজরের একলওতি গন্তব্য তাই গুজরা হুয়া জামানা। হিন্দুর ভাষায় যাকে বলে অতীত, ভূত। ওখানে কী হয়েছে, কী হয়নি, সবই আমাদের জানা। সেই কী হয়েছের সঙ্গে একটুখানি কল্পনার কী হয়নি মিশিয়ে আমাদের কিতাব রচতে হবে। বর্তমান নিয়ে লিখতে গেলেই গণ্ডগোল। তাতে তোমার আপন সংসারের মানুষ তোমাকে পর করে দিতে পারে। তোমার দোস্ত হয়ে উঠতে পারে তোমার দুশমন। তোমার পড়োসান হয়ে উঠতে পারে জালিম। আর সমাজ হয়ে উঠতে পারে বৈরী। ইয়াহিয়া সাহেবের কথা বাদই দিলাম। কখনো সাম্প্রতিক সময় নিয়ে লিখবে না, তাতে মুশকিল বাড়ে। লিখবে এমন সময় নিয়ে, যে সময় নিয়ে লিখলে কোনো সমস্যা নাই। সিরাজউদ্দৌলা, তিতু মীর, শায়েস্তা খাঁ, এদের নিয়ে সাহিত্য লিখবে। সিরাজউদ্দৌলার মামাকে নিয়ে তুমি যে কাহানি রচেছো, তা পাঠ করে আমার দিল রওশন হয়েছে। আহা, কী চমৎকার বয়ান। আমার সাধ্য থাকলে তা ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করতাম। তোমাকে আরো অনেক লিখতে হবে। ফেরদৌসীর শাহনামা, মীর মশাররফের বিষাদ সিন্ধু, কায়কোবাদের মহররম শরীফের মতো অজরামর রচনা সৃষ্টি করতে হবে। লেখকের পুঁজি অতীত ও সমকালের মানুষের আখলাক। তা দিয়েই সে তার আপন ভূবন রচে। তাই লেখক একই সাথে খালেকও বটে। তুমি নিশ্চিন্ত মনে বাঁশের কেল্লা রচনা করো। এই হানাহানি গোলাগুলি মারামারি নিয়ে বেচেয়ন হয়ো না। এগুলো সাময়িক। জ্যৈষ্ঠের ভ্যাপসা গরমের পরই আষাঢ়ের বরসাত নামে, বাগিচায় বেলি চামেলি গুল খিলে। তুমি ডানে বামে না তাকিয়ে শায়েরিতে মন দাও।"
এক অপূর্ব আশায় আনিসুল হাইয়ের বুক ভরে ওঠে। কিন্তু তার মনের কোনো জমা হওয়া কালি পুরোটা দূর হয় না। সে আবু সাঈদী হুজুরের একটি পা নিজের কোলে তুলে নিয়ে নীরবে টিপতে থাকে।
কিন্তু তার মনের কোণে পুঞ্জ পুঞ্জ ক্ষোভ অশ্রু হয়ে এক ফোঁটা তপ্ততায় আবু সাঈদী হুজুরকে সচকিত করে তোলে। তিনি আরাম কেদারায় সোজা হয়ে বসে বলেন, "কী হয়েছে বেটা? মরদ আদমির তো রোদন শোভা পায় না। কী নিয়ে দুঃখ তোমার?"
আনিসুল হাই অশ্রুগলিত কণ্ঠে আবু সাঈদী হুজুরের পা টিপতে টিপতে বলে, "হুজুর, চিলির শায়ের নিকানোর পারা বলেছিলেন, কাকে বলে শায়েরি, যদি ওয়াতন না টেকে?"
আবু সাঈদী হুজুর তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, "ও একটা কাফের। ও শায়েরির কী বোঝে? এসব চিলি চিচিঙ্গার নাস্তিকদের কথায় কান দিও না। আমি যা বললাম, তা-ই করো।"
তবুও আনিসুল হাইয়ের অন্তরে প্লাবন থামে না।
আবু সাঈদী হুজুর সমঝদারের হাসি হাসেন। বলেন, "নওজোয়ানের চোখে আঁসু আনতে পারে কেবল তিনটি জিনিস। মুলতানের পেঁয়াজ, দোস্তের রক্ত ও মাশুকার ভর্ৎসনা। তুমি তো লজিং থাকো, পেঁয়াজ কাটতে হয় না। তোমার দোস্তরাও নিরাপদে আছে। তা মাশুকাটি কে?"
আনিসুল হাই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলে, "বিলকিস!"
আবু সাঈদী হুজুর এবার আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে গড়গড়ার নল মুখে দিয়ে প্রসন্ন গুড়ুক গুড়ুক টান দেন তামাকে। মিষ্টি ইস্তাম্বুলী তামাকের গন্ধে বারান্দা মাতোয়ারা হয়ে ওঠে।
আনিসুল হাই নাক টেনে বলে, "সেদিন ইস্কাটনে পাশের বাড়ির আজাদদের বাসায় গিয়েছিলাম, সন্ধ্যাবেলা একটু গুফতাগু করার খায়েশে। গিয়ে দেখি বিলকিসও সেখানে বসে। জুয়েল আর বদি নামে দুটি বেয়াদব নাফরমানও সেখানে হাজির ছিলো। এ কথা সে কথার পর আজাদ বললো, দেশে যা হচ্ছে, তা ঠিক হচ্ছে না। এভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ কতল করা অপরাধ। হুজুর, আপনি তো জানেন, আমি শান্তি চাই। আশার কথা লিখি। কারণ আশার কথা লিখলে দুটো রূপি লাভ হয়। দেশ নিয়ে আম্লীগের আচরণকে আমি সমর্থনও করি না। পাকিস্তান আমার অন্তরের কর্দমে ফুটে থাকা পদ্ম। আমি তাদের বুঝিয়ে বললাম, ক্ষমতার লোভে শেখ সাহেব কেমন উন্মাদ হয়ে গেছেন। এ সমস্ত হানাহানির দায় তাঁরই। সাধারণ মানুষ শান্তি চায় বলেই গ্রামে গ্রামে পাড়ায় মহল্লায় শান্তি কমিটি হয়েছে। ইউসুফ সাহেব গত মাসে নিরীহ শান্তিপ্রিয় জামায়াতে ইসলামী কর্মীদের নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করেছেন। গোলাম আজম সাহেব নেজামে ইসলামী আর মুসলিম লীগকে সঙ্গে নিয়ে গণতন্ত্র বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এ সময় এসব স্বাধীনতা স্বাধীনতা বলে জাতিকে বিভক্ত করার কোনো অর্থ হয় না। স্বাধীনতা বড় না গণতন্ত্র বড়? অবশ্যই গণতন্ত্র বড়। তখন ... তখন,"আনিসুল হাই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে।
আবু সাঈদী হুজুর গড়গড়ায় নীরবে চুমুক দিতে দিতে বলেন, "বাতাও মেরে লাল। তখন?"
আনিসুল হাই রুমাল বার করে অশ্রুধারা মুছে বলে, "তখন ঐ বেয়াদব জুয়েল আর বদি আমাকে তিরস্কার করলো। বললো, আমি নাকি চামার। আর ... আর বিলকিস ... বিলকিসও তাদের সঙ্গে সায় দিলো!"তার গলা ধরে আসে।
আবু সাঈদী হুজুর নীরবে শুনে যান।
আনিসুল হাই বলে, "আমি তখন গত সপ্তাহে আপনার বয়ানে শোনা ট্রয়লাস ও ক্রেসিডার কাব্য থেকে তাদের বয়ান করলাম। বললাম, অনেক শোর মচানোর পর, অনেক খুন বহানোর পর শেষে বেহেস্তে যায় ট্রয়লাস। সেখানে গিয়ে বেহেস্তের একটি বাগিচায় বসে সে বহু নিচে পৃথিবীর পানে দিদার দেয়। তাকিয়ে সে চোখের সামনে দেখতে পায় এক নয়া দিগন্ত। তার মনে হয়, সংগ্রাম আর ইনকিলাবমুখর মানুষের এই দুনিয়া কত ছোটি সি বাত, কত ফিজুল এই হানাহানি। স্বাধীনতার মতো ছোটো স্বার্থ, গদিতে বসার ছোটো লোভ নিয়ে হানাহানি করে মরছে ইনসান। ট্রয়লাসের মতো আমরা যদি একটু দূরে গিয়ে পাকিস্তানের দিকে তাকাই, তবে আজকের এই এক দুই লক্ষ আম্লীগের মৃত্যুকে অত বড় মনে হবে না। আমরা যেন না ভুলি, ইতিহাসে আমাদের কোনো দিন নিজেদের দেশ ছিলো না। আমরা কোনো দিন স্বাধীন ছিলাম না। যেহেতু কোনোদিন স্বাধীন ছিলাম না, তাই আজ স্বাধীন হওয়ার কোশেশ করা ভুল। স্বাধীন হয়ে কী করতে কী করে ফেলবো, তার কোনো ঠিক আছে? ... তখন, তখন আজাদ আমাকে বললো, তুমি একটা ছাগল। হোসেনশাহী আমলের কথা তুমি ভুলে গেছো? আর ... আর ...,"আনিসুল হাই আবার চোখে রুমাল চেপে ধরে, "বিলকিসও তাতে সায় দিলো!"
আবু সাঈদী হুজুর স্মিত মুখে গড়গড়া টানেন।
আনিসুল হাই ধরা গলায় বলে, "আমি তবুও আপনার বয়ান থেকে স্মরণ করে বললাম, দ্যাখো আজাদ, আমরা পুরোপুরি রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতাহীন জাতি। আমরা মোগলের চাবুক খেয়ে, ইংরেজের চাবুক খেয়ে, এই প্রথম রাষ্ট্র পেয়েছি। সবে বুঝতে শুরু করেছি একটি ইনসাফি বুনিয়াদে দাঁড়িয়ে থাকা আধুনিক রাষ্ট্র কী। কী করে তা সেনাবাহিনী দিয়ে চালাতে হয়। এ নিয়ে গোটা পাকিস্তানি জাতি কম চেষ্টা করছে না। তুমিই বলো, আজ তুমি আমি কি পাকিস্তান চালাতে পারবো? আমরা উচ্চশিক্ষিতরা একটা সাইকেল চালাতে গিয়ে বার বার কাত হয়ে পড়ে যাই, আর শেখ মুজিব কীভাবে দেশ চালাবেন? আর সব দেশই কোনো না কোনো সময় এ রকম সংকটের ভেতর দিয়ে যায়। বিলাতে বছরের পর বছর যুদ্ধ হয়েছে। আমেরিকায় বছরের পর বছর যুদ্ধ হয়েছে। সেখানে জনজীবন কীভাবে তছনছ হয়ে গেছে। সে তুলনায় আমরা কত দিকে ভালো আছি। বৈঠকখানায় বসে দু'দণ্ড গুফতাগু করছি। বেলা বিস্কুট দিয়ে চা খাচ্ছি। বিলকিসের সঙ্গে ছাদে বসে লুডু খেলছি। তখন ... তখন বিলকিস বললো, সে আর কখনো আমার সঙ্গে লুডু খেলবে না!"আনিসুল হাইয়ের বুক বিদীর্ণ করে কান্না উঠে আসে।
আবদেল আবু সাঈদী হুজুর একটি হাত রাখেন আনিসুল হাইয়ের মাথায়।
আনিসুল হাই ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, "আমি তারপরও তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম, পাকিস্তানি জাতি আজ দাঁড়াতে চাচ্ছে, বড় হতে চাচ্ছে, জয় করতে চাচ্ছে। কিন্তু এই সমস্ত তালাশ ও আরমানের বুকের ওপর জল্লাদের মতো চেপে বসেছে আম্লীগের রাজনীতি। আজ এই শেখ সাহেবের দেখানো স্বাধীনতার দুঃস্বপ্নের ভুলভুলাইয়া থেকে আমাদের বেরোতে হবে। এই সব অপারেশন সার্চলাইট একটা সাময়িক ব্যাপার। যখন তুফান ওঠে, মনে হয় কোনো দিন এ বুঝি থামবে না। কিন্তু দেখা যায়, তুফান একসময় থেমে গেছে। তার পরে আসে এক লম্বি সি সুন্দর জামানা। আমাদের এখানেও তা আসবে আজাদ। গাছে গাছে গুল খিলবে, বাগিচায় শোনা যাবে কোয়েলের পুকার। আমি আর বিলকিস সেদিন ছেলেমেয়ে নিয়ে তোমার বাড়িতে বেড়াতে আসবো। তখন ... তখন বিলকিস বললো, সে মরে গেলেও কোনোদিন আমার মতো চামারকে শাদী করবে না!"আনিসুল হাই কাঁদতে কাঁদতে মোড়া ছেড়ে বারান্দার মেঝেতে গড়াগড়ি খায়।
আবু সাঈদী হুজুর সস্নেহে আনিসুল হাইকে ধরে আবার মোড়ায় উঠিয়ে বসান। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, "বুঝলাম বেটা, তোমার দিলে এ কীসের কুন্দন। কেন তোমার আঁখেঁ দুটি এমন মাখমুর। তোমার সমস্ত হয়রানির শাবাব আমার নজরে সাফ সাফ ধরা পড়েছে। শোনো হাই, পরওয়ারদিগার এ দুনিয়ায় দুই কিসিমের জানোয়ার তৈরি করেছেন। একটি জানোয়ার খুনে গরম, আরেকটির খুন সর্দ। যে জানোয়ারের খুন সর্দ, যেমন ধরো সাপখোপ কুমীর কচ্ছপ, তার জিসমের তাপমাত্রা মহল্লার তাপমাত্রার সঙ্গে ওঠে আর নামে। সে বৈশাখ মাসে জেগে উঠে নড়েচড়ে, একে ওকে কাটে, আর মাঘমাসে সর্দ-নিদে মগ্ন হয়। কী বুঝলে?"
আনিসুল হাইয়ের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে বলে, "হুজুর, আমি বুঝতে পেরেছি! আমাকে হতে হবে ঠাণ্ডা রক্তের জানোয়ার। যখন যেমন, তখন তেমন হতে হবে। যেদিকে বৃষ্টি, সেদিকে ছাতা ধরতে হবে। যখন আড্ডায় স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা উঠবে, তখন তাতে তাল মেলাতে হবে, আর আড্ডার বাইরে গিয়ে সেসব ভুলে যেতে হবে!"
আবু সাঈদী হুজুর একটু বিব্রত কেশে বলেন, "বেটা, হয়েছে কী, কথাটা আসলে অন্য রকম ...।"
আনিসুল হাই আবু সাঈদী হুজুরের হাত চেপে ধরে সোল্লাসে বলে, "আমি বুঝে গেছি হুজুর! যখন মহল্লা গরম, তখন আমিও গরম থাকবো, ৭ মার্চের ভাষণে যাবো, বিলকিসকে ছাদে ডেকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বলবো, মহান জাতির মহান নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব! আজাদ জুয়েল বদিকে বলবো, তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা। আর যখন মহল্লা টিক্কা খানের আর্মির গোলাগুলিতে ঠাণ্ডা, তখন দৈনিক কচুবনে লিখবো, এ জাতি শান্তি চায়, রাজনীতি পচা। তাই না?"
আবু সাঈদী হুজুর মিষ্টি হেসে বলেন, "বেটা, আল্লামা প্লেটোর কিতাব রিপাবলিক পাঠ করেছো?"
আনিসুল হাই সলজ্জ মুখে বলে, "না হুজুর। উপন্যাসটা কার মামাকে নিয়ে?"
আবু সাঈদী হুজুর আবার একটু কেশে বলেন, "ইয়ে ... কী বলে ... ওখানে একটা কথা আছে। আল্লামা প্লেটোর উস্তাদ আল্লামা সক্রাটেসকে একদিন এক শখস এসে শুধায়, দেশপ্রেম কী? জবাবে আল্লামা সক্রাটেস বলেছিলেন, বলছি, আগে আমার জন্য একটি মুরগা কিনে আনো। তখন সে শখস সক্রাটেসের জন্য বাজার থেকে একটি হৃষ্টপুষ্ট মুরগা কিনে আনে। সেটি পাক করতে করতে সক্রাটেস বলেন, নিজের কাজ সর্বোত্তমভাবে করে যাওয়াই সর্বোচ্চ দেশপ্রেম। ... তুমি কি বুঝতে পারছো বেটা, আমি কী বলতে চাইছি?"
আনিসুল হাই বিব্রত মুখে হেসে বলে, "জ্বি হুজুর। আমি এক্ষণই কারওয়ানবাজারে যাচ্ছি, দেখি ভালো দেখে মুরগা পাই কি না।"
আবদেল আবু সাঈদী হুজুর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দু'আ করে বলেন, "যাও জওয়ান, নিশ্চিন্ত মনে আগে বাড়ো। মুল্লুক তুমহারা সাথ হায়। ফি আমানিল্লাহ। "
আনিসুল হাই উৎফুল্ল মুখে বেরিয়ে আসে। তার বুক থেকে এক পাষাণভার নেমে যায়। এ শান্তির কাছে একটি মুরগার মূল্য নিতান্তই তুচ্ছ। আর বিলকিসের কাছে ছোটো হয়ে থাকবে না সে। দৈনিক কচুবনে এখন সে দিল উজাড় করে শান্তির সুনাম আর রাজনীতির বদনাম করে লিখবে। সেই সাথে আজ সন্ধ্যার আড্ডাতেই আজাদ, জুয়েল আর বদির কাছে তিন কপি "মামা"বিক্রি করবে সে। নিজের কাজ সর্বোত্তমভাবে করে যাওয়াই সর্বোচ্চ দেশপ্রেম। সে দেশপ্রেম আজাদের, জুয়েলের, বদির বা বিলকিসের দেশপ্রেম থেকে কোনো অংশে কম নয়।

অপর বাঁশতব

$
0
0

ডাগরতাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল হায়াত মণ্ডল খুব আরাম করে ঘুমাচ্ছিলেন।
শীতের রাত। সারা ভাতক্ষীরা জুড়ে কুয়াশা। ডাগরতাড়িতে কুয়াশা যেন আরো বেশি। মাঝে মাঝে ভূতের মতো এক একটা সাইকেল নিঃশব্দে টহল দেয় কাঁচা-পাকা সড়কে। যদিও সদর থানার ডিবির সাব ইন্সপেক্টর ও সাবেক ছাত্রশিবির নেতা হেমায়েত ডিগবাজের তরফ থেকে কোনো ধরনের বার্তা আসেনি, তবুও ডাগরতাড়িতে ছয় ঘণ্টা করে চার শিফটে টহল দিচ্ছে জামায়াত শিবিরের কর্মীরা। বদমাশ নাস্তিক জেলা সুপার মির্জা বেরহম তোপদার কখন ফোর্স পাঠায়, কিছুই বলা যায় না। কেবল হেমায়েত ডিগবাজের বার্তার ওপর ভরসা রেখে ঘুম দিলে সে ঘুম র‍্যাবের লোক এসে ভাঙাতে পারে।
স্বপ্নে আবুল হায়াত মণ্ডল ইউনিয়নের প্রান্তবর্তী গ্রাম বাবুইশিরার মণ্ডলবাড়ির ছেলে হরিপদ মণ্ডলকে বেঁধে রেখে তার সামনেই তার নতুন বৌ অলকাকে ধর্ষণ করছিলেন। হরিপদ মালাউনের এতো বড় সাহস, সে মুসলমানের দেশে নতুন বৌ এনে ঘরে তোলে! শহীদ কাদেরের ফাঁসির পর স্থানীয় আম্লীগের নেতাদের জবাই করার কাজে ব্যস্ত থাকায় হরিপদকে সময়মতো শায়েস্তা করা হয়নি। রাতে সরপুঁটি মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়ার সময় আবুল হায়াত মণ্ডল আনমনা হয়ে হরিপদের দুঃসাহসের কথাই ভাবছিলেন। মণ্ডল সাহেবের বেগম আলতা বিবি একটু দুশ্চিন্তিত হয়ে পাখার ডাঁট দিয়ে গুঁতো দেওয়ার পর তিনি হুড়োহুড়ি করে খাওয়া শেষ করে মোবাইল ফোনে বাবুইশিরা গ্রামের জামায়াত নেতা আলেফ সর্দারকে নানা সাংকেতিক কুশল জিজ্ঞাসা করে শুয়ে পড়েছেন। সেই চিন্তার ধাক্কাতেই হয়তোস্বপ্নে তিনি বেশি দেরি না করে সোজা কয়েকজন মুজাহিদকে নিয়ে রওনা হয়ে পড়েছেন বাবুইশিরার দিকে। স্বপ্নে সড়ক কাটা থাকে না, শীতও লাগে না, হাতে চাপাতি হাঁসুয়া বহন করার তকলিফ পেতে হয় না, তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি হরিপদকে বেঁধেছেঁদে অলকার পেটিকোট ছিন্ন করার কাজে লেগে পড়েন।
হরিপদ উঠানে হাত পা বাঁধা অবস্থায় গম্ভীর হয়ে শুধু বলে, ঘড়ঘড়ঘড়।
আবুল হায়াত মণ্ডল অলকার ঊরুতে কামড়াচ্ছিলেন, তিনি ভারি বিরক্ত হয়ে হরিপদের দিকে ফিরে বলেন, মানে কী?
হরিপদ খোলাসা না করে আবারও বলে, ঘড়ঘড়ঘড়।
এবার আবুল হায়াত মণ্ডল চটে উঠে অলকাকে মাদুরের ওপর চেপে ধরার দায়িত্ব আলেফ সর্দারের হাতে সাময়িকভাবে ন্যস্ত করে একটা ছপটি হাতে হরিপদের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে কষে কয়েক ঘা চাবকে বলেন, মানে কী রে ব্যাটা মালু?
হরিপদ ভাবুক চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে, ঘড়ঘড়ঘড়।
আবুল হায়াত মণ্ডল খুব রেগে গিয়ে চিৎকার করে একটা কিছু বলতে গিয়ে নিজের চিৎকারের শব্দে ঘুম ভেঙে বিছানার ওপর উঠে বসলেন।
আর অমনি তার মেজাজটা বিগড়ে গেলো। পাশে শুয়ে ভোঁসভোঁস করে ঘুমাচ্ছে আলতা বিবি। ধুত্তেরি, কেন যে তিনি স্বপ্নের মাঝে খামোকা উঠে বিরক্তিকর হরিপদকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেলেন।
আবুল হায়াত মণ্ডল কাঁথার নিচ থেকে উঠে গিয়ে গামছা দিয়ে কপাল ঘাড়ের ঘাম মুছলেন। সরপুঁটি মাছ কয়েক টুকরো বেশি খাওয়া হয়ে গেছে।
বাইরে থেকে শব্দ ভেসে এলো, ঘড়ঘড়ঘড়।
মণ্ডল ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ কান পেতে শুনলেন। দূরে ঝিঁঝির ডাক, বহুদূরে শীতার্ত শেয়ালের হুক্কারব, এ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। এমনকি তার ছয় ভাইয়ের একজনও নাক ডাকছে না।
মণ্ডল খুব সতর্ক হয়ে উঠে শরীরে চাদর জড়িয়ে মোবাইলটাকে গেঞ্জির পকেটে গুঁজে দরজার পাশে রাখা একটা রামদা তুলে নিয়ে সাবধানে দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিলেন। উঠানে নরম চাঁদের আলো, সন্দেহজনক কিছু দেখা যাচ্ছে না।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবুল হায়াত মণ্ডল বেরিয়ে এলেন। উঠানে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক চাইলেন তিনি, অস্বাভাবিক কিছু্ই নজরে পড়লো না।
কেবল তার বাড়িটা অস্বাভাবিক রকম শান্ত। ভাইয়েরা কেউ নাক ডাকছে না, বাড়ির বাচ্চারা মাঝে মাঝে রাতে বেড়ালের বাচ্চার মতো করে কেঁদে ওঠে, সেসব শব্দও নেই।
আবুল হায়াত মণ্ডল গলা খাঁকরে ডাক দিলেন, "খায়ের? খায়ের আছিস র‍্যা?"
খায়ের কোনো সাড়া দেয় না।
মণ্ডল আরেকটু এগিয়ে গিয়ে মেজো ভাই বাশারকে ডাকেন, "বাশার ঘরোত আছিস নাকি?"
বাশারের ঘর থেকে কোনো শব্দ আসে না।
মণ্ডল বাকি ভাইদের ঘুরে ঘুরে ডাকেন, "বরকত? হোসেন? হাসান? ফজল?"
মণ্ডলকে চমকে দিয়ে তার বুড়ি মা নিজের ঘর থেকে খনখন করে বলে ওঠেন, "আবুল হায়াত তুই রাত বিরেতে মরা ভাইদের ডাইকে বেড়াস কেন র‍্যা?"
আবুল হায়াতের বুকের মধ্যে রক্ত ছলকে ওঠে। মরা ভাই মানে? সন্ধ্যা বেলায় বরকত আর বাশারের সঙ্গে আগামী সপ্তাহে কাকে জবাই করা যায়, সে নিয়ে আলাপ করলেন তিনি। হাসান আম্লীগ করে, তাকে দিয়ে পুলিশের হাতে আটক পাশের গ্রামের শিবির কর্মী মোজাম্মেলকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনার ব্যাপার তদবির করা নিয়েও কথা হলো ভাত খাওয়ার আগে।
মণ্ডল রামদাটা মাটিতে ঠেকিয়ে হাতল ধরে তার ওপর ভর দিয়ে বলেন, "মা তুই ঘুমাসনি কেন? এসব কী বকতিছিস আবোল তাবোল?"
মণ্ডলের মা খুনখুন করে কাশেন, তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন, "আট মাস পুরইলো তোর ভাইগুনি ঢাকা শহরে যাইয়ে পুলিশের গুলি খাইয়ে শহীদ হলো। তুই এই রাইতের বেলায় তাদের ডাকিস কেনে? তোর কী হয়েছে রে বাপ?"
আবুল হায়াত মণ্ডলের বুক ধড়ফড় করে। কী বলছে মা এগুলো?
তিনি রামদা ধরে উঠানে বসে পড়ে বলেন, "মা তুই কী কতিছিস এসব? আমার তো তাদের সঙ্গে আজ সন্ধ্যাতেও কথা হলো। আস্তাগফিরুল্লাহ, তারা মরবে কেন?"
মণ্ডলের মা এবার সরু গলায় কেঁদে উঠে বললেন, "আরে আগের সালের মে মাসের চার তারিখে তারা সব ঢাকা গেলো। বললো জিহাদে যাতিছি মা দোয়া করিস। মরলে শহীদ বাঁচলে গাজী। ছয় তারিখ সকালে তোর কাছেই না মবিল ফুন এলো যে তোর ছয় ভাই পুলিশের গুলি খাইয়ে শহীদ হয়েছে। আর তোর ভাইরাই কি শুধু মরিছে? লক্ষ লক্ষ লোক পুলিশের গুলি খাইয়ে মরলো। লাশগুলিও পাইলাম না। সব লাশ নাকি নসিমনে চাপাইয়ে ইনডিয়া পাঠাইয়ে দিছে জালিমের দল। হায় রে আমার কপাল ...।"
আবুল হায়াত মণ্ডল চাদর দিয়ে কপালের ঘাম মোছে। কী ভয়টাই না পেয়েছিলো সে।
গলা উঁচিয়ে সে বলে, "মা তুই ঘাবড়াইসনি। এসব রটনকথা। আস্তাগফিরুল্লাহ, কেউ মরেনি।"
মণ্ডলের বুড়ি মা ধমক দিয়ে বলেন, "আরে সারা গ্রামের লোক আইসে গায়েবানা জানাজা পড়লো, আর তুই কতিছিস রটনকথা! লক্ষ লক্ষ লোক মরি গেলো ...।"
আবুল হায়াত মণ্ডল মাকে ধমক দিয়ে বলে, "কী যে তুই বলিস মা। লক্ষ লক্ষ লোক মারা এতো সোজা নাকি? এইটে কি একাত্তর সাল পেয়েছিস? বরকত সেদিন বিকালের মইধ্যে জিহাদের কাজ শ্যাষ করে ভাতক্ষীরার বাসে উইঠে আমারে ফুন দিছিলো।"
মণ্ডলের মা তবুও খুনখুন করেন, "নসিমনে চাপাইয়ে আমার বিটাগুলির লাশ ইনডিয়া নিই গেলো গো ...।"
আবুল হায়াত মণ্ডল বলেন, "মা তুই বকিসনি তো। ঢাকা শহরে নসিমন নেই। লক্ষ লক্ষ লাশ ইনডিয়া নিতি হলে হাজার হাজার নসিমন লাইগবে। সেইগুলো কি বলদের পুঙ্গা দিয়ে বাইর হবে?"
মণ্ডলের বুড়ি মা এবার কপাল চাপড়ে বলেন, "একটা মাত্র ছাওয়াল বিটা বাকি আছে, সিটাও মাথা বিগড়ি মজনু হলো। আল্লাহ গো তুমি এ কী করলে গো ...।"
আবুল হায়াত মণ্ডল অস্থির হয়ে গেঞ্জির পকেট থেকে মোবাইল ফোন বার করে বরকতের নাম্বারে কল করে উঠোনের মাঝে এসে দাঁড়ালো। মায়ের কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো?
হঠাৎ শীতল বাতাস বয়ে যায় উঠানে। মণ্ডল কেঁপে ওঠে। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে উঠান। বরকতের নাম্বারে কোঁ কোঁ করে রিং হয়, কেউ ধরে না।
কিন্তু, চাঁদের আলো কীভাবে?
আবুল হায়াত মণ্ডলের রামদা ধরা হাত ভিজে ওঠে ঘামে। আজ কেন চাঁদের আলো? আগামী পরশু রাতে না অমাবস্যা হওয়ার কথা? সে রাতেই তো বাবুইশিরায় গিয়ে হরিপদের বউ অলকার সর্বনাশ করার পরিকল্পনা সে আলেফ সর্দারকে ভাত খেয়ে উঠে ঘুমানোর আগে ফোন করে জানালো।
মণ্ডল রামদাটা হাত বদল করে কপালের ঠাণ্ডা ঘাম মোছে, তারপর চাঁদের দিকে তাকায়।
একটা ব্যাদান করা মুখ চাঁদের ভেতর থেকে স্মিত হাসি দেয় তার দিকে চেয়ে। সে মুখ ভর্তি লাল দাড়ি।
মণ্ডলের হাত থেকে রামদাটা পড়ে যায়। সাঈদী হুজুর না?
চাঁদের বুকে দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর চেহারাটা এবার চোখ টেপে।
আবুল হায়াত মণ্ডলের বুক প্রচণ্ড ধুকপুক করতে থাকে। চাঁদের বুকে কেন সাঈদীকে দেখা যাবে? এ কীভাবে সম্ভব?
সে কাঁপা হাতে এবার মোবাইল ফোনের অ্যাড্রেস লিস্ট থেকে একটা বিশেষ নাম্বার খুঁজে বের করে। বাঁশের কেল্লার অপু ভাইকে ফোন দিতে হবে। কোথাও একটা সমস্যা হচ্ছে।
বাঁশের কেল্লার অপু ভাইয়ের নাম্বারে রিং বাজতে থাকে, কেউ ধরে না।
আবুল হায়াত মণ্ডল আবার চাঁদের দিকে তাকায়। সাঈদী নাক খুঁটছেন একটা আঙুল দিয়ে, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
মণ্ডল রামদা ধরা হাতের বাহুতে কপালের ঘাম মোছে। অপু ভাইয়ের মোবাইলে রিং বেজে চলে শুধু।
মণ্ডলের বুকে এসে ভর করে প্রচণ্ড আতঙ্ক। ঢাকায় লক্ষ লক্ষ লোক মারা যায়নি, বগুড়াতেও চাঁদের বুকে সাঈদীকে দেখা যায়নি। এ সবই হয়েছে বাঁশের কেল্লায়। তার মুঠোফোনে সুনির্দিষ্ট বার্তা এসেছে, এসব খবর কীভাবে ছড়াতে হবে, কোথায় হট্টগোল বাঁধাতে হবে, তারপর লোক ক্ষেপিয়ে কোথায় আক্রমণ করে কী ধ্বংস করতে হবে।
কিন্তু মা বলছে তার ছয় ভাই মারা গেছে। মে মাসের পাঁচ তারিখে, পুলিশের গুলি খেয়ে, লক্ষ লক্ষ লোকের সাথে। গায়েবানা জানাজাও হয়েছে।
আর এখন চাঁদের বুকে দেখা যাচ্ছে সাঈদীর মুখ। প্রকাণ্ড লাল দাড়ির মাঝে দুটি সরু, কুটিল চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকে।
আবুল হায়াত মণ্ডল ঘামতে থাকে। সে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে থাকে সাঈদীর মুখের দিকে।
সাঈদী তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি ঈষৎ পরিবর্তন করে। আবুল হায়াত মণ্ডল বুঝতে পারে, সাঈদী হুজুর তাকিয়ে আছেন তার বাড়ির অদূরে এলজিইডির সড়কের দিকে।
এবার তার কানে ভেসে আসে সেই ঘড়ঘড়ঘড় শব্দ। অনেক স্পষ্ট, অনেক জোরালো। অনেকগুলো গাড়ির এনজিনের শব্দও সে শুনতে পায়। কতোগুলো বুট দ্রুত বেগে খটখট শব্দ তুলে রাস্তা ধরে এগিয়ে আসে, তারপর রাস্তা ছেড়ে নেমে আসে তার ভিটার দিকে।
একটা প্রচণ্ড লাথিতে সদর দরজা খুলে যায়। চাঁদের আলোয় দেখা যায় অচেনা উর্দি পরা কয়েকজন সৈনিক আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে মণ্ডলবাড়িতে প্রবেশ করেছে।
সৈনিকদের পিছু পিছু ব্যাজ পরা এক সেনা অফিসার এসে মণ্ডলের সামনে দাঁড়ায়। মণ্ডল খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পায়, প্রকাণ্ড এক বুলডোজার দাঁড়িয়ে আছে তার বাড়ির সামনে।
সেনা অফিসার হাসিমুখে সুর করে বলে, "হামলোগ বাঁশের কেল্লা সে আয়া। কেয়া আপ ক্লোজআপ করতে হাঁয়? ইয়া দুনিয়াসে ডরতে হাঁয়? অওর পেনাল্টি ভরতে হাঁয়? আপ ক্লোজআপ কিঁউ নাহি করতে হাঁয়য়য়য়য়? উল্টি সিধি চলতে হাঁয়? হুম হুম আহাহাহা হাহাহা ...।"
বুলডোজারের গর্জন শুনে আবুল হায়াত মণ্ডল রামদা ফেলে দিয়ে উঠানে ঢলে পড়ে।
বাঁশের কেল্লা সত্যি হয়ে গেছে।

[কাঠবলদদের জন্যে নোট: গল্পের সব ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবের সঙ্গে মিল কাকতালমাত্র।]

ভূরাজনীতি করছিলাম

$
0
0
দরজাটা খুলে যাওয়ার পর ওপাশে আমার গোমড়ামুখো পড়শী ফদলুর রহমানকে দেখে আমার কেন যেন ভালো লাগে না।
ঘণ্টাখানেক আগে যখন নিজের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলাম, তখন উল্টোদিকের বাড়ির কার্নিশে একটা মিশমিশে কালো দাঁড়কাককে উড়ে এসে বসতে দেখে বুকটা একটু দুরু দুরু করে উঠেছিলো। কুসংস্কারাচ্ছন্ন যাকে বলে, আমি তা নই। কিন্তু আমার দাদীর সব কথা তো আমি ফেলে দিতে পারি না, তাই না? দাঁড়কাক আর কালো বেড়াল, দুটোই অমঙ্গলের প্রতীক, দাদী পান খেতে খেতে আর উল বুনতে বুনতে হরদম এ কথাই বলতেন। আশেপাশে রোজই পাতিকাকের হল্লা শুনি, কিন্তু একটা জলজ্যান্ত ধেড়ে দাঁড়কাক যখন অন্য তিনশো ঊনষাটখানা ডিগ্রিকে কোনো পাত্তা না দিয়ে একেবারে কটমটিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে কার্নিশে বসে তাকিয়ে রইলো, তখন কেন যেন দাদীর সেই অমঙ্গলসঙ্কেতের কথাটাকে সিগারেটের পুটুর মতো ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারলাম না।
কিছুক্ষণ চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এ পদ্ধতিও দাদীরই শেখানো। দাঁড়কাক না দেখলে অমঙ্গলের আশঙ্কা কমে আসে। চোখ বুঁজে ভাবছিলাম, সম্ভাব্য কী কী অমঙ্গল হানা দিতে পারে আমার জীবনে। যারা আমার কাছ থেকে টাকা পায়, তারা বন্ধুবৎসল। হঠাৎ কয়েক লক্ষ টাকার জন্য হানা দিয়ে তারা আমার মতো সজ্জনকে ঠেঙিয়ে ভাংচুর করবে, সে সম্ভাবনা কম। কিন্তু এই অভিশপ্ত দাঁড়কাকের কারণে যদি সেই সদাহাস্যমুখ উত্তমর্ণের দল সব একসঙ্গে এসে আমাকে উত্তম-মধ্যম দেয়?
কিংবা, অফিসে যে কিছুদিন ধরেই শুনছি, নতুন সিইও নাকি দুয়েকটা ডিপার্টমেন্টকেই গায়েব করে দেওয়ার কথা ভাবছে, সেটাই সত্যি হবে না তো? কাল সকালেই হয়তো অফিসে গিয়ে দুঃসংবাদটা পাবো। ডিজিয়েম অমায়িক ভাবে ডেকে নিয়ে কেক-কফি খিলিয়ে পিলিয়ে হয়তো মিষ্টি করে গলাধাক্কা দিয়ে আরামের চাকরিটা খেয়ে ফেলবে কপ করে।
কিংবা হয়তো ফদলুর রহমানের সঙ্গে অকালসাক্ষাৎ ঘটতে পারে।
একটা চোখ খুলে দেখি, কার্নিশের ওপর একটা মিশমিশে কালো মেনি বেড়াল এসে হাজির হয়েছে, আর দাঁড়কাকটা সেটাকে আদুরে ঠোকর দিচ্ছে। আমাকে চোখ খুলতে দেখে এবার দাঁড়কাক আর বেড়াল, দুজনই ঘাড় ঘুরিয়ে কটমট করে আমার চোখ বরাবর চাইলো।
বুকটা তখন হতাশায় ছেয়ে গিয়েছিলো।
দরজা খুলে যাওয়ার পর তাই ফদলুর রহমানের মুখোমুখি হয়ে আমি খুব একটা বিচলিত হই না। প্রথমে কিছুক্ষণ চোখ বুঁজে থাকি দাদীর ফর্মুলায়। তারপর এক চোখে খুলে তাকিয়ে যখন দেখি, ফদলুর রহমান একই রকম গোমড়া মুখ করে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে, তখন মৃদু হেসে বলি, কেমন আছেন ফদল ভাই?
ফদলুর রহমান সেই বিটকেল দাঁড়কাক আর বেয়াড়া মেনিটার মতোই কটমটিয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। আমি জানি, ফদল ভাই ডাকটা লোকটা পছন্দ করে না। ভদ্রলোক রাজনীতি করেন, রাতের বেলা মাঝেমধ্যে টিভিতে চ্যানেল বদলানোর সময় দু'তিনটে চ্যানেলের টক শোতে তাকে দেখি, শুনেছি বাম রাজনীতির ময়দানে তিনি মোটামুটি কেষ্টুবিষ্টু লোক। এর আগেও তাকে ফদল ভাই ডেকে টক শোর লোকেরা বকা খেয়েছে। উচ্চারণটা নাকি ফিদেল হবে। ফিদেলুর রেহমান।
যদিও ওনার বাড়ির দরজায় ফদলুর রহমানই লেখা। আমি দশ-বারোবার সংশোধিত হওয়ার পর একদিন বিনীতভাবেই নামফলকটার দিকে বিনয়ী আঙুল তাক করে বলেছিলাম, কিন্তু ওখানে যে ফদলুর ... ?
সেদিন একটু রেগেই গিয়েছিলেন ফদলুর রহমান। দাদী যেভাবে পান চিবাতে চিবাতে দাঁড়কাক আর কালো বেড়ালের দোষকীর্তন করতেন, অনেকটা সে ঢঙেই চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিলেন, বানানটা ফদলুর, কিন্তু উচ্চারণটা ফিদেলুর। আমাকে ফিদেল ভাই বলতে পারেন।
তারপরও একদিন তাকে আনমনে 'স্লামালিকুম ফদল ভাই, ভালো আছেন'বলে ফেলেছিলাম। ভদ্রলোক বিষাক্ত চোখে আমাকে সেদিন প্রায় মিনিটখানেক দংশন করে হনহনিয়ে চলে গিয়েছিলেন।
কিন্তু আজ কেন যেন আর কোনো কিছুর পরোয়া করতে ইচ্ছা করে না।
ফদলুর রহমান সরু চোখে তাকিয়ে থাকেন আমার দিকে। আমি বুঝি, ভদ্রলোকের মাথায় চিন্তার ঝড় চলছে।
আমি দরজার ফ্রেমে হাত রেখে ভর দিয়ে বলি, আপনি না নিউ ইয়র্ক গিয়েছিলেন?
ফদলু সাহেব এবার চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন, ফদল নয়, ফিদেল। ফিদেল। ফিদেল চেনেন না?
আমি মিষ্টি করে হাসার চেষ্টা করি।
ফদলু সাহেব আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বলেন, নিউ ইয়র্ক গিয়েছিলাম। ফিরে এসেছি।
আমি গলা খাঁকরে বলি, আপনার না আগামী সপ্তাহে ফেরার কথা ছিলো?
ফদলুর রহমান দাদীর মতো পান চিবিয়ে বিষাক্ত নিচু গলায় বলেন, ছিলো, কিন্তু আজই ফিরে এলাম।
আমি হাতের উল্টোপিঠে কপালের ঘাম মুছে ফদলুর রহমানের হাতের দিকে হাত বাড়িয়ে বলি, এখনও বাসায় দৈনিক কচুবন রাখেন নাকি? দিন তো দেখি।
ফদলুর রহমান দাঁড়কাকের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আমাকে অনিমেষ দেখে নিয়ে চুপচাপ পত্রিকাটা আমার হাতে তুলে দেন।
আমি খবরের কাগজটা কিছুক্ষণ ওল্টাই পাল্টাই। দেশের মারপিট, খুনজখম, দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, পুনম পাণ্ডের পোপ ফ্রান্সিসের সামনে নগ্ন হওয়ার ঘোষণা, জাকা আশরাফ আর শহীদ আফ্রিদী আজ কী দিয়ে রুটি খেয়েছে, সব এক পলক করে দেখে যাই। আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখি ফদলুর রহমানের দিকে। ভদ্রলোক একই রকম শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দরজার ওপাশে।
আমি দৈনিক কচুবনের অনেক প্রশংসা করি। বলি, দারুণ খবরের কাগজ ফদ ... মানে, ফিদেল ভাই। আপনি তো ওখানে লেখেন মাঝেমাঝে, তাই না?
ফদলুর রহমানের অগ্নিদৃষ্টির উত্তাপ এক ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডও কমে না। তিনি গরগর করে বলেন, হ্যাঁ। কলাম লিখি।
আমি প্রাণপণে মেমোরি হাতড়ে বলি, ঐ যে "রাক্ষুসী হাসিনা, তোকে ভালোবাসি না"ঐ কলামটা না? বুধবারে বেরোয় যে?
ফদলুর রহমানের চাহনি যেন সামান্য মোলায়েম হয়ে আসে। কণ্ঠস্বরেও যেন বারুদের বদলে একটু মাখনের আভাস পাওয়া যায়। বলেন, হ্যাঁ, ওটাই।
আমি সপ্রশংস চোখে তাকে দেখে নিয়ে আবার দৈনিক কচুবন হাঁটকাই কিছুক্ষণ। তারপর বলি, পত্রিকাটা ভালো। কাগজের মানটা দেখেছেন? বেশ ভালো নিউজপ্রিন্ট। মজবুত আছে।
ফদলুর রহমান কিছু বলেন না।
আমি দৈনিক কচুবনকে এবার একটা কাজের কাজে লাগাই। ফদলুর রহমান তাকিয়ে দেখেন শুধু, কিছু বলেন না।
আমি কেশে গলা সাফ করে নিয়ে বলি, আর কী খবর, ফিদেল ভাই?
ফদলুর রহমান বলেন, এই তো। চলে আর কী। আপনি কি এবার একটু পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করবেন?
আমি দরজার ওপাশে দাঁড়ানো ফদলুর রহমানকে এপাশ থেকে দেখি। হঠাৎ মাথায় রক্ত চড়ে যায়। লোকটা নিজেকে ভেবেছে কী? সামান্য বাম রাজনীতি, টক শোর বকাবকি আর পত্রিকায় দুই কলম লেখার ফুটাঙ্গিতে ব্যাটার মাটিতে পা পড়ে না দেখছি। পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে বলে আমাকে!
আমি এবার একটু গরম হই। বলি, দেখেন ফিদেল ভাই, পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার দায়ভার আমার একার ঘাড়ে চাপালে তো হবে না। আপনি আগে বলেন আপনি নিউ ইয়র্ক থেকে এক সপ্তাহ আগে এসে হাজির হলেন কেন! একটা সন্তোষজনক ব্যাখ্যা আপনার কাছ থেকে আমরা পেতেই পারি।
ফদলুর রহমান এবার যেন একটু বিস্মিত হন। তার কণ্ঠের বারুদও যেন এক ছটাক কম পোড়ে। আমতা আমতা করে বলেন, বাম রাজনীতি নিয়ে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু গ্যালারিতে লোক হলো না। তাই একটু ঘোরাঘুরি করে ফিরে এলাম ...।
আমি বলি, ফিরে এলেন? নিউ ইয়র্কে এতো জলদি ঘোরাঘুরি শেষ হয়ে গেলো আপনার?
ফদলুর রহমান তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, নিউ ইয়র্কে আমি মাসে মাসেই যাই। আর কতো ঘুরবো?
আমার মেজাজটা আরো খারাপ হয়। বলি, বাম রাজনীতি করেন, তারপরও মার্কিনিরা তাদের দেশে ঢুকতে দেয়? শাহরুখ খানকে তো এয়ারপোর্টে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে রেখে ন্যাংটা করে তল্লাশি করে শুনেছি।
ফদলুর রহমান অবাক হয়ে বলেন, দেবে না কেন? বাম রাজনীতি করি বলে কি আমি মার্কিনিদের পর? আমি কি শাহরুখ?
আমি দৈনিক কচুবন সামলে ধরে বলি, তাহলে এই যে সাম্রাজ্যবাদ, বহুজাতিক কর্পোরেট, ইঙ্গ-ইন্দো-ইসরায়েলীয় ষড়যন্ত্র ...।
ফদলুর রহমান এই প্রথম একটু হাসেন, নিস্তরঙ্গ দীঘির জলে যেন একটা করমচা খসে পড়ে। খুশি খুশি গলায় বলেন, সেসব তো আছেই। এরই মাঝে মাঝে আছে হাসি, খুশি, হর্ষ, বাম রাজনীতি নিয়ে বক্তৃতা।
আমি দৈনিক কচুবনের একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে কপালের ঘাম মুছি। বলি, ওফফফফফ।
ফদলুর রহমান আবার হাসি ভুলে গিয়ে চটে উঠতে থাকেন। বলেন, আপনি এরকম ঘামছেন কেন, আগে ব্যাখ্যা করুন তো।
আমি বলি, ঘামবো না? একে তো এখানে এতো গরম, তার মধ্যে আবার কতো পরিশ্রম ...।
ফদলুর রহমান সরু চোখে আবার আমাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলেন, কী পরিশ্রম?
আমি গলা খাঁকরে বলি, একটা গোপন ব্যাপার। আপনার বিস্তারিত না শোনাই ভালো।
ফদলুর রহমান এবার এক পা এগিয়ে আসেন। আমি চট করে একটা হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলি, ফদ ... মানে, কী যেন বলে, ফিদেল ভাই, ওখানেই থাকুন। দরজার ভেতরে আসার চেষ্টা করবেন না।
ফদলুর রহমান মুঠো পাকিয়ে বলেন, বলুন শুনি কী গোপন পরিশ্রম। আপনাকে বলতে হবে।
আমি দৈনিক কচুবনটাকে যুতমতো পাকড়ে ধরে বলি, দেখুন ফিদেল ভাই, জোর-জবরদস্তি করবেন না। আপনাকে কেন সব গোপন কথা খুলে বলতে হবে? আমার ঘাম আমি ঘামি। আপনি তা নিয়ে এতো উতলা কেন?
ফদলুর রহমান দাঁতে দাঁত পিষে বলেন, আপনার ঘাম আপনি ঘামুন, যতো খুশি ততো ঘামুন। কিন্তু আমার ঘরে এসে আপনি ঘামছেন কেন?
এর কী উত্তর দেবো, বলুন তো? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর কি আদৌ হয়? মানসচোখে সেই মঙ্গলনাশা দাঁড়কাক আর অমঙ্গলবাহ বেড়ালটাকে দেখতে পাই, তারা কুটিল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে কয়েক মেগাওয়াট অমঙ্গল ছড়াচ্ছে। খুব রাগ হয় আমার।
আমিও মুঠো পাকিয়ে বলি, নাহয় আপনার ঘরে এসে একটু ঘামছিই। তাই বলে এতো চোটপাট করবেন নাকি?
ফদলুর রহমানের ধৈর্যের বাধটায় যেন একটু ফাটল ধরে। মাটিতে পা ঠুকে তিনি বলেন, আপনি আমার ঘরেই কেবল ঢোকেননি, আমার খাস অন্দরমহলের ভেতরে ঢুকে ঘামছেন। এর কী ব্যাখ্যা হতে পারে?
আমি বিস্মিত হয়ে যাই লোকটার বুরবাকপনা দেখে। তারপর চটে গিয়ে বলি, আরে, আপনার বেডরুমের দেয়াল আলমারির মধ্যে আধঘণ্টা ধরে আটকা পড়ে আছি রে ভাই। এমনিতেই গরম পড়ে গেছে, আর তার মধ্যে না আছে জানালা, না আছে ঘুলঘুলি না আছে ফ্যান, না আছে এসি। এই গুমোট গরমের মধ্যে আধঘণ্টা থাকলে একটা সুস্থ সবল সুঠাম উদাম যুবক ঘামবে না?
ফদলুর রহমান এবার দেয়াল আলমারির দরজার ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠে বললেন, আপনি আমার ঘরের অন্দরমহলে দেয়াল আলমারির মধ্যে উদাম হয়ে ঢুকেছেন কেন?
পৃথিবীটাকে বড় নিষ্ঠুর আর নিরর্থক মনে হয়। নিজেকে প্রশ্ন করি, সমাজটা এমন কেন? ফদলুর রহমান এমন কেন? ঐ দাঁড়কাক আর বেড়াল এমন কেন?
কোমরে দৈনিক কচুবনটাকে ভালোমতো প্যাঁচ দিয়ে গুঁজে এবার বেরিয়ে আসি দেয়াল আলমারি ছেড়ে। ফদলুর রহমানের কাঁধে হাত রেখে নিচু গলায় বলি, বলছি বস। কিন্তু খুব গোপন কথা। প্লিজ, আর কাউকে বলবেন না।
তারপর আমি সব বলি। 'চালান'শব্দটা শুনে ফদলুর রহমান ভুরু কোঁচকান। 'চীন'শোনার পর তাঁর মুখের মেঘ একটু কেটে যায়। 'আইএসআই'শুনে একটু যেন ভালো লাগার আলো ফুটে ওঠে তার গোমড়া অন্ধকার মুখে। শেষে 'উলফা'আর 'ভারতের পুটুমারা'শুনে আনন্দে হোহো করে হেসেই ওঠেন তিনি। তারপর আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেন, ভূরাজনীতি, তাই না?
আমি আঁতকে উঠে এক হাতে কোমরে দৈনিক কচুবন সামলাই, অন্য হাত ঠোঁটে তুলে বলি, শশশশশ, আস্তে! এ কথা পাঁচকান করবেন না প্লিজ।
ফদলুর রহমান তবুও হোহো করে খুশির হাসি হাসেন, তারপর বলেন, শুনলে স্বপ্না? উনি ভূরাজনীতি করছিলেন!
বিছানায় চাদরের নিচে আধশোয়া হয়ে বিবস্ত্রা মিসেস ফিদেল সিগারেট খাচ্ছিলেন, তিনি হাসি হাসি মুখ করে সায় দেন।
আমি তার দিকে তাকিয়ে অভয় দিয়ে বলি, হ্যাঁ ভাবী, ভূরাজনীতি করছিলাম।
ফদলুর রহমান বললেন, আসুন তাহলে একটু চা হয়ে যাক। স্বপ্না তুমি বিশ্রাম নাও, আমি নিজের হাতে ওনাকে চা বানিয়ে খাওয়াচ্ছি। আসুন আপনি। না না, দৈনিক কচুবন পাল্টে জামাকাপড় পরে নিন। দেখি স্বপ্না, পা-টা সরাও তো, ওনার প্যান্টের ওপর শুয়ে আছো কেন ... ?
ঘামতে ঘামতে চা খেতে বেরিয়ে আসি প্যান্ট হাতে। ভূরাজনীতির অনেক কষ্ট।

আটক তিন ব্লগারের মুক্তি চাই না

$
0
0

মাননীয় সরকার বাহাদুর,
সারাদেশ জুড়ে কয়েক মাস ধরে চলমান নাশকতার পরিকল্পনাকারী জামাত-শিবিরের ফেসবুক প্রোপাগাণ্ডা পেজ "বাঁশের কেল্লা"ও "ইসলামী ছাত্রী সংস্থা"বহাল তবিয়তে আছে। রাষ্ট্রের গোয়েন্দা পুলিশ ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণকারী কমিশন তাদের কিছুই করেনি, করতে পারেওনি।
পরিষ্কার ভাষায় রেললাইন উপড়ে ফেলার বা পুলিশ হত্যার আহ্বান জানানো এই পেজগুলোর সফলতা আজকের খবরের কাগজের অনলাইন সংস্করণে দেখতে পাবেন। রেল বিচ্যুত হয়ে হতাহত যাত্রী নিয়ে ধানক্ষেতে পড়ে আছে তূর্ণা নিশীথা, ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যায় আছেন রাজশাহীতে দায়িত্বরত পুলিশ অফিসার।
এই পেজ যারা চালায়, আপনারা তাদের গুপ্তকেশটাও ছিঁড়তে পারেন নাই।
আপনারা ধরেছেন তিনজন ব্লগারকে। তাদের অপরাধ, তারা একটি ধর্ম সম্পর্কে নিজেদের মত প্রকাশ করেছে। তাদের এই মত প্রকাশের জন্য কোনো ট্রেন লাইনচ্যুত হয়নি, কোনো মানুষও আহত বা নিহত হননি। তারা কোনো ধরনের নাশকতার ডাকও দেননি। আপনারা যদি এতই ধর্মবিশ্বাসী হবেন, তাহলে ধর্মের ঈশ্বরের হাতে পরকালে এদের বিচারের ভার কেন ন্যস্ত করেন না?
জামাতশিবির নিষিদ্ধের দাবিতে সারা দেশে যখন শান্তিপূর্ণ অনশন পালিত হয়, আপনারা সাড়া দেন না, আর যখন অশান্তির হুমকি আসে হেফাজতে ইসলামের পাণ্ডাদের কাছ থেকে, তখন আপনারা নিরীহ তিনজন লোককে তুলে নিয়ে পিটিয়ে তাদের ছবি ছাপিয়ে দেন মোল্লাদের আশ্বস্ত করার জন্য।
ভোটের জন্য? মোল্লাদের ভোট আপনারা পাবেন না। তাদের জুতা জিহ্বা দিয়ে চেটে সাফ করলেও পাবেন না। বরং যারা জামাতশিবিরের রাজনীতির মোকাবেলা করার জন্য আপনাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছে, তাদের ভোট হারানো শুরু করবেন। তিনটা ভোট এর মধ্যেই হারিয়েছেন, হয়তো কয়েকদিনের মধ্যে তিন মিলিয়ন ভোটের সংকল্পের গন্তব্য পাল্টে যাবে।
যে তিনজন ব্লগারকে আটক করেছেন, তাদের মুক্তি চাই না। তাদের আপনারা আটকে রাখুন। কারণ আপনারা তাদের নামধামছবি সব প্রকাশ করে দিয়েছেন। মুক্ত বাংলাদেশে এখন তাদের পিছু নেবে আততায়ীরা, যারা আপনাদের কল্যাণেই এদের চিনে নিয়েছে এবং যাদের দমন করার ব্যাপারে আপনাদের কোনো সদিচ্ছা আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
এই তিন ব্লগারকে আটকে রাখুন। যে দেশে ঈশ্বরের প্রতি অনাস্থার শাস্তি ঘাতকেরা বাড়ি এসে বুঝিয়ে দিয়ে যায়, সে দেশে পুলিশের হাত থেকে "মুক্তি"র কোনো অর্থ নাই। এদের আটকে রাখুন, বাঁচিয়ে রাখুন। আর মোল্লাদের স্যান্ডেল আইসক্রিম জ্ঞান করে লেহন করে যান।

সংযোজন ১:
তিন ব্লগারকে সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত [সূত্র]।
রোহিঙ্গা জঙ্গি সালাউলের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর হয়নি [সূত্র], ঠিক যেমন রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর হয়নি জামাতশিবিরের সন্ত্রাসে অর্থায়নের অভিযোগে আটক ইসলামী ব্যাঙ্কের মিরপুর শাখা ব্যববস্থাপক শহীদুল হকের [সূত্র]।
সংযোজন ২:
সালাউলের রিমান্ড আবেদন অবশেষে মঞ্জুর করেছেন কক্সবাজার আদালত [সূত্র]।

টয় পাইলট

$
0
0
১.
তুহিন অনেকক্ষণ ধরে চোখ কুঁচকে আকাশ দেখে, তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মোটা লোকটাকে বলে, "বাবা, প্লেনটা তো আর দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় গেলো?"
তুহিনের বাবা আড়চোখে ছেলেকে পরখ করে নিয়ে বলেন, "এই তো বাবা, প্লেনটা এখন অনেএএএএক ওপর দিয়ে উড়ছে। তাই তুমি দেখতে পাচ্ছো না।"
তুহিন গোমড়া মুখে আবার আকাশের দিকে তাকায়। বাবার সঙ্গে হাতিরঝিলে টয় প্লেন চালাতে আসাই ভুল হয়েছে তার, মনে মনে সিদ্ধান্তে পৌঁছায় সে। বাবা সবসময় রিমোট কন্ট্রোলটা দখল করে বসে থাকে। আধঘণ্টা টয় প্লেন চালালে তার মাঝে পঁচিশ মিনিটই বাবা নিজে চালায়, তুহিনের ভাগ্যে হয়তো পাঁচ মিনিট জোটে। এরপর মায়ের সাথে আসতে হবে, মনে মনে সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলে সে।
তুহিনের বাবা উদ্বেগ গোপন করে রিমোট কন্ট্রোল নাড়াচাড়া করতে থাকেন। প্লেনটা সম্ভবত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। কিন্তু এ কথা তুহিনকে বললে সে কেঁদেকেটে একটা কাণ্ড না ঘটিয়ে ছাড়বে না। ছেলেটা এক বছর ধরে ঘ্যানর ঘ্যানর বায়না করার পর অবশেষে গত বছর সিঙ্গাপুরের মোস্তফা মল থেকে তুহিনের জন্যে টয় প্লেন কিনে এনেছেন তিনি। এরপর দেশে শুরু হলো মারপিট খুনাখুনি। বার পাঁচেক টয় প্লেন চালাতে এসেছে তুহিন। বাচ্চা ছেলে, প্লেন চালাতে গিয়ে হারিয়ে ফেলবে, এ কারণে বেশির ভাগ সময় তিনি নিজেই টয় প্লেনের পাইলটের ভার নিজের কাঁধে নিয়েছেন। আজ তুহিনের স্কুল ছুটি, সে গতকাল রাতেই ঘোষণা দিয়েছে আজ দুপুরভর সে হাতিরঝিলে টয় প্লেন চালাবে। এখন যদি এটা খোয়া যায়, ছেলেটা আবার মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কান্নাকাটি শুরু করবে।
তুহিন আরো কিছুক্ষণ উসখুস করে বলে, "বাবা, প্লেনটাকে নিচে নামিয়ে আনো।"
তুহিনের বাবা ঢোঁক গিলে আবার চেষ্টা করতে থাকেন, রিমোট কন্ট্রোলের সব কয়টা বাটনই তার কাছে অচেনা মনে হতে থাকে। টয় প্লেন চালানো এতো কঠিন কেন?
এই প্রথম বিমানচালকদের ওপর একটা ক্ষীণ শ্রদ্ধা জন্মায় তার। কাজটা বেশ কঠিন, উপলব্ধি করেন তিনি। দেশী পাইলটদের বরাবরই তাচ্ছিল্য করে এসেছেন তিনি। কোনো পাইলট কখনো আশেপাশে ভাব নিতে এলে সবসময় দুটো কড়া কড়া বাঁকা কথা শুনিয়ে দিয়েছেন। একবার এক পাইলট এক বিয়ের অনুষ্ঠানে এসে খুব গম্ভীর মুখে বাকতাল্লা মারছিলো, কীভাবে ব্যাংকক থেকে ফেরার পথে হঠাৎ মুখোমুখি আরেকটা বিমান এসে পড়ে, কীভাবে তাৎক্ষণিক তৎপরতায় তিনি বিমানের মান আর জান রক্ষা করেন, কিন্তু কীভাবে কিসমতের ফেরে ধানক্ষেতে অবতরণে বাধ্য হন। বোরহানির গ্লাসে সুড়ুৎ করে এক চুমুক দিয়ে তিনি তারপর সেই পাইলটকে চিবি দিয়ে ধরেন। দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে তিনি বিতর্ক করে আসছেন, আর ঐ পাইলট তো ঠিকমতো কথাই বলতে পারে না। ফলে দাওয়াতে উপস্থিত সবাই মেনে নিলো যে এই পাইলট কোনো কাজেরই না, এই দেশে ভালো পাইলট পাওয়া যায় না, পাইলটের মতো পাইলট পাওয়া যায় কেবল সিঙ্গাপুরের মোস্তফা এয়ারলাইন্সে। তিনি তরুণ বয়সে আন্তর্জাতিক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে উত্তর কোরিয়ায় গিয়েছিলেন, তখন দেখেছিলেন, মোস্তফা এয়ারলাইন্সের পাইলটগুলো কী নিপুণ, কী দুর্ধর্ষ। বিমান চালু করার আগে তারা ভারি গলায় কী সুন্দর করে একটা ছোট্ট বক্তৃতা দেয়, বিমান অবতরণের পর সবাই কেমন আনন্দে আত্মহারা হয়ে সে পাইলটকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানায়, স্বল্প-কিন্তু-ভদ্রবসনা বিমানবালারা কেমন একটু পর পর আকুল হয়ে পাইলটের কেবিনে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা আটকে দেয়। সিঙ্গাপুরের মোস্তফা এয়ারলাইন্স অতুলনীয়।
পাইলটটা মুখ চুন করে বোরহানি না খেয়েই দাওয়াত থেকে কেটে পড়েছিলো। অচেনা লোকজন উদ্ভাসিত মুখে এসে তার দস্ত মর্দন করে বলেছিলো, আবদুন সাহেব, আপনার ফেসবুক ফলো করি। যা দিলেন ভাই, হেঁহেঁহেঁ ...।
তুহিনের চিৎকার শুনে সম্বিত ফিরে পান তিনি। "বাবা, প্লেনটা নিচে নামিয়ে আনো! এবার আমি চালাবো, আমি আমি আমি!"
রিমোট কন্ট্রোলের বোতামগুলো টিপতে টিপতে ছেলেকে সস্নেহ বকুনি দেন তিনি। "আহ তুহিন, কতোবার বলেছি, শুধু আমি আমিকরবে না। বাবাকে এখন একটু কনসেনট্রেট করতে দাও। প্লেন চালানো কঠিন কাজ বাবা।"
তুহিন কাঁদো কাঁদো মুখে বাবার মুখে দিকে তাকায়। তার মনে হয়, বাবা তাকে ধোঁকা দিচ্ছে। টয় প্লেন চালানো খুব কঠিন কাজ হলে বাবা কীভাবে চালায়?
তুহিনের বাবা আবারো আড়চোখে ছেলেকে দেখে নিয়ে তাড়াতাড়ি রিমোট কন্ট্রোলে থাপ্পড় মারতে থাকেন। মেশিনে থাপ্পড় দিলে অনেক সময় কাজ হয়। তুহিনের চোখমুখ লালচে হয়ে গেছে, সে ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলছে, যে কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। ছেলেটা বড় হয়ে যাচ্ছে, আগের মতো তাকে কোলে করে শান্ত করা যায় না, এখন হাত পা ছুঁড়তে থাকলে দুই-তিনজন লোক লাগবে তাকে শান্ত করতে।
"কাম ডাউন বাবা। এই যে নামিয়ে আনছি, সবুর করো।"প্রাণপণে রিমোট কন্ট্রোলে চাপ দিতে থাকেন তিনি।
তুহিন চিৎকার করার আগেই হুট করে একটা উটকো লোক এসে উদয় হয় কোত্থেকে যেন। "স্যার, আসসালামু আলাইকুম! আপনি এখানে?"
তুহিনের বাবা স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলেন। সেলিব্রিটি হওয়ার এই একটা সুবিধা, খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ালে স্যার বলে ডাক দেওয়ার লোক পাওয়া যায়। রিমোট কন্ট্রোলটা তুহিনের হাতে সস্নেহে তুলে দিয়ে তিনি বলেন, "নাও, তুমিই নামিয়ে আনো।"তারপর হাসিমুখে উটকো লোকটার সালামের জবাব দিয়ে তিনি বলেন, "এই তো, ছেলেটাকে নিয়ে একটু টয় প্লেন চালাতে এলাম।"
লোকটা তুহিনের বাবার সঙ্গে কথা বলতে থাকে, তুহিন রিমোট কন্ট্রোল হাতে অসহায়ের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের টয় প্লেনটাকে খুঁজতে থাকে। বাবা ওটাকে কোথায় পাঠিয়ে দিলো?
২.
কেন্টাকির নিরালা পাহাড়ি এলাকায় ক্রিচ এয়ার ফোর্স বেইসে কমিউনিকেশন রুমের দরজা খুলে ভূতের মতো নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকলো কর্নেল কোলম্যান। কানে হেডফোন গুঁজে বসে থাকা যোগাযোগ অফিসার সার্জেন্ট মেহিউ অস্পষ্ট গুনগুন শব্দ করছিলো, কোলম্যানের হুঙ্কার শুনে চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়ালো সে।
"বেইস ফ্যালকনহেডকে ধরো। তারা কোথায়?"
সার্জেন্ট মেহিউ আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে বললো, "তিরিশ সেকেণ্ডের মধ্যে বেইস ফ্যালকনহেড অনলাইনে আসবে, স্যার।"
কর্নেল কোলম্যান অসন্তুষ্ট গলায় ঘোঁৎ করে ওঠে। ক্ষেপণাস্ত্রবাহী একটা ড্রোন বিধ্বস্ত হয়েছে কান্দাহারের কাছে, ওপরমহলে এ নিয়ে নড়াচড়া শুরু হয়েছে। কর্নেল কোলম্যান ডিরেক্টর অব অপারেশনসের দায়িত্ব নেওয়ার পর ক্রিচ বেইস থেকে দূরযোগাযোগের মাধ্যমে এ পর্যন্ত সফলভাবে অনেকগুলো ড্রোন অপারেশন চালানো হয়েছে আফগানিস্তানে, নিজেদের পক্ষে কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া। এই প্রথম তার সাদা পাতায় লালদাগ পড়লো।
যোগাযোগ স্ক্রিনে ধূসর ছোপছোপ ইউনিফর্ম পরা এক সেনা কর্মকর্তার চেহারা ভেসে উঠলো। মাথা কামানো, রোদে পোড়া চেহারা, অভিব্যক্তিহীন নির্বিকার চেহারা।
"মেজর হ্যামন্ড রিপোর্ট করছি বেইস ফ্যালকনহেড থেকে।"
কর্নেল কোলম্যান ভুরু কুঁচকে ক্যামেরার দিকে তাকালো। "নেস্ট থেকে অপস ডিরেক্টর কোলম্যান বলছি। কী ঘটেছে মেজর?"
মেজর হ্যামন্ড ভাবলেশহীন মুখে বললো, "বেইস থেকে পঞ্চান্ন মাইল রেডিয়াসে ডেরা সাক্কো গ্রামে সম্ভাব্য ইনসারজেন্সির রিপোর্ট পেয়ে আজ সকাল দশটা কুড়ি মিনিটে আমরা রেকি করতে একটা নিরস্ত্র ফ্যালকন ক্লাস ড্রোন পাঠাই, স্যার। বেইস থেকে উড়াল দেওয়ার তিরিশ সেকেণ্ড পর সেটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বেইসের কাছে একটা পাহাড়ে আছড়ে পড়ে। সার্জেন্ট গিলমোরের নেতৃত্বে একটা দল সেটাকে উদ্ধার করে আবার বেইসে ফিরিয়ে এনেছে, স্যার।"
কর্নেল কোলম্যান বলে, "নেস্টের ড্রোন অপারেটর মাজিনি বলছে সমস্যাটা ওখানকার, এখান থেকে নিয়ন্ত্রণ ঠিক ছিলো। এ ব্যাপারে তোমার কী মত, মেজর?"
মেজর হ্যামন্ড একঘেয়ে সুরে বলে, "সঠিক, কর্নেল। সার্জেন্ট গিলমোর দুর্ঘটনার স্পট থেকে আরেকটি বিধ্বস্ত ও নিরস্ত্র ড্রোন উদ্ধার করে এনেছে। এটি আমাদের বহরের ড্রোন নয়। ক্ষতির ধরন দেখে মনে হচ্ছে, বহিরাগত ড্রোনটি আমাদের ড্রোনের স্টারবোর্ড প্রান্তে এসে তার সম্মুখভাগ দিয়ে ধাক্কা মেরেছে। এর ফলে দুটি ড্রোনই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং আকাশে ভেসে থাকার ক্ষমতা হারিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে, স্যার।"
কর্নেল কোলম্যান সটান খাড়া হয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলে, "মানে? আরেকটা ড্রোন কোত্থেকে এলো?"
মেজর হ্যামন্ড বললো, "এই বহিরাগত ড্রোনে আমরা কোনো ইনসিগনিয়া পাইনি, স্যার। এতে কোনো ধরনের অস্ত্র সংযোজনের ব্যবস্থাও নেই। এতে কোনো ধরনের রাডার কিংবা ক্যামেরাও নেই, নিয়ন্ত্রণের জন্য একটা দুর্বল একমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে কেবল। আমার অভিমত, এটা খালি চোখে না দেখে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।"
কর্নেল কোলম্যান চোখ লাল করে বললো, "তার মানে তুমি বলতে চাও কোনো শত্রু আমাদের বেইসের কাছে বসে একটা ফালতু ড্রোন চালিয়ে আমাদের একটা মিলিয়ন ডলার দামের ড্রোনকে ঠুক্কি দিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছে?"
মেজর হ্যামন্ড বললো, "সঠিক স্যার।"
কর্নেল কোলম্যান হুঙ্কার দিয়ে বললো, "বেইসের নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে মেজর?"
মেজর হ্যামন্ড বললো, "আমরা ইতিমধ্যে বেইস ফ্ল্যামিঙ্গোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি স্যার। মেজর হ্যারিসের নেতৃত্বে একটি কোম্পানি আরো তিরিশ মিনিট পর এসে পৌঁছাবে। সন্ধ্যা থেকে আমরা আশেপাশের এলাকা পরিষ্কার করা শুরু করবো স্যার।"
কর্নেল কোলম্যান রাগে গরগর করতে করতে বললেন, "শত্রুপক্ষের ড্রোনটা ভালোমতো পরীক্ষা করা হয়েছে মেজর? এটা কাদের বানানো বলে তোমার ধারণা? চীন? ভারত? রাশিয়া?"
মেজর হ্যামন্ড বললো, "নিশ্চিতভাবেই চীন স্যার। এর ইলেকট্রনিক অংশগুলোতে পরিষ্কার চীনা হরফ ছাপানো আছে। ক্যাপ্টেন ও'ব্রায়েন ইতিমধ্যে নেস্টের অ্যানালিস্টদের কাছে সব ছবি পাঠিয়ে দিয়েছে, স্যার।"
রাগে কর্নেল কোলম্যানের মাথায় ছোটো ছোটো চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেলো। চীনাদের এতো বড় সাহস, তারা আল কায়দার হাতে এখন ড্রোন তুলে দিচ্ছে?
মেজর হ্যামন্ড বললো, "বহিরাগত ড্রোনের একটি ডানায় কালো কালিতে রোমান হরফে একটি বার্তা লেখা আছে, স্যার।"
কর্নেল কোলম্যান বললেন, "ড্রোনের ডানায় বার্তা? কী বার্তা?"
মেজর হ্যামন্ড বললো, "EAST OR WEST, MOSTOFA IS THE BEST, স্যার।"
কর্নেল কোলম্যান হুঙ্কার দিয়ে বললেন, "আগামীকাল ইস্টার্ন সময় সকাল আটটার মধ্যে লিখিত রিপোর্ট চাই মেজর হ্যামন্ড। আর কিছু জানাতে চাও এখন?"
মেজর হ্যামন্ড নির্লিপ্ত মুখে বললো, "আর কিছু জানাবার নেই, স্যার।"
কর্নেল কোলম্যান বললো, "ওভার অ্যান্ড আউট।"
স্ক্রিন থেকে মেজর হ্যামন্ডের চেহারাটা মুছে গেলো। কমিউনিকেশন রুমে অস্থির হয়ে পায়চারি করতে লাগলো কর্নেল কোলম্যান। কে এই মোস্তফা? তার এতো বড় সাহস, মার্কিন ড্রোনঘাঁটির বগলে বসে সে আকাশ থেকে মার্কিন ড্রোন গুতা মেরে ফেলে দেয়? এ কি তবে নতুন ওসামা?
কর্নেল কোলম্যান কমিউনিকেশন রুম ছেড়ে বেরিয়ে নিজের অফিসের দিকে যেতে যেতে টের পায়, পরিস্থিতি আবারো জটিল হচ্ছে। মার্কিন জাতির স্বাধীনতা লুটেপুটে খেতে এবার মাঠে নেমেছে আকাশসন্ত্রাসী মোস্তফা। ওয়াশিংটন অবশ্য ব্যাপারটাকে লুফে নেবে, এমন সুযোগ বার বার আসে না। দেশ ও জাতির জন্যে একটা জবরদস্তু জুজুর বন্দোবস্ত আপনা থেকেই হয়ে গেলে মন্দ কী? ওদিকে বেচারা হ্যামন্ড আর হ্যারিসরা কবে বাড়ি ফিরতে পারবে, কে জানে?
৩.
তুহিন সজল চোখে রিমোট কন্ট্রোলের বোতাম টেপে, ঝকঝকে নীল আকাশে তার টয় প্লেনের নিশানা দেখা যায় না। দুয়েকটা চিল কেবল উড়ছে হাতিরঝিলের আকাশে।
তুহিন হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুঝে রাগে গনগনে মুখে বাবার দিকে তাকায়। বাবা তখনও একটা অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে। তুহিন বাবার কথা কিছুই বোঝে না। "... দ্যাখেন, গত বছর আমি অনেক হুজ্জতের মধ্যে পড়েছি। আমি জানতাম এমন সমস্যা হবে। তারপরও কিন্তু আমি গেছিলাম। যাই নাই? এই বছর যদি যাই, আরো বড় হুজ্জত হবে। সেই হুজ্জত কে সামলাবে? আমি না আপনি? যদি আমারেই সামলাতে হয়, তার খরচ তো আমাকে পেতে হবে, নাকি?"
লোকটা বিগলিত মুখে বলে, "স্যার এই ফেসবুকে কে কী বলে এগুলিকে পাত্তা দিয়েন না। সোজা ব্লক করে দিবেন স্যার।"
তুহিনের বাবা অসহিষ্ণু হয়ে নিচু গলায় বলেন, "কয়জনরে ব্লক করবো? এরা ফেসবুকের সব চিপাচাপায় বসে আছে। পান থেকে চুন খসলেই গালি খাইতে হয়। না ভাই, বাজারে মুরগির দাম বাড়ছে, সক্রেটিসের মুরগির দামও এখন বাড়তি। গত বছর যা দিছেন, এইবার তার দ্বিগুণ দিতে হবে। নাহইলে আমি নাই।"
লোকটা তারপরও হাসিমুখে চাপাচাপি করে, বলে, "স্যার এমন করা কি ঠিক? আমাদের বেকায়দায় পেয়ে হাদিয়া বাড়িয়ে দিচ্ছেন?"
তুহিনের বাবা এবার একটু ক্ষেপেই ওঠেন, আড়চোখে একবার তুহিনকে দেখে নিয়ে গলার স্বর নিচে নামিয়ে ধমকে বলেন, "আপনাদের আবার কী বেকায়দা? আপনাদের গায়ে তো ফুলের টোকাও পড়ে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গিয়ে গ্রামেগঞ্জে আপনাদের ব্যাঙ্কের নতুন শাখার ফিতা কাটে। বেকায়দায় তো পড়বো আমি বেচারা আবদুন। সবাই মিলে ফেসবুকে আমারে গালি দিয়ে পচায়ে গন্ধ ছুটাবে। গতবার বহু কষ্টে একে ওকে মুরুব্বি ধরে, সাক্ষী মেনে, সক্রেটিসের মুরগি তত্ত্ব দিয়ে ইজ্জত বাঁচাইলাম। এক মুরগি কয়বার কাটবো? এইবার আপনারা হাদিয়া ডাবল করে না দিলে এতো খাটনির মধ্যে আমি নাই!"
তুহিন শুনতে পায়, অচেনা লোকটা হাসতে হাসতে বলছে, "স্যার, খাটনি কোথায়? মঞ্চে উঠে কয়েকটা নাম পড়বেন, বাস এই তো?"
তুহিনের বাবা আঁতকে উঠে ফিসফিস করে গর্জে ওঠেন, "মঞ্চে উঠবো মানে? মঞ্চে ওঠার কোনো কারবার আপনাদের সঙ্গে আমার নাই। আমি জাগরণমঞ্চের লোক। আপনাদের মঞ্চে আমি কোনোদিন উঠবো না। বড়জোর মঞ্চের পিছন থেকে পর্দার আড়ালে বসে একটু কণ্ঠমধু দিতে পারি। যদি আগেরবারের ডাবল হাদিয়া দিতে রাজি থাকেন। নাহলে আমি নাই। রাজা রিচার্ডের তাঁবুতে সালাদিন প্রথমবার সস্তায় গিয়ে কোনোমতে পোষাতে পারে, কিন্তু দ্বিতীয়বার যদি সালাদিনরে রিচার্ডের তাঁবুতে ঢুকাইতে চান, হাদিয়া ডাবল করতেই হবে। সস্তার কারবারে সালাদিন আর নাই।"
অচেনা লোকটা কী যেন চিন্তা করে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, "আচ্ছা স্যার, আমি ব্যাঙ্কের আমীর সাহেবকে বলে দেখি। এখন তাহলে আসি। আল্লাহ হাফেজ।"
তুহিনের বাবা বিড়বিড় করে কী যেন বলতে বলতে তুহিনের কাছে এগিয়ে আসেন আবার।
তুহিন বহু কষ্টে কান্না চেপে রেখে বলে, "প্লেন কই?"
তুহিনের বাবা চোখ পাকিয়ে তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলেন, "এ কী? তুমি প্লেন নিচে নামাওনি কেন? প্লেন কোথায়?"
তুহিন চেঁচিয়ে বলে, "তুমি প্লেন উপরে উঠিয়েছো! এখন আমি আর নামাতে পারি না! আমাকে প্লেন এনে দাও!"
তুহিনের বাবা তুহিনের হাত থেকে রিমোট কন্ট্রোল কেড়ে নিয়ে কিছুক্ষণ বোতাম টিপে হতাশ গলায় বলেন, "যাহ! হারিয়ে গেলো! সিঙ্গাপুরের মোস্তফা মল থেকে তোমাকে একটা প্লেন কিনে এনে দিলাম, এভাবে দিনে দুপুরে হারিয়ে ফেললে?"
তুহিন ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে। তারপর মাটিতে গড়াগড়ি খায়।
তুহিনের বাবা বহু কষ্টে তুহিনকে জাপটে ধরে তুলে গাড়ির দিকে নিয়ে যান। তুহিন হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, "আমাকে আমার প্লেন এনে দাও! আমাকে আমার প্লেন এনে দাও!"
তুহিনের বাবা গাড়িতে তুহিনকে বসিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে সাবধানে বাড়ির দিকের পথে গাড়ি ঘোরান।
তুহিন ফোঁপাতে ফোঁপাতে মোবাইল ফোন বের করে মাকে ফোন দিয়ে নালিশ করে, "আম্মু! বাবা আমার প্লেন হারিয়ে ফেলেছে! আমার প্লেন আকাশে উড়ছিলো, তারপর বাবা সেটাকে কই নিয়ে গেলো, এখন আর প্লেন নিচে নামছে না!"তুহিন ফোন ধরে কাঁদতে থাকে।
তুহিনের বাবা গলা চড়িয়ে বলেন, "ওর হাতে দশ মিনিটের জন্য রিমোট কন্ট্রোলটা দিলাম, বাস, প্লেন গায়েব। এই হারে খেলনা হারালে চলবে?"
তুহিন চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, "আমাকে প্লেন এনে দাও।"
তুহিনের বাবা তুহিনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, "আচ্ছা, আরেকটা এনে দেবো। এই তো আগামী মাসেই একটা অনুষ্ঠান আছে। ওটা হলে বাবার হাতে টাকা আসবে, তখন বাবা সিঙ্গাপুর নিয়ে যাবে তোমাকে। এবার মোস্তফা মল থেকে আরো বড় একটা প্লেন কিনে আনবো আমরা, কেমন?"
তুহিন চোখ ডলতে ডলতে বললো, "তাহলে ঐটা আমি একা চালাবো। তুমি চালাতে পারবে না।"
তুহিনের বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, "আচ্ছা, ঠিকাছে। কিন্তু তুমি তো একা চালাতে গেলে প্লেন হারিয়ে ফেলো।"
তুহিন আবার চিৎকার করে বললো, "আমি প্লেন হারাইনি! তুমি প্লেন হারিয়েছো, তুমি তুমি তুমি!"
৪.
তুহিনের বাবা বাড়ি ফিরে ফিরে তুহিনের মায়ের ধমক খেলেন অনেকক্ষণ ধরে।
"এর আগে একটা স্পিডবোট কিনে আনলে তুহিনের জন্যে, সেটাও হারিয়ে গেলো। এবার প্লেন কিনে আনলে, সেটাও হারিয়ে গেলো। সমস্যা কী? এভাবে সব খোয়া যায় কেন?"তুহিনের মা ধমক শেষ করলেন এই জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দিয়ে।
তুহিনের বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "কী করবো তুহিনের মা? এই দেশটার আকাশেই সমস্যা। সিঙ্গাপুরের মোস্তফা পার্কের আকাশে যখন প্লেন ওড়ালাম, তখন কোনো সমস্যাই হয়নি। আসলে আমাদের গোটা দেশেই অসুখ। এর মূল অনেক গভীরে। এখন গালাগালি না করে চলো সুস্থভাবে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করি।"

সমর্থক

$
0
0
রুস্তম স্টেডিয়ামে বাঘ সেজে বাংলাদেশের খেলা দেখতে যায়।
কাজটা সহজ নয়। রুস্তমকে নিজের জামা খুলে সারা গায়ে প্রথমে হলুদ রং মেখে নিতে হয়। এর ওপর আঁকতে হয় কালো ডোরা। একটা কাপড়ের ডোরাকাটা লেজও সে বানিয়ে নিয়েছে, যেটা হাফপ্যান্টের সাথে সে গিঁট দিয়ে রাখে। রং মেখে বাঘ সাজার পর সে এর ওপর আবার জামা পরে স্টেডিয়ামের দিকে রওনা দেয়। কখনো বাসে, কখনো অটোরিকশায়, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে পায়ে হেঁটে। বসন্তে আয়োজিত ম্যাচগুলোতে তার তেমন সমস্যা হয় না। তখন বাতাস থাকে শান্ত, ঈষদুষ্ণ। রুস্তম লেজটা পকেটে গুটিয়ে রেখে নাচতে নাচতে স্টেডিয়ামে ঢুকে পড়ে, আর ঢুকে পড়ে নাচতে থাকে।
স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ মানেই হরেক কোণে ওঁত পেতে বসে থাকা ক্যামেরা। তারা রুস্তমকে আজকাল খুঁজে খুঁজে বার করে দুই ওভারের ফাঁকে। ফিল্ডাররা যখন বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের বদলে ডানহাতি ব্যাটসম্যানের জন্যে ফিল্ডিং সজ্জা পাল্টানোর জন্যে অলস পায়ে ছুটতে থাকে, কোনো এক ক্যামেরা রুস্তমকে পাকড়াও করে কোটি কোটি মানুষের কাছে দেখায়। রুস্তম স্টেডিয়ামে ঢুকলে অন্য কোনো অচেনা দর্শক ঠিকই একটা ঢোল বাজাতে বাজাতে এসে তার পাশে এসে নাচতে থাকে, কিংবা পতাকা তুলে নাড়তে থাকে কেউ। রুস্তম বুক ফুলিয়ে লেজ দুলিয়ে বিকট লাফঝাঁপ দিয়ে অঙ্গভঙ্গি করে তাদের তালে তালে। বাঘ সাজলে কখনো একা হতে হয় না রুস্তমকে।
ধারাভাষ্যকারেরা মাঝে মাঝে রসিকতা করে রুস্তমকে নিয়ে। বিদঘুটে টানে ইংরেজিতে চিবিয়ে চিবিয়ে হর্ষ ভোগলে জিজ্ঞাসা করে আতাহার আলী খানকে, এই লোকটা খেলার পরে গা থেকে রং তোলে কীভাবে?
আতাহার আলী খান বিরস গলায় বলেন, পানি দিয়ে।
দিবারাত্রির ম্যাচ শেষে স্টেডিয়ামে অনেক আবছায়া নেমে আসে, অনেকের মুখের অন্ধকার যোগ হয়ে তাতে, সেই আবডালে ক্যামেরা সবসময় রুস্তমকে খুঁজে বের করতে পারে না। কিন্তু ক্যামেরার নাগালের বাইরে দাঁড়িয়ে প্রায়ই তার গালে দু'টি বাড়তি উলম্ব ডোরা যোগ হয়। আসর ভেঙে যাওয়ার পর রুস্তম ভাঙা বুক নিয়ে গুটি গুটি পায়ে স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে বাস খোঁজে, অটোরিকশা খোঁজে, চুপচাপ লেজ গুটিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরে যায়। কোনো ক্যামেরা তাকে তখন আর অনুসরণ করে না। রুস্তমকে পাশ কাটিয়ে স্টেডিয়ামের বাইরের অনুজ্জ্বল শহরে আরো অনেকে নানা সুরে নানা স্বরে নানা কথা বলতে বলতে বাড়ি ফেরে। সেই ভিড়ে ভাঙা বাঘ হয়ে রুস্তমের শুধু মনে হয়, রঙের দাগটা যেন খুব বেশি চড়চড় করছে, কাপড়ের লেজটা যেন অনেক বেশি বেখাপ্পা।
বাড়ি ফিরে রুস্তম চুপচাপ বালতি থেকে মগে পানি তুলে বাঘস্নান করে। চুপচাপ ঠাণ্ডা ভাত খেয়ে নেয় ঠাণ্ডা তরকারি দিয়ে। তারপরে সে ভ্রুণের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমায়। স্বপ্নে সে একটা হলুদ-কালো ডোরাকাটা ঘুড়ি হয়ে ক্রিকেটের মাঠে ঘুরপাক খায়, দেখে নিচের সবুজ থেকে তামিম, সাকিব, মুশফিক, জিয়ার হাতে ধরা ব্যাট থেকে শিমুলের পেঁজা তুলোর মতো তার দিকে আলগোছে উড়ে আসছে সাদা বলের স্রোত, তারপর আবার ফিরে যাচ্ছে মাটিতে, সীমানার বাইরে।
ছক্কা! রুস্তম ঘুমের ঘোরেই হাত পা ছুঁড়ে চেঁচায়। পরদিন সে আবার ফিরে যায় নিজের কাজে।
কিন্তু মাঝে মাঝে বিশেষ এক খেলায় স্টেডিয়ামে গিয়ে রুস্তম দেখে, সে একা বাঘ নয়। স্টেডিয়ামের প্রবেশদ্বারের সারিতে তার মতো আরো অনেক বাঘ এসে দাঁড়িয়ে আছে। তবে তারা কেউ রুস্তমের মতো হতে পারেনি। তারা এখনও ফুলপ্যান্ট পরে থাকে, সানগ্লাস পরে থাকে। সবচেয়ে বড় কথা, তাদের কোনো লেজ নেই। রুস্তম মনে মনে হাসে। বাঘ হওয়া এতো সোজা নাকি? হেহ। মুখ থেকে পেট পর্যন্ত রং করলেই যদি বাঘ হওয়া যেতো ... হাহাহা।
স্টেডিয়ামের ভেতরে যাওয়ার পর সেসব পার্থক্যও ঘুচে যায়। আন্তর্জাতিক মানের ক্যামেরাগুলো তাদের স্বচ্ছ আর নিরপেক্ষ লেন্স বাগিয়ে স্টেডিয়ামের সব বাঘকে ধরতে গিয়ে ট্রাইপডের বিয়ারিং ক্ষয় করে ফেলে। ডানে বাঘ, বামে বাঘ। কেউ লাফাচ্ছে, কেউ নাচছে, কেউ বসে বসে মোবাইলে কথা বলছে। অনেক বাঘের ভিড়ে তারা রুস্তমকে খোঁজে। রুস্তম হচ্ছে সেই বাঘ যে কখনো খেলা কামাই করে না। যেখানেই বাংলাদেশ, সেখানেই রুস্তম।
রুস্তম এক কোণে দাঁড়িয়ে নিষ্ঠাভরে চেঁচায় আর নাচে। সে জানে, রুস্তম-বাঘ না নাচলে রান উঠবে না বাংলাদেশের, না চেঁচালে উইকেটও পড়বে না বিশেষ খেলার অন্য দলটার। বৃষ্টি নামুক, বাজ পড়ুক, শিল পড়ুক বা শিশির পড়ুক, তাকে নাচতেই হবে।
রুস্তম নাচতে নাচতেই দেখে, স্টেডিয়ামে সবাই বাঘ সেজে আসে না। কেউ কেউ আসে শূকর সেজে। তাদের গালে সবুজ জমিনে সাদা চাঁদ-তারা আঁকা। অন্য দলটা মাশরাফির বলে চার হাঁকালে তারা আনন্দে ঝলমল করে ওঠে, অন্য দলটা স্পিনের মোচড়ে মুশফিককে আউট করে দিলে তারা শীৎকার করতে থাকে, অন্য দলের খেলোয়াড়রা যখন পানীয় বিরতির সময় ইতস্তত দাঁড়িয়ে থাকে, তখন তাদের নাম ধরে চিৎকার করে ডেকে ওঠে।
রুস্তম তখন ঢোলে জোরে বাড়ি দিতে বলে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে। নিজের হুঙ্কারে সে এই শূকরদের ঘোঁৎঘোঁৎ চাপা দিতে চায়। শূকরেরা আড়চোখে তাকে দেখে চুপচাপ বসে যায় আবার।
বাংলাদেশ খেলার মাঠে হেরে যায় তবুও। রুস্তম ক্যামেরার গ্রহণবলয়ে দাঁড়িয়ে বুক উজাড় করে কাঁদে, তার গালে আবারও বাড়তি ডোরা যোগ হয়। শূকরের দল উৎফুল্ল মুখে মোবাইলে কথা বলতে বলতে স্টেডিয়াম ছাড়ে।
রুস্তম ভাঙা মন নিয়ে বেরিয়ে আসে স্টেডিয়াম ছেড়ে আবার। রাতে বাড়ি ফিরে সে নিদ্রার ঘোরে স্বপ্নে দেখে, বিশাল এক বাঘা ঘুড়ি হয়ে সে ভাসছে স্টেডিয়ামের আকাশে, তার চারপাশে বেলুন হয়ে ঘুরছে কতোগুলো হাসিমুখ দেঁতো চাঁদ-তারা শূকর। রুস্তম ছুটে ছুটে তাদের মুখে চুনকালি মাখাচ্ছে, আর নিচ থেকে একের পর এক সাদা বল এসে শূকরবেলুনগুলোর মুখ চূর্ণ করে দিচ্ছে।
রুস্তম ঘুমের ঘোরে হো হো করে হাসে আর পাক খায়।
শূকর জিতে গেলেও শূকরই রয়ে যায়। আর বাঘ হেরে গেলেও থেকে যায় বাঘ। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে রুস্তম আবার কাজে বেরিয়ে যায়। শহরের মানুষ আর শূকর অবাক হয়ে দেখে, একটি গর্বিত বাঘ লেজ দুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ফুটপাথ ধরে, আর তার মাথার ওপর শনশন করে ছুটে যাচ্ছে একটা হলুদ-কালো ডোরাকাটা ঘুড়ি।

কর্মসংস্থানে বাংলার উপযোগ

$
0
0
পৃথিবী আজ গতকালের চেয়েও একটু বেশি পরস্পর-সংযুক্ত।
অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত আজ অন্য প্রান্তের সংস্পর্শে বেশি আসছে। আর এই বর্ধিত যোগাযোগের যুগে অন্যতম অস্ত্র ভাষা।
উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবিস্তারের সূত্রে পৃথিবীতে ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ ও আরবি ভাষা বহুলকথিত। আমাদের দেশে বাংলা মাতৃভাষা হলেও উচ্চশিক্ষার মাধ্যম এখনও ইংরেজি। এর ভালো-খারাপ দুটি দিকই আছে নিশ্চয়ই।
কিন্তু কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ভাষা নিজের দেশের নাগরিকের জন্যে সুযোগ সৃষ্টির অনেক অস্ত্রের একটি। জার্মানিতে সাধারণত জনগণের অর্থে চালিত প্রকল্পের জন্যে যেসব দরপত্র আহ্বান করা হয়, সেখানে কার্যাদেশদাতার সঙ্গে বিভিন্ন স্তরে যোগাযোগের জন্যে জার্মান ভাষাকে আলাদা ধারায় নির্দিষ্ট করা থাকে। ভিনদেশী প্রতিষ্ঠানের সেসব দরপত্রে অংশগ্রহণে কোনো বাধা নেই, কিন্তু কাজ চালিয়ে নিতে গেলে তাদের অবশ্যই সে কাজের বিভিন্ন স্তরে জার্মান ভাষায় পারদর্শী জনবল নিয়োগ করতে হবে।
খুবই ছোটো একটি বিধি, কিন্তু এর প্রভাব অনেক। ভিনদেশী পেশাজীবীরা জার্মানের মতো খটমটে একটি ভাষা নতুন করে শিখে কাজ চালিয়ে নেওয়ার চেয়ে প্রকল্পের বিভিন্ন অংশে অন্তত একজন জার্মানকে নিয়োগ দিলে কাজ সহজে সমাধা করতে পারবেন। এতে করে শুধু যে কর্মসংস্থানের পরিধি বর্ধিত হচ্ছে, তা-ই নয়, দুটি ভিন্ন কর্মসংস্কৃতির মানুষ একে অপর সম্পর্কে জানতে পারছে, যার মূল্য অনেক।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক দরপত্র প্রায়ই ডাকা হয়, সেসব প্রকল্পে বেশিরভাগ সময় কায়িক অদক্ষ পরিশ্রমের কাজগুলো কেবল বাংলাদেশীদের জন্যে বরাদ্দ থাকে। এমনকি দরপত্রে যোগাযোগের ভাষা হিসেবেও ইংরেজিকে আলাদা ধারায় নির্দিষ্ট করা থাকে। এতে করে ব্যবস্থাপনার মাঝারি পর্যায়ের কাজে বাংলাদেশীদের নিয়োগের সুযোগ সীমিত ও অনিশ্চিত থাকে, কিংবা সে সুযোগকে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের ইচ্ছায় সীমিত ও অনিশ্চিত করে রাখা হয়।
আমরা যেহেতু ক্রমশ আত্মমর্যাদা নিয়ে সচেতন হচ্ছি, এবং এই আত্মমর্যাদার প্রকাশেও সমর্থ হচ্ছি, অনাগত দিনে আন্তর্জাতিক দরপত্রে কার্যাদেশদাতার সঙ্গে বিভিন্ন স্তরে যোগাযোগ ও দলিল সংরক্ষণের ভাষা হিসেবে বাংলা এবং কেবল বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। এতে করে বাংলাদেশীদের কাজের সুযোগ যেমন বিস্তৃত হবে, জ্ঞান স্থানান্তরের প্রথম ধাপটি সম্পন্ন হবে, আর বাইরের পৃথিবীর কাছেও আমরা আত্মসচেতন জাতি হিসেবে পরিচিত হবো।

ফাঁস

$
0
0
নেহারুল শুধু সমুদ্রের গর্জন শুনতে পান যেন। আর সেই মত্ত কল্লোল চিরে যেন বহুদূর থেকে সার্সির গানে মীড় হয়ে ভেসে আসে অ্যামবুলেন্সের হুঁশিয়ারি সঙ্কেত।
শহরের পথে নীরন্ধ্র যানজট বসন্তের ভোরে তন্দ্রাতুর সাপের মতো বিরক্ত আলস্যভরে নড়েচড়ে রোগীবাহী যানটিকে গন্তব্যের দিকে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। চাকা লাগানো খাটিয়ার ওপরে শুয়ে নিহাদ ইসলাম নেহারুল অর্ধচৈতন্যের ঘোরে সাগরের ডাক শোনেন কেবল। খাটিয়ার চাকা যাতে গড়ানোর সুযোগ না পায়, তার জন্যে বিশেষ ছিটকিনের ব্যবস্থা আছে, কিন্তু ব্যবহারবাহুল্যে তাদের বজ্র আঁটুনি ক্রমশ শিথিল হয়ে এসেছে। সেই ফস্কা গেরোর কল্যাণে অ্যামবুলেন্সের চলার তালে খাটিয়ায় শুয়ে ঈষৎ দুলছেন নেহারুল, তাঁর কেবলই মনে হচ্ছে তিনি একটি জীর্ণ ভেলায় চড়ে সাগরে ভাসছেন, আর দূর থেকে ভেসে আসছে কান্নার সুর মেশানো গুনগুন।
গ্রাম সম্পর্কের ভাগনে শহীদুল খাটিয়ার পাশে অ্যামবুলেন্সের আসনে বসে আছে। বুকের জমাট ব্যথাটা নেহারুলের দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দিয়েছে, তিনি তবু ভাবেন, শহীদুল বড় উদ্বিগ্ন এখন। সে হয়তো সজল চোখে নির্ণিমেষ চেয়ে আছে তাঁর দিকে, তার ঠোঁট নিঃসাড়ে নড়ছে, অবোধ্য সব আরবি দোয়া হয়তো সে পাঠ করে যাচ্ছে সমানে।
ডালিয়া বড় অসময়ে মেয়েকে দেখতে চলে গেলো আমেরিকা। এখন ডালিয়ার থাকার কথা তাঁর পাশে। বেশি সময় তো হাতে নেই আর। শুধু দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনের সাক্ষী হিসেবেই নয়, টাকাপয়সা অনেকখানিই ডালিয়ার আর ডালিয়ার বোনের অ্যাকাউন্টে আছে। কোনো ক্রমে যদি বেঁচে যান তিনি, বিলের অঙ্ক মেটানোর মতো টাকা তার হাতে এই মুহূর্তে নেই। হয়তো জটিল সব শল্যোপচার করতে হবে, হয়তো তাঁর হৃৎপিণ্ডটি খুলে নিয়ে একটি যন্ত্র দিয়ে বাকি দেহে রক্ত সঞ্চালন করতে হবে, হয়তো কৃত্রিম কোন অঙ্গ গুঁজে দিতে হবে ধুকপুক করতে থাকা জটিল প্রত্যঙ্গটির কোনো প্রকোষ্ঠে।
আবারও সাগরের গর্জন মন্দ্রতর হয়ে ওঠে। শুয়োরের বাচ্চা এপিএস টাকাগুলো মেরে না পালালে আজ ডালিয়ার অ্যাকাউন্টে হাত না দিলেও চলতো। তিনি গদি হারানোর পর একটা মুহূর্তও নষ্ট করেনি হারামজাদা, সটকে পড়েছে। নেহারুল মনে মনে এপিএসের কমিশন বাদে মোট টাকার অঙ্ক স্মরণ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু সে জটিল হিসাবে মস্তিষ্ক তাকে একটুও সহযোগিতা করে না। সে শুধু শোনায় সাগরের গর্জন, দূরাগত সাইরেনের আর্তনাদ আর এপিএসের অতীত আশ্বাস, "স্যার আপনি কিচ্ছু চিন্তা কইরেন না। জান থাকতে কোনো সমেস্যা হইতো না।"
কিন্তু সমেস্যা হয়ে গেছে।
পদচ্যুত মন্ত্রীর মতো উত্তপ্ত জিনিস এই দেশে দ্বিতীয়টি নেই। কেউ তাকে স্পর্শ করতে সাহস পায় না, পাছে সে-ও দগ্ধ হয়। দুদকের ঝামেলা এড়াতে ডালিয়া বদলির খ্যাপের টাকাগুলো নিজের বোন, ভাইয়ের মেয়ে, বোনের ননদের অ্যাকাউন্টে ভাগ করে ছড়িয়ে রেখেছিলো। বিকেলে টেলিভিশনে খবরটা আছড়ে পড়ার পরই তারা সবাই গলা শুকানো শুরু করে দিলো। হাঁটুর বয়সী মেয়েগুলোও এখন শেয়ালের মতো চালাক হয়ে গেছে। মালয়েশিয়ায় মাসের পর মাস প্রমোদ ভ্রমণের স্মৃতি গা থেকে কচুপাতার পানির মতো ঝেড়ে ফেলে অবলীলায় বলে ফেলে, আঙ্কেল, এখন তো একটু সমস্যা হবে, রাইট? অন্য কোনো অ্যাকাউন্টে নিয়ে যান প্লিজ, আই থিঙ্ক উই মাইট গেট ফ্রিস্কড বাই দিস ব্লাডি দুদক।
তখনও দুদকের ঝামেলা শুরু হয়নি। নেত্রীর কাছ থেকে এইটুকু সুবিধা অন্তত তিনি আশা করতেই পারেন। একটু গুছিয়ে নেওয়ার সময় পেয়েছিলেন নেহারুল। কিন্তু এপিএস আলামিনের গোপন ফোনে তখন রিং বাজলেও কেউ ধরে না। স্মার্ট ফোনের হালখাতায় "তালুকদার"নামটার ওপর টোকা দিতে দিতে আঙুল ব্যথা হয়ে যাওয়ার অবস্থা। ডালিয়ার মুখ তখন পাথরের মতো শক্ত, বিরোধী দলের মতো গোমড়া। আলামিন তালুকদার এভাবে পালাবে, নেহারুল ভাবেননি। ডালিয়া বহুবার তাঁকে বলেছিলো, এই এপিএসের জাতকে বিশ্বাস কোরো না, সময় থাকতে টাকাগুলো দিয়ে যেতে বলো। "সময় থাকতে"কথাটা পছন্দ করেননি নেহারুল। সময় থাকতে মানে কী? তাঁর সময় থাকবে না-ই বা কেন? ওপরমহল তো বরাবরই তাঁর ওপর সন্তুষ্ট ছিলো। "পাকা"হিসাবে আগের দলের প্রথম সারির নেতৃত্ব ছেড়ে তিনি চলে এসেছিলেন, কাঁচাদের মতো সময়ের অভাব তাঁর হবে কেন? কিন্তু রাজনীতির বালিঘড়ি হাতির দাঁতের মতোই, দুই কিসিমের। প্রকাশ্য বালিঘড়িটির রন্ধ্রে বালি জমাট বেঁধে অচল হয়ে থাকে, আর গোপন বালিঘড়িটি চুপচাপ নিভৃতে শেষ কণাটিকেও নিচের কুঠুরিতে ঠেলে পাঠায়। এপিএস হয়তো সেই ঘড়ি দেখেই হাতঘড়িতে সময় মেলাতো।
মাদারচোদ আলামিন।
শহীদুল একটু ঝুঁকে আসে, তার হাত ধরে বলে, "হুরু মামু, হুনরায়নি? হাসপাতাল যাইরাম অখন।"
নেহারুল শহীদুলকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করেন, কী বলবেন, ভেবে পান না, কিন্তু তাঁর ঠোঁট শুধু কেঁপে ওঠে, কোনো শব্দ বেরোয় না। আলামিনের পেছনে দুদক লাগবে, তাতে সন্দেহ নেই, সে জাহান্নামে যাক। কিন্তু টাকাগুলো মার যাবে তাঁর। এক কোটি দুই কোটি নয়, কোটি কোটি টাকা। ডালিয়া বহুদিন ধরে ঘ্যানর ঘ্যানর করে আসছে, টরন্টোয় একটা বাড়ি কিনতে হবে, ছোটো মেয়ের জামাই নাকি ইদানীং খুব ছটফট করছে সান দিয়েগোতে একটা বড় বাড়ি কেনার জন্যে, তাকেও সামাল দিতে হবে। একটা পরিবারের স্বপ্নকে পকেটে নিয়ে পালিয়ে গেলো খানকির ছেলে এপিএস।
সমুদ্র গর্জন প্রবলতর হয়, কিন্তু সার্সির এক লয়ের কান্না থেমে যায় হঠাৎ। অ্যামবুলেন্সের দরজা খুলে দুই অভিজ্ঞ স্বাস্থ্যকর্মী দক্ষ হাতে নামিয়ে আনে তাঁকে।
আজ গদিটা কোমরের নিচে থাকলে তিনি ইবনে কালবুন হাসপাতালে আসতেন না। হয়তো নিরালা দিনে তাঁর হৃৎযন্ত্র এভাবে হেঁচকিও তুলতো না। সিঙ্গাপুরে চেকআপ করে আসতেন একবার, কিংবা এসএসএফের পাহারায় রাস্তা ফাঁকা করে অ্যামবুলেন্স তাঁকে নিয়ে যেতো সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের ঝকঝকে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে।
ডালিয়া অবশ্য অনেকবার বলেছিলো, মিন্টো রোডের বাড়িটায় আরো কয়েক মাস বলে কয়ে থেকে যেতে। তাঁর মন সায় দেয়নি। উত্তরার বাড়িটায় বিশাল ফ্ল্যাটটা ফাঁকা ফেলে রেখে কী লাভ? মেয়েরা বেড়াতে এলে ওখানে থাকে কেবল। কিন্তু ঐ বাড়িটার ধারে কাছে ভালো হাসপাতাল নেই। মিন্টো রোডে থাকলে এসব ঝামেলা হতো না।
খাটিয়ার চাকার খিল খুলে যায়, ইমার্জেন্সিতে নিয়ন্ত্রিত দ্রুত বেগে ঢুকে পড়েন নেহারুল। হাসপাতালের নিচতলার সাদা প্লাস্টার করা ছাদ অনেকখানি উঁচুতে, নেহারুলের হঠাৎ মনে হয়, তিনি আবার শিশু হয়ে গেছেন, ছেলেবেলায় গ্রীষ্মে মেঝেতে শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছেন।
ইমার্জেন্সির মেডিক্যাল অফিসার দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে খাটিয়ার পাশে। গলায় স্টেথোস্কোপ ঝোলানো যুবক, বয়স বেশি নয়, মুখে ক্লান্তির হলরেখা।
শহীদুল হড়বড় করে কী যেন বকে যায়। নেহারুল আবার সাগরের ঢেউয়ের শব্দ শুনতে পান কেবল। বুকের ব্যথাটাকে তাঁর ক্রমশ অলঙ্ঘ্য মনে হয়। অপটু ঘটকের কারণে জুটে যাওয়া মুখরা স্ত্রীর মতো ব্যথাটা জীবনের বাকিটা সময়ের জন্যে তাঁর দখল নিয়ে নেয়। নেহারুল প্রাণপণে চেষ্টা করেন জেগে থাকতে, কিন্তু একটা নিশ্চিন্ত তন্দ্রা তাঁর পেশীকে গ্রাস করে একটু একটু করে চোখের পাতার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।
শহীদুলকে ইমার্জেন্সি থেকে চলে যাওয়ার ইশারা করে ছোকরা ডাক্তার, সে দ্বিধাভরা চোখে নেহারুলের স্তিমিত চোখের দিকে তাকায়। নেহারুল দেখতে পান, মাঝবয়সী এক ডাক্তার হনহন করে এগিয়ে আসছেন খাটিয়ার দিকে।
শহীদুলকে হাঁকিয়ে দিয়ে অন কলে থাকা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার লাহাব বলেন, "পেশেন্টের কী অবস্থা বজলু?"
মেডিক্যাল অফিসার বজলু আড়চোখে নেহারুলের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে ডাক্তার লাহাবকে বলে, "স্যার, বুঝতে পারছি না।"
নেহারুল শরীর ও মনের সকল শক্তিকে দুই কানে জড়ো করে এনে শুনতে পান, ডাক্তার লাহাব বলছেন, "ক্যান কী হইছে?"
বজলু নিম্নস্বরে কথা বলে, কিন্তু সব কথা যেন এক বিশাল চোঙের ভেতর দিয়ে বিবর্ধিত হয়ে নেহারুলের কানে প্রতিধ্বনিসহ আছড়ে পড়ে, "অসুখটা কমন পড়তেছে না স্যার। আপনি একটু দেখেন।"
নেহারুলের বিবশ শরীরে দুই ডাক্তারের স্টেথোস্কোপ পায়চারি করে কিছুক্ষণ। তারপর একটু কেশে ডাক্তার লাহাব বলেন, "আমারও কমন পড়তেছে না। একটু ফেসবুকে দ্যাখো দেখি, কোনো সাজেশন পাওয়া যায় কি না?"
বজলু অ্যাপ্রনের পকেট থেকে একটা বড়সড় স্মার্ট ফোন বের করে এনে ব্যস্ত হাতে ফেসবুক ঘাঁটতে থাকে। "কোন পেজে দেখমু স্যার? "ঐ ডাক্তার ছেড়ি স্টেথো গলায় না দিয়া বুকে দে কামে দিবো", এইটাতে কি পামু?"
ডাক্তার লাহাব বিরক্ত হয়ে বলেন, "এইসব বালছাল পেজে কি অসুখের সাজেশন পাইবা নাকি? একটা গ্রুপ আছে না, "বুক থাকলে ব্যথা থাকবে", যেইখানে সব কার্ডিও সাজেশন পাওয়া যায়? ঐটাতে দেখো।"
বজলু লজ্জিত মুখে ফোনে আঙুল চালিয়ে বলে, "সরি স্যার, আমি মনে হয় ঐ গ্রুপটায় মেম্বার না। মেম্বার ছাড়া আর কাউরে সাজেশন দেখতে দেয় না।"
লাহাব বজলুর গাধামোতে বিরক্ত হয়ে নেহারুলের দিকে তাকান। নেহারুল কিছু একটা বলতে চেষ্টা করেন, কিন্তু তাঁর সব কথা আটকে থাকে বুকের ভেতর। বুকের ভেতরের ব্যথাটা এবার যেন বুক চিরে বেরিয়ে এসে তাঁর বুকের ওপর বসে হাসতে হাসতে বলে, এই ছেলেগুলো বছর দশেক আগে ফেসবুক থেকে, ফোটোকপির দোকান থেকে, নোটবইয়ের দোকান থেকে খামের ভেতরে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্ন আগাম পেয়ে পরীক্ষায় বসেছে, জিপিএ ফাইভ পেয়ে পরীক্ষায় পাশ করে ডাক্তারি পড়তে ঢুকেছে। প্রশ্ন ফাঁসের চারাগাছ তারপর আস্তে আস্তে শিক্ষাবোর্ডের দেয়াল টপকে ঢুকে পড়েছে প্রকৌশলীর ষান্মাসিকের চূড়ান্ত পরীক্ষায়, ডাক্তারের আইটেম আর কার্ডে, আইনজীবীর বার প্রবেশের মৌখিকে। ওরাই এখন পাশ করে এসে দেশটার হাল ধরেছে। "সাজেশন"ডাকনামে সমাদৃত ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্র ছাড়া ওরা কোনো সমাধান করতে শেখেনি।
গোড়ার দিকটায় অনেকে হাউকাউ করেছিলো বটে, নেহারুল সাংবাদিকের ক্যামেরার সামনে বুক টানটান করে মিষ্টি হেসে বলেছেন, সবই অপপ্রচার। সরকারের বিরুদ্ধে একটি মহল চক্রান্ত করছে। গুজবে কান দেবেন না।
প্রশ্ন ফাঁসের সব অভিযোগকে নেহারুল নিপুণ হাতে ঝাড়ু দিয়ে পাপোষের নিচে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সারা দেশে সবাই তাঁকে ভদ্রলোক হিসাবে চেনে বলে তেমন শোরগোল ওঠেনি।
আহা, তখন তাঁর গদি ছিলো। ছিলো এপিএস, এসএসএফ আর সিঙ্গাপুর।
নেহারুলের বুকের ভেতরে ঘড়ঘড় শব্দ হয়, যেন পাপোষের নিচ থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বাতাসকে নিজের নাম শোনাতে চায় ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্রের স্তুপ। লাহাব বজলুর দিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেন, "মনে হয় বাঁচাইতে পারলাম না। দোয়া ইউনূস পড়তে কই, খাড়াও।"
নেহারুল চিৎকার করে বলতে চান, আমাকে খাকি হাসপাতালে নিয়ে যাও, সিঙ্গাপুরের টিকেট কাটতে বলো শহীদুলকে, ডালিয়াকে দেশে ফিরে আসতে বলো। কিন্তু কোনো কথা বেরোয় না তাঁর মুখ দিয়ে। ব্যথাটা শুধু মিটিমিটি হেসে তাঁর গলা টিপে ধরে চোখে চোখ রেখে বলে, সব অপপ্রচার।
ডাক্তার লাহাব আলামিন তালুকদারের মতো বিনীত হেসে বলে, "কিচ্ছু চিন্তা কইরেন না। কোনো সমেস্যা হইতো না। দোয়া ইউনূস পড়েন।"
শ্বাসনালীতে ব্যথার মুঠি শক্ত হয়ে আসে, নেহারুলের কানে সমুদ্রের ডাক আরো ঘনীভূত হয়। দোয়া ইউনূস মনে নেই তাঁর। হয়তো ফেসবুকের কোনো পেজে দোয়া ইউনূসের সাজেশন পাওয়া যাবে? আইপ্যাডটা হাতের কাছে থাকলে তিনি খুঁজে দেখতে পারতেন। তাঁর ছোটো মেয়ে গত জন্মদিনে কিনে পাঠিয়েছিলো, অবসরে ফেসবুকে নাতনির ছবি দেখার জন্যে। সাথে ছোট্টো একটা চিরকুটে লিখে দিয়েছিলো, বাবা, এখন আর বাবুর ছবি দেখার জন্য তোমাকে সেক্রেটারি ডেকে ল্যাপটপ খোলাতে হবে না। ট্যাবলেট পাঠালাম, পকেটে রাখবা। আল্লাহ হাফেজ।
নেহারুল শক্তির শেষ সঞ্চিতি ভেঙে ডাক্তার লাহাবকে বলেন, "ট্যাবলেট, আমার ট্যাবলেট ...?"
ডাক্তার লাহাব নিথর নেহারুলের গলায় আঙুল ঠেসে ধরে পালস পরখ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে দার্শনিকের বিষণ্ণতা নিয়ে মেডিক্যাল অফিসার বজলুকে বলেন, "ট্যাবলেট দিয়া কি আর সব রোগের চিকিৎসা হয়?"

পাঠ্যক্রমে নতুন ঢঙে ইতিহাস পড়ানো হোক

$
0
0
সপ্তম শ্রেণীতে যখন পড়ি, ছোটোখাটো এক বিষণ্ণ চেহারার শিক্ষিকা এলেন আমাদের ক্লাসে। আমরা নতুন এই ম্যাডামকে খালি হাতে ক্লাসে ঢুকতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, একটু নিরাপদে বিটকেলপনা করা যাবে, এ-ই ভেবে। সেই ভুলজন্মা স্বস্তি মিনিট পাঁচেক স্থায়ী ছিলো। ম্যাডাম নিচু গলায় জানালেন, তাঁর নাম মিসেস ত্রিবেদী। তাঁর পূর্বপুরুষ তিনটি বেদ কণ্ঠস্থ করেছিলেন বলে তাঁদের এই পদবী। তারপর তিনি চেশায়ার বেড়ালের মতো হাসিমুখে আমাদের বললেন, আমার পূর্বপুরুষ যদি তিনটি বেদ মুখস্থ করতে পারেন, তোমরা সমাজ বিজ্ঞান বইয়ের এক পাতা মুখস্থ করতে পারবে না কেন? রোজ এক পাতা করে মুখস্থ করে আসবে বাড়ি থেকে। ক্লাসে আমি পড়া ধরবো। যে পারবে না তাকে বেতের বাড়ি খেতে হবে।
এরপর দপ্তরী দাঁত বের করে হাসতে হাসতে প্রকাণ্ড এক বেত নিয়ে আমাদের ক্লাসে ঢুকলো। সেই বেতের উচ্চতা মিসেস ত্রিবেদীর সমান, প্রস্থে আমাদের একেকজনের হাতের বুড়ো আঙুলের মতো। মিসেস ত্রিবেদী বেতটা নিয়ে বাতাসে সপাং করে একটা শব্দ করলেন, আমরা বহু কষ্টে প্যান্ট শুষ্ক রেখে ক্লাসটা কোনোমতে পার করলাম।
এরপর বছরভর সমাজ বিজ্ঞান বইয়ের এক এক পাতা করে আমাদের মুখস্থ করতে হয়েছে। আমি জীবনে একবারই ত্রিবেদী ম্যাডামের ধোলাই খেয়েছিলাম। তিনি দুঃখিত চিত্তে বলেছিলেন, তুমি তো অন্যদিন পারো, আজকে পারলে না কেন? আমি অন্যদিন পারি বলে সেদিন আমাকে ছাড় দেননি, লোকে যেভাবে অন্য লোকের গরুকে পিটিয়ে ক্ষেত থেকে তাড়ায়, সেভাবে পিটিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে গোসল করতে গিয়ে দেখি আমার বাহু আর কাঁধে বেতের চাকা চাকা দাগ হয়ে আছে।
ক্লাস সেভেনে সমাজ বিজ্ঞানের একটা বিরাট অংশ ছিলো ইতিহাস। বখতিয়ার খিলজির পর হোসেনশাহী, তারপর মোগল আমল, তারপর ইংরেজ আমল নিয়ে পাতার পর পাতা সাল আর নামে কণ্টকিত তখনকার আমার চোখে নিরর্থক সব কথাবার্তা দিয়ে বইটা বোঝাই ছিলো। আলাউদ্দিন হোসেন শাহের পাতা মুখস্থ করার কয়েকদিন পর আবার ওয়ারেন হেস্টিংসের পাতা মুখস্থ করতে হতো, ততোদিনে আলাউদ্দিন হোসেন শাহের কিছুই আমার আর মনে নেই। সেটাও সমস্যা ছিলো না। কিন্তু সমাজ বিজ্ঞান বইয়ের ঐ নীরস, বিশুষ্ক তথ্যে ঠাসা লেখার ধরনের জন্যেই হোক, কিংবা মিসেস ত্রিবেদীর গরুপেটা ধোলাইয়ের কারণেই হোক, এই ইতিহাসের ওপর আমার মনে একটা মর্মান্তিক বিরাগ জন্মায়। আমাদের স্কুলে অন্যান্য ম্যাডামরাও ক্লাস সেভেনের পর বছরখানেক সমাজ বিজ্ঞান পড়িয়েছিলেন, তাঁরা অনেক স্নেহ নিয়ে পড়ালেও আমরা সাধারণত ঐ একটা ঘণ্টা হট্টগোল করে কাটিয়ে দিতাম।
ক্লাস সিক্সে বিজ্ঞান বইতে পড়েছিলাম, এনোফিলিস মশা ভূমির সাথে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ করে বসে, আর কিউলেক্স মশা বসে ভূমির সাথে সমান্তরাল হয়ে। দুই যুগ আগে পড়া এই তথ্য এর পর একবারও পুনরাবৃত্ত হয়নি লেখাপড়ার কোনো কাজে, তারপরও, এখনও মনে আছে, কারণ অনেক বিস্ময় নিয়ে তখন ক্লাসে বসে ভাবছিলাম, যারা বই লেখে, তারা কীভাবে এই কোণটা মাপলো? মশাগুলো কি চুপচাপ বসে থেকে চাঁদা দিয়ে কোণ মাপা বরদাশত করেছিলো? মতিকণ্ঠের ভাষায় সংক্ষেপে বলতে গেলে, "কায়দাটা কী"? এই প্রশ্নের সম্ভাব্য সমাধান অনেক পরে ত্রিকোণমিতি শেখার পর নিজে ভেবে বের করেছিলাম, কিন্তু এখন চিন্তা করলে মনে হয়, কোণ কীভাবে মাপা হয়েছিলো, সেটা বলা না থাকলেও বইটা একটা কাজের কাজ করতে পেরেছিলো, আমার মনে কৌতূহলটা জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলো, যেটা ঐ বয়সের ছাত্রছাত্রীদের জন্যে আবশ্যক।
অথচ সমাজ বিজ্ঞান বইতে পড়ার পর আরো বহুবার পড়েছি, কিন্তু আমার এখন মনে নেই, আলাউদ্দিন হোসেন শাহ কবে গদিতে বসেছিলো, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কবে হয়, কিংবা কোন লর্ডের পর কোন লর্ড ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় পদে সমাসীন ছিলো। এর পেছনে মিসেস ত্রিবেদীর লাঠ্যৌষধি পাঠদানের ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু তারচেয়ে বহুগুণে আছে এই ব্যাপারগুলো কীভাবে আমাদের পড়তে দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু সেই ক্লাস সেভেনেরও আগে সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত কিশোর ক্লাসিকের নানা গল্প, যেগুলোতে মূলত ইতিহাসের গল্পই বলা হয়েছে, সেগুলো কিন্তু মনে গেঁথে ছিলো বহুদিন। থ্রি মাস্কেটিয়ার্স কিংবা আ টেল অব টু সিটিজ সাগ্রহে পড়ে গেছি, কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংসের শাসনামল নিয়ে পড়তে গিয়ে ভীষণ বিরক্ত লেগেছে। এমন কেন হয়েছিলো?
এমনকি গরুও ঘাসের সেলুলোজ একা একা হজম করতে পারে না। তার জন্যে তাকে নিজের পেটে জীবাণু পালতে হয়। সেই জীবাণুরা সেলুলোজ ভেঙে গরুকে বাঁচায়, আমরাও দুধ আইসক্রিম ইত্যাদি খাওয়ার সুযোগ পাই। আমাদের পাঠ্যক্রমের ইতিহাস বইগুলো এমনভাবে লেখা, যেন গরুর বদলে মানুষকে ঘাস খেতে দেওয়া হচ্ছে। এখন কী অবস্থা, আমি জানি না, কিন্তু এখনকার ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে এতে খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়নি। আমাদের পাঠ্যবইগুলো যাঁরা লেখেন, তারা ছাত্রছাত্রীদের প্রতি কতোটা সদয়, এ নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।
ওয়ারেন হেস্টিংসীয় ইতিহাসের প্রতি আমার বিরাগমোচন (রাগমোচনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না) ঘটতে অনেক দেরি লেগেছিলো। সেটাও ঘটেছে গল্প উপন্যাসের হাত ধরে। বিনয়-বাদল-দীনেশের কাহিনী পড়ে দারুণ রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম, কিন্তু এঁদের গল্প আমাদের পাঠ্যবইতে আসেনি। আব্রাহাম ইরেইলির বইগুলো পড়ে ভারতবর্ষ বা মোগলদের ইতিহাস পড়ে যতোটা তৃপ্তি পাওয়া যায়, সমাজবিজ্ঞান বইতে তা পাইনি। কেন এমন হলো?
ইতিহাস তো আসলে গল্পই। কিন্তু সে গল্প কাকে বলা হচ্ছে, সেটা গল্প বলার সময় মাথায় থাকতে হবে। এগারো বছরের বাচ্চাদের এতো শয়ে শয়ে নাম আর সাল গরুপেটা করে মুখস্থ করানোর নাম কেন শিক্ষাদান হবে? এটা তো নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে।
সমাজ বিজ্ঞানে লেখা ইতিহাস পড়ে খুব বেশি কৌতূহল জাগেনি মনে। মনে হয়েছিলো, ঐ লোকগুলো কেবল আমাদের নির্যাতন করার জন্যই প্রতি দশ বছর পর পর ১৪৫০, ১৬৮০, ১৭৭০, এরকম মুখস্থবান্ধব সালে ক্ষমতা না ছেড়ে মাঝামাঝি নানা বছরে গদি ছেড়েছে। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তার ছেলেকে ক্ষমতাই যখন দেবে, কেন তার নাম আমাদের কথা বিবেচনা করে সালাউদ্দিন হোসেন শাহ রাখেনি, সেটা নিয়েও একটু চাপা অনুযোগ ছিলো আমাদের মধ্যে। হেস্টিংস, ডালহৌসি, ক্যানিং, মিন্টো, রিপন, লিটন হাবিজাবি নামগুলোকে মনে হয়েছে এদের বাবামায়ের বিটকেলপনা। আর এতো নাম আর সাল মুখস্থ করে এসে নিজের দেশের নিকট ইতিহাস পড়তে গেলে আরো আটকে যেতে হতো, কারণ সেগুলোও অনেক একঘেয়েভাবে লেখা ছিলো। এখনকার ছাত্রছাত্রীরা অভিযোগ করে, ১৯৭১ এর পর কীভাবে কী হলো, সেটা তারা জানতে চায়, কিন্তু ভালো বই নেই।
ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করা এক জিনিস, আর কিশোরপাঠ্য ইতিহাস লিখতে পারা আরেক জিনিস। আমাদের এতো শয়ে শয়ে নাম মুখস্থ না করিয়ে যদি কৌতূহলের চাবিটা তুলে দেওয়া হতো, তাহলে ইতিহাস মুখস্থ করার বদলে আমরা ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী হতে শিখতাম। হয়তো ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার কী কী ক্ষতি করে গেছে, নিজেরাই এ বই ও বই টুকে খোঁজ করার চেষ্টা করতাম, যদি শুধু আমাদের শিক্ষকেরা কৌতূহলী হতে শেখাতেন। এখনও তো বাচ্চাদের প্রকাণ্ড ভারি বোঝা নিয়ে স্কুলে-কোচিঙে-টিউটরের কাছে হানা দিয়ে অনেক কিছু গলাধকরণ করতে হয়, কিন্তু চিন্তা করে দেখুন, কোনটা জরুরি? এই তথ্যগুলো মুখস্থ করানো, নাকি তথ্যগুলো নিয়ে তাদের চমৎকৃত হতে শেখানো?
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে জড়িত খুব চতুর কোনো লোক, কিংবা একাধিক লোক, আলগোছে একটা পুরো জাতিকে নিজেদের ইতিহাস নিয়ে নির্লিপ্ত, এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বীতশ্রদ্ধ বানানোর পথ খুঁজে পেয়েছে আমাদের দেশে। আমাদের ইংরেজি আর আরবি মাধ্যমের ছেলেমেয়েরা দেশের ইতিহাস কতোটুকু কীভাবে জানে, আমি জানি না। বাংলা মাধ্যমে আমি লেখাপড়া করে এসেছি, শুধু পাঠ্যবই দিয়ে ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ জাগানো আমার মতো বইপড়ুয়ার জন্যেও ছিলো না। এটা কি কেবল গ্রন্থরচয়িতাদের অবহেলায় হয়েছে, নাকি পরিকল্পিত ছকেই?
ইতিহাস জানতে হয় নিজেকে চিনে নেওয়ার জন্যে। আজ থেকে শয়ে শয়ে বছর আগে কোন রাজার পর কোন নবাব গদি দখল করেছিলো, সেই সাল আর নাম মুখস্থ করার চেয়েও বেশি জরুরি, আমাদের সমাজটা কীভাবে সেই রাজা-নবাবদের হাতে পড়ে নিজের চেহারা পাল্টেছে। কেন আলীবর্দি খাঁয়ের চেয়ে সিরাজউদ্দৌলার শাসন খারাপ ছিলো, ওয়ারেন হেস্টিংসের হাতে পড়ে সেটা আরো খারাপ কীভাবে হলো?
আমরা শৈশব-কৈশোরে, কিংবা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও, বর্তমানকে মানদণ্ড হিসেবে ধরে নিই। কিন্তু বর্তমান যে একটা দীর্ঘ প্রবাহের ফল, সেটা বুঝতে আমাদের অনেক সময় লেগে যায়। প্রবাহটাকে বুঝতে না পারলে জাতি হিসেবে আমাদের গন্তব্য কোথায়, সেটাও ধরতে আমাদের বেগ পেতে হয়। এই ধরতে পারাটা কেবল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির কাজ নয়, এটা সামষ্টিকভাবে ধরতে শিখতে হবে, কারণ আমাদের গন্তব্যও কমবেশি সামষ্টিক।
আজ আমরা বুড়িগঙ্গার দূষণ দেখে নাক কোঁচকাই, কিন্তু যে কিশোরটি বুড়িগঙ্গার অদূষিত চেহারা দেখেনি, তাকে কীভাবে এই দূষণের খারাপ দিকগুলো বোঝাবো আমরা? বোঝাতে গেলে আমাদের ইতিহাস শিক্ষায় ফিরে যেতে হবে। শিক্ষার এই গুরুত্বপূর্ণ শাখাটিকে আমরা এমন তথ্যকণ্টকিত করে রেখেছি, যে ইতিহাস শেখানো মানে যে গল্প বলা, সেটাও আমরা বিস্মৃত হয়েছি।
ইতিহাস মানে অসংখ্য রোমাঞ্চকর গল্পেরও সমষ্টি। আমাদের কিশোর-কিশোরীদের কথা চিন্তা করে নতুন ঢঙে ইতিহাস পড়ানো শুরু হোক। তথ্যের কাঁটায় তাদের ঝাঁঝরা না করে, কৌতূহলের চাবিটা তাদের হাতে ধরিয়ে দিন। ক্লাস শেষে ইতিহাসের গল্প নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের লেখা নাটক মঞ্চায়িত হোক, ছাত্রছাত্রীরা নিজেরা বই ঘেঁটে নিজেদের পছন্দসই ঐতিহাসিক চরিত্রের ওপর প্রবন্ধ লিখতে শিখুক, ইতিহাসের পরিণতি কীভাবে ভিন্ন হতে পারতো, তা নিয়ে বিতর্ক হোক।
মিসেস ত্রিবেদী বেঁচে আছেন কি না জানি না। যদি তিনি বেঁচে থাকেন, আর এই লেখা তাঁর কাছে কোনোভাবে পৌঁছায়, তাহলে তাঁকে বলতে চাই, আমি নিশ্চিত, তিনি তাঁর নাতি-নাতনিদের ছুটির দুপুরে অনেক আদর করে পুরাণ আর ইতিহাসের নানা গল্প শোনান, তাদের গায়ে মারের দাগও নেই। আপনার বেতের বাড়ি আমার কোনো উপকারে আসেনি ম্যাডাম। এখন রজার ক্রাউলির লেখা ইতিহাসের ওপর চমৎকার একটা বই "সিটি অব ফরচুনস"পড়ছি, আর চিন্তা করছি, আপনার মতো আরো কতো শিক্ষক-শিক্ষিকা কতো ছেলেমেয়েকে ইতিহাস থেকে বেতিয়ে বিমুখ করেছেন। আপনি যে বইয়ের পাতা মুখস্থ করাতেন, সে বইয়ের লেখকদের সঙ্গে নিয়ে আপনার মতো মানুষগুলো অবসর নিয়ে শিক্ষাঙ্গন থেকে দূর হয়ে যাক। ভালো থাকবেন।

হার্ডওয়্যার আর সফটওয়্যার

$
0
0
নীড় সন্ধানীর সাম্প্রতিক পোস্টে চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিয়ে দুর্ভোগের পেছনে নগরবাসীর আচরণ যে একটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, সে কথা উঠে এসেছে। এই পোস্টটা পড়ার আগে পৃথ্বী শামসের অনুবাদে নোম চমস্কির একটি সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। আমার এই পোস্টে লেখা ভাবনা উসকে দিয়েছে মূলত এই দুটি পোস্টের আধেয়।
আসল প্যাচাল পাড়ার আগে চমস্কি কী বলছেন একটু পড়ি।
আমাদের মনে রাখা উচিত যে সমাজ বিশ্লেষণ এমন কোন কর্ম না যা বিশেষজ্ঞদের হাতে ন্যস্ত রেখে আমাদের নিশ্চিন্ত থাকতে হবে। বুদ্ধিজীবিরা আমাদের এটাই বিশ্বাস করাতে চায় যে তারা এমন এক কর্মে প্রবৃত্ত যা জনসাধারণের কাছে দুর্বোধ্য। কিন্তু সামাজিক বিজ্ঞান এবং সমসাময়িক ঘটনাবলি অধ্যায়ন আসলে মোটেই জটিল কিছু না, কারো এসব বিষয়ে আগ্রহ থাকলে সে নিজেই এগুলোতে সিদ্ধহস্ত হতে পারে। এসব বিষয়কে অযাচিতভাবে “জটিল” হিসেবে উপস্থাপন করে বুদ্ধিজীবিরা আসলে জনসাধারণকে ননির পুতুল বানিয়ে রাখতে চায় যাতে সাধারণ মানুষ এসব মধ্যস্থতাকারীদের সহায়তা ব্যতিরেকে সমাজকে উপলদ্ধি করতে নিজেদেরকে অক্ষম মনে করে। একারণে সমাজবিশ্লেষণকে বৈজ্ঞানিক কার্যক্রমের সাথে তুলনা করার ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে, কারণ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আসলেই কোন কিছু বিশ্লেষণের পূর্বে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে একটি সুবিশেষ বৌদ্ধিক কাঠামো আয়ত্ত করতে হয়।
এই বাক্যগুলোতে যদি সমাজ বিশ্লেষণের জায়গায় নাগরিক জীবনের সমস্যা সমাধানের কথা বসাই, তাহলেও কি তা গ্রহণযোগ্য থাকবে? চট্টগ্রামের মতো পাহাড়ি শহর যে বর্ষার জলে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে, সে সমস্যার সমাধান কি ক্ষমতাবান কতিপয়তন্ত্রের মর্জিমাফিক আসবে, নাকি নাগরিকের এতে অংশগ্রহণের সুযোগ আছে? সমস্যাগুলো কি এতোই দুর্বোধ্য যে আমাদের নিজেদের সক্রিয় অংশগ্রহণে তার সমাধান সম্ভব নয়?
আরেকটু ভাবতে গিয়ে মনে হলো, আমাদের সামাজিক সমস্যাগুলোকে আমরা নাগরিকের সামষ্টিক অংশগ্রহণের সুযোগ নেই, এমন "হার্ডওয়্যার"দিয়ে সমাধানের ব্যাপারে খুব বেশি উৎসুক (যদিও এসব হার্ডওয়্যার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নাগরিকের সামষ্টিক ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়)। সে তুলনায় নাগরিকের অংশগ্রহণসাপেক্ষ "সফটওয়্যার"দিয়ে সমাধানের ব্যাপারে আমাদের সামষ্টিক আগ্রহ কম। এখানে হার্ডওয়্যার বলতে বোঝাচ্ছি অবকাঠামো বা বস্তুকেন্দ্রিক আয়োজন, আর সফটওয়্যার বলতে বোঝাচ্ছি আচরণ বা বিধি।
প্রসঙ্গ পাল্টাই। বনানীতে পথচারীরা রাস্তা পার হবেন, সেজন্যে বিপুল টাকা খরচ করে ফুটওভার ব্রিজে বিদ্যুৎচালিত সিঁড়ি বসানো হয়েছে। কিন্তু পথচারীরা আগের মতোই নির্বিকার চিত্তে রাস্তার ওপর দিয়েই পার হচ্ছেন, ফুটওভার ব্রিজ ছুঁয়েও দেখছেন না। দুর্ঘটনা এড়াতে আর যানজট কমাতে ঢাকা নগর কর্তৃপক্ষ এখানে বিপুল ব্যয় করে "হার্ডওয়্যার"দিয়ে একটি সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছেন। কিন্তু সেই হার্ডওয়্যারের সাথে মানানসই সফটওয়্যার নাগরিকের মাঝে অনুপস্থিত। মনে করুন আপনার ফোনে ক্যামেরা আছে, কিন্তু ছবি তোলার জন্যে কোনো প্রোগ্রাম নেই। তখন সেই ক্যামেরা বাহুল্য ছাড়া আর কিছু নয়। তখন হয় আপনাকে ছবি তোলার প্রোগ্রামসহ ফোন কিনতে হবে, নয়তো ক্যামেরায় ছবি তোলার লাগসই প্রোগ্রাম গুঁজে দিতে হবে। আমরা চাইলেই আমাদের নাগরিকসমষ্টিকে বদলে পৌরকাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ভিন্ন নাগরিকসমষ্টি আমদানি করতে পারবো না। কাজেই নাগরিকের মধ্যে নগরজীবনের প্রাত্যহিক হার্ডওয়্যারগুলোর সাথে মানানসই "সফটওয়্যার"ইনস্টল করতে হবে।
এই কাজটা মূলত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের। আর ঐ সফটওয়্যারকে আমরা মোটাদাগে "শিক্ষা"বলে ডাকি।
এই উপলব্ধি খুব কঠিন কিছু নয় যে আমাদের সাম্প্রতিক জীবন আর আমাদের পাঠ্যক্রমের শিক্ষার মধ্যে বড়সড় দূরত্ব আছে। আমরা স্কুলকলেজে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও গণিত, ভাষা ও ইতিহাস, ভূগোল ও ধর্ম, হিসাব-কৃষি-গার্হস্থ্য বিষয়াদি নিয়ে কিছু পল্লবগ্রাহী কাজকর্ম করি, তারপর শিক্ষার জোর পরিমাপ করি কিছু প্রান্তিক পরীক্ষার ফল দিয়ে। সকল বিষয়ে এ প্লাস পাওয়া কোনো ছাত্র যদি ফুটপাথের ওপর থুথু ফেলে, কিংবা কোনো দেয়ালের সামনে জিপার খুলে পিশু করা শুরু করে, তখনই কেবল বোঝা যায়, আমাদের সফটওয়্যার আপডেট করা প্রয়োজন।
অন্যের বাড়ির দরজার সামনে ইঁট-বালু-রড স্তুপ করে নিজের বাড়ি বানানো, গলির মুখে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা, গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে ছাদে প্যাণ্ডেল টাঙিয়ে রাত তিনটা পর্যন্ত বীভৎস শোরগোল করা, রমজানে গায়ে পড়ে সেহরির সময় অচেনা লোককে বিনা অনুমতিতে ডেকে তোলা, এরকম আরো বহু প্রত্যক্ষ ভোগান্তির অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমরা এখনও নগর ও অপর নাগরিকের সাথে সম্পূর্ণ"কম্প্যাটিবল"নই। একটা গোল গর্তে একটা চৌকোণা জিনিস গায়ের জোরে ঢোকানোই আমাদের প্রতিদিনের নাগরিক অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মাঝের ফাঁকগুলো আমরা "হার্ডওয়্যার"দিয়ে পূরণ করার চেষ্টা করছি, যেটা দেখিয়ে আমরা একে অন্যকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চাই। এই অযথা হার্ডওয়্যারের পেছনে যে টাকাগুলো নাগরিকের পকেট থেকেই বের হয়, সেগুলো ঘুরে ফিরে গদিঘনিষ্ঠ ঠিকাদারদের পকেটে ঢোকে, তাই হার্ডওয়্যারের অপ্রয়োজনীয়তা নিয়েও খুব বেশি কথা ওঠে না।
প্রান্তিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে কিছুদিন আগে যে শোরগোল হয়ে গেলো, সেখানে মুহম্মদ জাফর ইকবাল আর ড. আনোয়ার হোসেন ছাড়া কাউকে উচ্চগ্রামে কিছু বলতে দেখিনি। ষোলো কোটি মানুষের দেশে আমরা পনেরো কোটি নিরানব্বই লক্ষ নিরানব্বই হাজার নয়শো আটানব্বই জন মানুষ চুপ করে ছিলাম এই ভেবে, যে আমাদের সমস্যা নিয়ে কেবল এই দুটি লোক কথা বলবেন। এই দুজন মানুষই আমাদের গোল গর্তে ঢোকানো চারকোণা জিনিসটার চারপাশের ফাঁক বোঁজানোর জন্য চুনমশলা। এ থেকে বোঝা যায়, আমাদের হাতে যদি সফটওয়্যার থেকেও থাকে, সে সফটওয়্যার আমরা চালাচ্ছি না, অপর ব্যক্তি এসে আমাদের সমস্যার সমাধান করে দেবেন, সেই দুরাশায়। ঠিক যেমন করে আত্মীয়ের অসুখের সময় আমরা রক্ত খুঁজি, কিন্তু নিজেরা রক্ত দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসি না।
চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা যেমন শুধু গভীর নালা আর খাল খননের হার্ডওয়্যার দিয়ে সমাধান করা যাবে না, তেমনি বনানী মোড়েও বিদ্যুৎচালিত সিঁড়ির হার্ডওয়্যার দিয়ে পথচারী পারাপারের সমস্যা সমাধান করা যাবে না। কোটি টাকার নালা বোঁজানোর জন্য আড়াই টাকার চিপসের প্যাকেটই যথেষ্ট। হার্ডওয়্যারের সাথে আমাদের মানানসই "সফটওয়্যার"লাগবে। এই সফটওয়্যার হতে পারে নাগরিক আচরণবিধি, হতে পারে স্কুলে স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের জন্যে পৃথক "নাগরিক সচেতনতা"ক্লাসের শিক্ষা ও বাড়ির কাজ, হতে পারে উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম, কিন্তু তা কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে এসে করতে হবে। প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষের আওতাধীন সকল প্রতিষ্ঠানকে নিজ উদ্যোগে এ ধরনের "সফটওয়্যার আপডেট"-এর ব্যবস্থা করতে হবে। নাগরিক সমস্যা সমাধানের জন্যে স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যেই চিন্তা ও কর্মে চর্চা চালু করতে হবে দ্রুততম সময়ে, যাতে তাদের প্রজন্ম আমাদের প্রজন্মের চেয়ে এগিয়ে থাকে। কেবল ইঁট-বালু-সুড়কি-রড-সিমেন্ট-ঠিকাদারি দিয়ে সমস্যার সমাধানে নাগরিককে বিচ্ছিন্ন রেখে নয়, নাগরিকের আচরণ দিয়ে নাগরিকের অংশগ্রহণে নাগরিক জীবনের সমস্যার সমাধান করা শিখতে আর শেখাতে হবে। এ ব্যাপারে যারা সামাজিক চাপ প্রয়োগ করার সামর্থ্য রাখেন, তারা মুখ খুলুন, অনেক বিলম্ব ঘটার আগেই।

নরকের দারোয়ান

$
0
0
খালিদ টেবিলের ওপরে হাসিমুখ ধরে রেখে টেবিলের নিচে আমার পায়ে একটা লাথি মারলো। বিশ্বকাপের সিজনের কারণেই হয়তো লাথিটাতে প্রয়োজনের চেয়ে বাড়তি বিষ ছিলো।
ভদ্রলোক ভুরু ওপরে তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "কী হইলো?"
আমি শার্টের হাতায় চোখের কোণ মুছলাম, খালিদ স্কুলে শেখা প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব শব্দটাকে আবার মনে করিয়ে দিয়ে বললো, "উফফ, মশা!"
ভদ্রলোক আবার সোৎসাহে শুরু করলেন। তিনি অভিজ্ঞ মানুষ, দুনিয়ার হেন কোণাকাঞ্চি নাই যেখানে তিনি যান নাই, মশার কামড়ে দুনিয়াতে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ কেঁদে ফেলে।
খালিদ আমাকে কথায় কথায় বলদ ডাকলেও আমি আসলে সরল মানুষ। অনেক কিছুই না বুঝে বলে ফেলি, কিংবা বলার আগে অগ্রপশ্চাৎ ভাবি কম। আমাদের টেবিলে বসা ভদ্রলোককে তাই আঙ্কেল ডেকে বসেছিলাম শুরুতে। তিনি যে সেটা ভালোভাবে নেননি, সেটা বুঝতে সময় লেগেছে একটু। হাত ধুতে যখন উঠেছিলেন তিনি, তখন খালিদ আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলেছিলো, আঙ্কেল আবার কী? ভাইয়া বলতে পারিস না?
আমি মিনমিন করে বলেছিলাম, চাচার বয়সী লোক ...।
খালিদ বিরক্ত হয়ে ছ্যাক করে একটা শব্দ করে বলেছিলো, ওনার ওয়াইফকে ভাবী ডাকি আমরা। কাজেই উনি ভাইয়া। আবার আঙ্কেল ডাকলে লাত্থি খাবি। আর কথা না বলে চুপ থাক। বলদ কোথাকার।
খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ভদ্রলোকের কথা শুনতে থাকি। পায়ের হাড়ে লাথির ব্যথাটা আস্তে আস্তে ফেসবুকের বাসি হুজুগের মতো স্তিমিত হয়ে আসে।
"... বেলা শেষে সবই হইতেছে গিয়া সেতুর নিচে পানি, ওয়াটার আন্ডার দ্য ব্রিজ।"বোরহানির আগাম জগ থেকে গ্লাসে সামান্য একটু ঢেলে শুঁকতে শুঁকতে বললেন ভাবীস্বামী আঙ্কেল। "কী ব্যাপার, পুদিনা ছাড়াই কি বোরহানি বানাইয়া ফালাইছে নাকি? কোনো ধক নাই!"
খালিদ সায় দেয়। ওর মতলবটা ধরতে পারি না। তবে বুঝতে পারি কোনো একটা মতলব তার আছে। লোকজনের কথায় সায় দিয়ে সে সহজে কিছু বলতে চায় না।
আঙ্কেলমুখো ভাই বলেন, "কিন্তু বুঝলা তোমরা, সেদিন আমি বার্মা গেছিলাম একটা জরুরি কামে। ... না না, আমার এনজিওর কোনো অপারেশন নাই বার্মায়। এমনেই আরেকটা কামে গেছিলাম আর কি। ইয়ানগন এয়ারপোর্টে নামার পর কী হইলো শোনো। ইমিগ্রেশনের নাকচ্যাপ্টা এক হালায় আমারে জিগায়, ওহ, ইউ আর ফ্রম বদি'স কান্ট্রি?"
আমি বোরহানির গ্লাসে বোরহানি ঢালতে ঢালতে বলে ফেলি, "বদি কে?"
খালিদ আমাকে আবার মুখ খুলতে মিডফিল্ডারদের মতো আড়ে আড়ে তাকায়।
ভাই অবশ্য অসন্তুষ্ট হন না। বলেন, "আরে আসতেছি সেই কথায়। ... তো আমার গেলো মেজাজ খারাপ হইয়া। আমি কইলাম, ইয়েস, ইউ মিন বাংলাদেশ। আই অ্যাম ফ্রম বাংলাদেশ। হালায় চিঙ্কু তখন মিটমিট কইরা আমার দিকে চায়, কাগজপাতি ঘাঁটে আর ফ্যাকফ্যাক কইরা হাসে। চিন্তা কইরা দেখো ব্যাপারটা, কী তামশা?"
খালিদ বলে, "কঠিন তামশা।"
আমি বদিকে চিনি না বলে তামাশাটা কোথায়, ধরতে পারি না।
বেয়ারারা সারি বেঁধে সুরভিত পোলাওয়ের থালা নিয়ে হুড়মুড় করে টেবিলে টেবিলে ছুটতে থাকে। সেদিকে তাকিয়ে ভাই বলেন, "ঘটনা কিন্তু এইখানেই শেষ না। বরং এইখানে শুরু। এরপর মালয়েশিয়া গেলাম তোমাদের ভাবীরে নিয়া। বেড়াইতেই গেছিলাম, আবার একটু মেডিক্যাল চেকআপও করাইয়া আসলাম। মালয়েশিয়া, বুচ্ছো তো, অনেক উন্নত হইয়া গেছে। অনেক উন্নত। মাহাথির স্যারের মতো স্যার পাইলে আমাদের দেশটা যে কোনদিকে যাইতো ... কী আর কমু কও? সবই তো বুঝো, সবই তো জানো। এইসব গণতন্ত্র ফনতন্ত্র দিয়া আসলে দেশ সামনে আগাইতে পারে না। জবরদস্ত একজন ক্যাপ্টেন না থাকলে লঞ্চ চড়াতে ঠেকবোই ঠেকবো। আমার শালা খালি পাকনামি করে, কয় দ্যাহেন দুলাভাই, মাহাথির কিন্তু স্বৈরশাসক, তার আত্মীয়স্বজন ব্যাপক দুর্নীতি করছে। আমি তারে ঐদিন দিছি ধমক। কইলাম, চুদির ভাই তুই জানস কী। টাইটের উপর না রাখলে দেশ আউগায় নাকি? আর একলাই খাবি, ইষ্টিগো দিবি না?"
খালিদ মাথা দুলিয়ে বলে, "ট্রু, ট্রু।"
পোলাও চলে আসে, মুখ খুলতে সাহস না পেয়ে পাতে অল্প একটু পোলাও নিয়ে নাড়াচাড়া করি। ভদ্রলোক তখনই পাতের দিকে হাত বাড়ান না, অ্যাপল ফোনে কিছুক্ষণ আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করে আবার শুরু করেন, "মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশনেও এক হালায় আমারে জিগায়, ওহ, ইউ আর ফ্রম বদি'স কান্ট্রি? ... কী বুঝলা?"
আমি চিন্তা করতে যাই বলদের মতো, খালিদ চাল্লু মাল, সে এইসব ভাবনা চিন্তার দিকে না গিয়ে বোঝার কাজটা আবার ভাইয়ের পাতে ঠেলে দিয়ে বলে, "বুঝেন অবস্থা!"
ভাই নড়েচড়ে বসে বলেন, "আমি তো থান্ডারড! কিন্তু শেষমেশ তারে কইলাম, ইয়েস, ইউ মিন বাংলাদেশ। হালায় কিটিপিটি চায় আমাগো দিকে, পাসপোর্ট ছানে, আর খ্যাক খ্যাক হাসে। কী আর কমু, কও?"
রেজালার ঘ্রাণ ভেসে আসে নাকে। বেয়ারার দল সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট আর কালো বো টাইয়ের স্রোত হয়ে ভেসে আসে সাথে।
কিন্তু ভাই রোস্টের জন্য অপেক্ষা করেন। "এনজিওর কাম আমার, বুঝোই তো, দেশে বেশিদিন একটানা থাকতে পারি না। ডাইনে বামে যাইতে হয়। টার্কিশ এয়ারে গেছো কোনোদিন? যাও নাই? ইস্তাম্বুল শহরটা ঘুইরা দেখার একটা সুযোগ পাইবা গেলে। দারুণ শহর। আমি তো কাবাব খাইতে খাইতে হয়রান। কিন্তু ইমিগ্রেশনের লোকজনগুলি ছাক্কা মাদার... সরি। মুখ খারাপ হইয়া যায়। কিন্তু তোমরা তো ইয়ংম্যান। আমার পাসপোর্ট আটকাইয়া চেহারার লগে ছবি মিলায় আর একটা আরেকটারে কী কী জানি কয়। শেষমেশ আরেক কুতুব আইসা আমারে কোনোমতে ইংলিশে জিগায়, ওহ, ইউ আর ফ্রম বদি'স কান্ট্রি?"
খালিদ রোস্টের জন্য অপেক্ষা করে না, রেজালার বাটিতে চামচ চালাতে চালাতে বলে, "ভাই শুরু কইরা দিলাম, মনে কিছু নিয়েন না।"
ভাই মনে কিছু করেন না, রোস্টের থালা নিয়ে বেয়ারার স্রোত অনুকূলে চলে আসে।
আমি পোলাও দিয়ে গোগ্রাসে রেজালা সাঁটাতে থাকি। রোস্টের ওপর দিয়েই তুর্কি ইমিগ্রেশন অফিসারের জন্য বরাদ্দ ঝালটা ঝাড়েন ভাই। তারপর ধকল সামলে মিনিট পাঁচেক পর বলেন, "বুচ্ছো কী অবস্থা? আমি আর কী কমু। কইলাম, ইয়েস, ইউ মিন বাংলাদেশ। তিন মাদার... ঐ তো, বুচ্ছো তো, তিনজন একলগে খিলখিল কইরা হাসে। তাইলেই কও আমারে, দেশটা চলতেছে আসলে ক্যামনে?"
খালিদ গভীর সমবেদনা নিয়ে খায়।
ভদ্রলোক দ্রুত রোস্টের উল্লেখযোগ্য অংশ বিনাশ করে রেজালার বাটির দিকে অনিসন্ধিৎসু চোখ রাখেন, তারপর তুড়ি মেরে বেয়ারাকে ডাকেন। বাটিতে যা ছিলো তা আসলেই গুণীতোষ পরিমাণ নয়।
রেজালা শেষ করে রোস্টের দিকে হাত বাড়াই। খালিদও সময়টাকে নষ্ট না করে রেজালার বাটির অবশিষ্টাংশ পাতে নিয়ে বলে, "ভাই শেষ কইরা দিলাম, মনে কিছু নিয়েন না।"
একটা বেয়ারা রেজালার বাটি হাতে ভেসে আসে বন্ধু-বন্ধু-ভাব প্রেত ক্যাসপারের মতো। ভাই রেজালার বাটি থেকে দরাজ হাতে তিন ভাগ স্থল আর এক ভাগ জলে পাতের পোলাওকে ভারাক্রান্ত করে বলেন, "কিন্তু ঘটনা যদি এইখানেই শেষ হইতো, একটা কথা ছিলো। নাইজেরিয়া গেছিলাম সেদিন। আবুজাতে নামছি, সেই রকম কালা এক কালা আমারে ইমিগ্রেশনে আটকাইয়া কয়, ওহ, ইউ আর ফ্রম বদি'স কান্ট্রি?"
খালিদ অপেক্ষা করে আরো কিছু শোনার জন্য, না শুনতে পেয়ে বলে, "ভাই, সেইরম অবস্থা!"
তারপর অবশ্য ভাই চুপ করে যান। আরেকটু বোরহানি খান, আইসক্রিমের বাটিটাও যত্ন করে শেষ করেন। শেষমেশ আসা পানমশলার খিলিটা মুখে পুরে বলেন, "আমি হাত ধুইয়া আসি। তোমরা তো আমার বাসার ঐদিকেই যাইবা, নাকি? চলো আমার সাথে, আগাইয়া দিমুনি।"
খালিদ স্বস্তির শ্বাসটাকে গোপনে চোরের মতো ছাড়ে। এবার বুঝতে পারি তার জ্বিহুজুরির রহস্য। এতো রাতে সিয়েনজি পাওয়া মুশকিল এখানে।
ভাইয়ের আলিশান গাড়ির সামনের সিটে চড়ে বসে খালিদ, আমি চুপচাপ গ্রাম থেকে আসা আত্মীয়ের মতো গাড়ির পেছনের সিটে জড়োসড়ো হয়ে বসি। ভাই পাকা হাতে গাড়ি বের করে রাস্তায় নেমে বলেন, "কিন্তু ঘটনা কিন্তু শেষ হয় নাই। ঐদিন ম্যানচেস্টার গেছিলাম, তোমাদের ভাবীর বড় বোন থাকেন ঐখানে। হিথ্রো হইয়া যাইতে হয়, বুচ্ছো তো? হিথ্রোতে ধবধবা ফর্সা এক লম্বা চওড়া ইংরাজ সাহেব আমারে ইমিগ্রেশনে থামাইয়া সুন্দর একটা হাসি দিয়া কইলেন, সো মাইট, ইউ আর ফ্রম বদি'স কান্ট্রি? আমিও হাইসা কইলাম, ইয়েস, রাইট ইউ আর! চিন্তা করছো অবস্থাটা? কোথায় কোন চিপায় পইড়া রইছে আমাগো বাংলাদেশ, কিন্তু সাহেবরা ঠিকই খোঁজ খবর রাখে! এখন তোমরাই কও, এই বদি না থাকলে কি সে আমাগোরে চিনতো?"
আমি নিজেকে সময় মতো থামাতে পারি না, আবার বলে বসি, "বদি কে?"
এবার অবশ্য খালিদ রাগ করে না, বাড়ির পথে গাড়িতে চড়েই বসেছে যখন। সে-ও মধুর গলায় বোল তোলে, "হ ভাই, কোন বদি এইটা কন তো?"
ভাইয়ের চেহারা পেছনের আসন থেকে ঠিকমতো ঠাহর করতে পারি না অন্ধকারে, তিনি মধুমন্দ্র গলায় বলেন, "আরে দ্যাখো নাই, ঐ যে ঐদিন পুলিশ ধরছে ... পেপারে টিভিতে ফেসবুকে সবখানে নিউজ আসছে তো। সাংবাদিকরা, বুচ্ছো না, পাইছে এক চান্স, দিছে কোকেন সম্রাট বানাইয়া। কোকেন সম্রাট বদি।"
আমি ভেতরের বলদটাকে থামাতে না পেরে বলে ফেলি, "কোকেন সম্রাট বদিরে এতো দেশের লোকে চিনে?"
ভাই একটু যেন বিরক্ত হন, তিনি একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের সিটে বসা অন্ধকার আমাকে এক ঝলক দেখে নিয়ে বলেন, "একটা লোক, তারে সারা দুনিয়ার মানুষে চিনে, তারে দিয়া লোকে আমাদের দেশটারে চিনে, তারে তোমরা কোকেন সম্রাট বানাইয়া দিলা। আমারে যদি জিগাও, আমি কমু কামটা ঠিক হয় নাই। যেই দেশে গুণীর কদর নাই, সেই দেশে গুণী জন্মাইতে পারে না। আমাগো জাতিটাই খারাপ, বুচ্ছো?"
আমি খুব একটা চিন্তিত হই না অবশ্য, সামনের সিটে বসে খালিদ আমাকে লাথি মারতে পারবে না।
ভাই গাড়ি ঘুরিয়ে ভিআইপি সড়কে উল্টোবাগে চলতে চলতে বলেন, "আমার শালা একটা পাকনা, ইউনিভার্সিটিতে পড়ে তো, পাকনা কিছু ফাউলগো লগে ঘুরে, তারা যা কয় সে সেগুলিই সারা দিন শোনে, রাইতে বাসায় আইসা খাওনের টেবিলে সেইসব উগড়ায়। সে আমারে কয়, দুলাভাই গুণীর জন্য কি আইন আলাদা? লাইন আলাদা? সে কি নিয়ম কানুন মানবে না? আমি তো তোমাদের ভাবীর সামনে তারে বেশি কিছু কইতেও পারি না, সেইদিন বারিন্দায় বিড়ি খাইতে গিয়া তারে পাইয়া কইলাম, আব্বে শ্বশুরার পো, নিয়ম মাইনা কে কবে বড় হইছে রে? নিয়ম বানানোই হইছে তর মতো আবুলগোরে লাইনে রাখতে। ঐ লাইন টপকাইতে না পারলে সারাজীবন এক জায়গায় খাড়াইয়া বালটা ফালাবি? দিনদুনিয়ার সমঝদারি কবে হইব তর?"
খালিদ কিছু বলে না।
ভাই গজগজ করতেই থাকেন। বলেন, "বাঙ্গালি এক আচোদা নেশন, বুচ্ছো তো? বাঙ্গালির নরকে দারোয়ান লাগে না। একজন বাইর হইতে গেলে আরেকজন ঠ্যাং ধইরা টাইনা রাখে।"
গাড়ির অন্ধকারে বসে টের পাই, নিয়ম মানেই নরক। সে নরক থেকে বেরোতে গেলে তো কিছু নিয়ম ভেঙে খানখান হবেই?
গাড়িটা হঠাৎ হোঁচট খেয়ে থেমে যায়, ফটাশ করে শব্দ হয় বাইরে। ভাই ব্রেক কষে স্টিয়ারিঙে কিল মেরে চিৎকার করে উঠেন, "ধুর বাল! এই শাউয়ার লোহার কাঁটা বহাইয়া কি দেশটারে শেষ করবি? আরে এইটা কেমন গণতন্ত্র? দেখি খালি আর কয়দিন পাওয়ারে থাকতারস ...।"
খালিদ একবার শুধু পেছনে তাকিয়ে আমাকে টপকে দেখে নেয় আর কোনো গাড়ি আসছে কি না, তারপর স্মার্ট ছেলের মতো গড়গড়িয়ে বলে, "ভাইরে তো মনে হয় গ্যারেজ থেকে লোক ডাকায়ে বাড়ি যাইতে হবে। আচ্ছা ভাই, আজকে আসি তাইলে, দেখা হবে আবার যদি দেশে থাকেন। ঐ, নাম বে!"
ভাই হয়তো চাকা বদলানোর জন্য আমাদের দুজনকে ভরসা ধরে নিয়েছিলেন, খালিদ তাকে মুখ খোলার সুযোগ না দিয়ে আমার হাতে ধরে টানতে টানতে দ্রুত পায়ে রাস্তা টপকে উল্টোদিকে গিয়ে এক সিয়েনজি মামুকে মধুর গলায় বলে, "চলেন মামু, বাসায় যাই। মিটার ফালাইয়া রাখেন, মিটারের মায়রে বাপ।"
বদির দেশের ভিআইপি রোডে চাকাফাটা একটা গাড়ি বুকভরা দিনদুনিয়ার সমঝদারি নিয়ে থমকে থাকে স্রোতের উল্টোদিকে। স্বর্গের দারোয়ানরা এ কথা কোনোদিন জানতে পারবে না, ভাগ্যিস!

ব্র্যাড অ্যাডামস, এইবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে একটা চিঠি লিখুন

$
0
0
বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে গঠিত 'এলিট ফোর্স'র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন ওরফে র‍্যাব ভেঙে দেওয়ার জন্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লিখেছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নামের একটি মৌসুমী মানবাধিকারবারি সংগঠনের এশিয়া অঞ্চলের প্রধান, ব্র্যাড অ্যাডামস [সূত্র]।
র‍্যাব নিয়ে ব্র্যাড অ্যাডামসের উদ্বেগের অন্ত নেই। সে উদ্বেগের পেছনে উপস্থাপনীয় কারণেরও অভাব নেই। র‍্যাবের হাতে নিরপরাধ ব্যক্তির আহত ও নিহত হওয়ার খবর নতুন কিছু নয়। অপরাধীও যদি উপযুক্ত বিচার প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে নিরস্ত্র অবস্থায় র‍্যাবের হাতে নিহত হয়ে থাকে, তা আইনের চোখে হত্যা হিসেবেই পরিগণিত হওয়ার কথা।
ব্র্যাড অ্যাডামস লিখেছেন,
স্বাধীন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী, গত ১০ বছরে প্রায় ৮০০ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় র‌্যাব দায়ী।
তারপর তিনি আরো লিখেছেন,
র‌্যাবকে এখন আর সংস্কার করে চালানো সম্ভব বলে আমরা বিশ্বাস করি না। আইনের ঊর্ধ্বে থেকে কোনো ধরনের জবাবদিহিতার তোয়াক্কা না করে র‌্যাব পরিচালনার একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়ে গেছে। এই অবস্থায় এ বাহিনীকে অবশ্যই বিলুপ্ত করতে হবে, যাতে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হয়।
মানবাধিকারবারি ব্র্যাড অ্যাডামসের উদ্বেগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবার একটা ছোটো আবদার করি। প্যাড থেকে আরেকটা কাগজ ছিঁড়ুন। কলমদানি থেকে কলমটা বের করে খাপ খুলুন। তারপর লিখুন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে। তাকে বলুন, ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস প্রতিষ্ঠানটিকেও বিলুপ্ত করে দিতে। ২০০০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেসের হাতে নিহত ফিলিস্তিনিদের একটি পরিসংখ্যান পাবেন এখানে। এদের মাঝে একটি বড় অংশ নিরীহ বেসামরিক মানুষ, তাদের একটা বড় অংশ শিশু, এবং সংখ্যাটাও ৮০০ থেকে বেশি।
আমি নিশ্চিত, আপনি বিশ্বাস করেন না যে ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেসকে সংস্কার করে চালানো সম্ভব। কাজেই ফিলিস্তিনে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার জন্য যে এই বাহিনীকে বিলুপ্ত করার অনুরোধ আপনি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে করবেন, সেরকম তো আমরা ধরে নিতেই পারি। নাকি?
কবে আপনি ঐ চিঠিটি লিখবেন, দেখার জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করছি। আপনার মানবাধিকার ব্যবসার দৌড় কতদূর পর্যন্ত, সেটাও দ্রষ্টব্য।

আল্লাহর মাল

$
0
0
নিয়ম অনুসরণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে একটা ঢিলেঢালা নিয়তিনির্ভর মনোভাব কাজ করে। এক বাক্যে প্রকাশ করতে গেলে, রাখে আল্লাহ মারে কে?
বাংলাদেশের অধিকাংশ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবস্থায় নিরাপত্তার জন্য ইহলৌকিক কোনো ব্যবস্থা বা নিয়মের ধার না ধেরে সরাসরি আল্লাহর ঘাড়ে নিরাপত্তার দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়। যে সেতুতে ৫ টনের বেশি ভারবাহী যান চলা নিষেধ, চালকেরা অম্লানবদনে তাতে ১৫ টন নিয়ে উঠে পড়তে পারে। যে লঞ্চে নিরাপত্তার খাতিরে সর্বোচ্চ ৮৫ জন যাত্রী তোলা বৈধ, তাতে আড়াইশো জন যাত্রী আল্লাহর হাতে নাব্যতা ও প্লবতার দায়িত্ব সঁপে দিয়ে উঠে পড়ে। আবহাওয়া বৈরী হয়ে এলে যখন কোনো ক্যাটেগরির লঞ্চের যাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, তখনও আল্লাহর হাতেই সবকিছু ছেড়ে দিয়ে পার্থিব টাকাপয়সার পেছনে লঞ্চ ছোটে।
দুর্ঘটনা যদি ঘটেই যায়, তখন আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে দোষারোপের উপায়ও থাকে না। কারণ, মারে আল্লাহ রাখে কে?
পাবলিকের জন্যে বরাদ্দ সবকিছুতে আল্লাহকে চিফ সিকিউরিটি অ্যান্ড সেফটি অফিসার হিসাবে নিয়োগই যদি দেওয়া হয়, তাহলে মন্ত্রী-এমপি-নেতারা কেন লটবহর নিয়ে নিরাপত্তা প্রোটোকলসহ চলাফেরা করে?
হয়তো, শুধু পাবলিকই আল্লাহর মাল।
মানুষ কয়েক হাজার বছর ধরে জলচর। কোনো নৌযান কখন পানিতে ভাসবে, কখন ডুবে যাবে, তা নির্ধারণের জন্যে প্রয়োজনীয় জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা এই কয়েক হাজার বছরে সঞ্চিত হয়ে গেছে। সারা দুনিয়াতে কোটি কোটি মানুষ কিছু সরল নিয়ম মেনে চলে নৌকাডুবি এড়িয়ে চলতে পারছে, আমরা পারছি না। কর্তৃপক্ষকে গালি দিতে দিতে মুখ ব্যথা হয়ে যাওয়ার পর টের পাচ্ছি, সমস্যাটা শুধু কর্তৃপক্ষেরই নয়। কর্তৃপক্ষ যেমন পাবলিককে আল্লাহর মাল হিসাবে বিবেচনা করে, যারা ভিকটিম, তারাও কর্তৃপক্ষের মতোই নিজেদের আল্লাহর মাল ভাবে। কপালের নিচে দুটো চোখ থাকলে যে লঞ্চে ৮৫ জন যাত্রী ওঠার কথা, তাতে ঠেসেঠুসে আড়াইশো জন ওঠার কথা নয়। ঐ আড়াইশো জন মানুষের মধ্যেও সবকিছু আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকার প্রবণতা কাজ করেছে।
ডুবে যাওয়া লঞ্চ টেনে তোলা হয়, মানুষগুলো ফিরে আসে না। লঞ্চ মালিকেরও কয়েকটা খ্যাপের টাকা গচ্চা যায়, এরচেয়ে বেশি কিছু হয় না। বরং পাবলিকের কাছ থেকে আদায় করা রাজস্ব থেকে ছাগল কিনে মৃতদের পরিবারকে "ক্ষতিপূরণ"দেওয়া হয়।
কিছুদিন আগে একটি যুগান্তকারী রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। চালকের ভুলে দুর্ঘটনা ঘটলে মালিকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা যাবে [সূত্র]। স্থলযানের ক্ষেত্রে এ রায় খাটলে, জলযানের ক্ষেত্রেও খাটার কথা। সাম্প্রতিক লঞ্চডুবিতে নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে অন্তত একটি ক্ষতিপূরণ মামলা করে যদি লঞ্চের মালিকের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয়, নৌপথে আল্লাহর ওপর নির্ভরতা কমে তুচ্ছ ইহলৌকিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের সংস্কৃতি গড়ে উঠবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে যেতে যদি পারেন, লঞ্চ মালিকদের পকেট থেকে টাকা নিয়ে সেই মালের উত্তরাধিকারীদের মাঝে কি আল্লাহ বণ্টন করে দিতে পারেন না?
একই সাথে সাংবাদিক ভাইদের কাছে আরেকটি নিবেদন। বিশ্বকাপের সময়, বা ভোটের সময় আপনারা বিভিন্ন দলের স্কোর রাখেন। একইভাবে যদি নৌপরিবহন মন্ত্রীদের হাস্যোজ্জ্বল ছবিসহ নিমজ্জনে মৃতদের সংখ্যা দিয়ে স্কোরবোর্ড তৈরি করে যে যার পত্রিকায় টাঙিয়ে রাখতে পারেন, তাহলে পাঠক ও ভোটারদের গুণতে সুবিধা হবে, কার আমলে কর্তৃপক্ষীয় অবহেলায় কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আল্লাহর মালের হিসাব আল্লাহ রাখেন জানি, আমরাও নাহয় রাখা শুরু করলাম?

বৃষ্টিমান যন্ত্র

$
0
0
বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের ধরন নাকি বদলে যাচ্ছে।
পিচ্চিকালে বইতে পড়েছিলাম, বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। তখন মনে হতো, ওটাই স্বাভাবিক। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে চার ঋতুর কথা পড়লে একটা চাপা গর্ব হতো, ভাবতাম আমাদের দুটো বাড়তি ঋতু আছে। পৃথিবী একদিকে হেলে থাকার কারণে বছরে চারটি ঋতু থাকাই যে স্বাভাবিক, সেটা ধরতে অনেক সময় লেগেছে। কিন্তু ততোদিনে বুঝে গেছি, বাংলাদেশ আর শৈশবের ষড়ঋতুর দেশ নেই। বর্ষাকাল এখন গ্রীষ্মের জন্য অনেকখানি জায়গা ছেড়ে দিয়ে শরতকে ঘরছাড়া করে ফেলেছে। এই কোনোমতে টিকে থাকা বর্ষাকালের পেছনেও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এখন আঙুল দিচ্ছে।
আমাদের দেশটাই গড়ে উঠেছে বর্ষার হাতে। হিমালয় থেকে কোটি কোটি টন পলি বর্ষাই বয়ে এনে একটু একটু করে বাংলাদেশের শরীরে মাংস যোগ করছে অনাদিকাল থেকে। আমাদের কৃষি আর যোগাযোগ এককালে সম্পূর্ণ বর্ষাকেন্দ্রিক ছিলো। ইংরেজের হাতে পড়ে নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা পেছনের সারিতে চলে গেলেও কৃষি এখনও বর্ষার ওপর পুরো এক মৌসুম ভরসা করে আছে। আমাদের দেশে যে ধান চাষ করা হয়, সে ধানও বিবর্তিত হয়েছে সুদীর্ঘ সময়ের নিয়মিত বর্ষার সাথে। এখন হঠাৎ যদি বর্ষার কিসিম পাল্টে যায়, তাহলে কৃষককে বর্ষা মৌসুমেও সেচের দিকে ঝুঁকে পড়তে হবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ পরিস্থিতি আবারও নতুন করে চাপের মুখে পড়বে।
কৃষি ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্যে আমাদের এখনই বৃষ্টিপাতের ওপর নিখুঁত কিছু মডেল প্রণয়ন করা প্রয়োজন। কিন্তু এই মডেলের উপাত্তের জন্যে যে সাধারণ যন্ত্রটি প্রয়োজন হয়, সে বৃষ্টিমান যন্ত্র (রেইন গেজ) আমাদের আবহাওয়া বিভাগের হাতে নাকি পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই। ১৫ কিলোমিটার অনুবিভাজনে সারা দেশে বৃষ্টিমান যন্ত্রের প্রয়োজন হয় দেড় হাজারটি, আবহাওয়া বিভাগের কাছে নাকি একটিও নেই [সূত্র]। পত্রিকায় পড়লাম, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই বৃষ্টিমান যন্ত্র নষ্ট থাকায় বা তথ্য সংগ্রহে গাফিলতি থাকায় অনেক স্থানে বন্যা পূর্বাভাস ব্যবস্থাও অচল হয়ে পড়ে আছে।
আমাদের তরুণ প্রকৌশলীরা কিন্তু একটি স্বয়ংক্রিয় বৃষ্টিমান যন্ত্র নকশায় এগিয়ে আসতে পারেন। ফ্লোট সেন্সর ব্যবহার করে প্রতিদিনের বৃষ্টিপাতের তথ্য একটি স্মৃতিকোষে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। মোবাইল পরিষেবার এই রমরমা যুগে এই তথ্য প্রতিদিন একটি কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডারে পাঠানোও কোন কঠিন কাজ নয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো এখনও বৃষ্টিমান যন্ত্রের পাঠ নিতে একজন পাঠকর্মীকে এখানে ওখানে পাঠায়, ফলে পুরো প্রক্রিয়াটি জনবলনির্ভর ও সে জনবলের সততা/দক্ষতানির্ভর হয়ে আছে। বৃষ্টিপাতের নিখুঁত তথ্য যেখানে সারা দেশে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার কৃষি, যোগাযোগ ও বন্যা-মোকাবেলা ব্যবস্থার ভিত্তি, সেখানে পুরো তথ্য সংগ্রহ ব্যবস্থাটিই আধুনিক ও তাৎক্ষণিক হওয়া বাঞ্ছনীয়।
আমাদের দেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এখন ধীরে ধীরে উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। উদ্যোক্তা এবং সরকারের উচিত দেশের জন্য অপরিহার্য সকল ক্ষেত্রে কারিগরি উৎকর্ষ সাধন। সরকার যদি এই সামান্য স্বয়ংক্রিয় বৃষ্টিমান যন্ত্র উদ্ভাবন ও সংশ্লিষ্ট তথ্য ব্যবস্থাপনার পেছনে বিনিয়োগ করেন, আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা একদিকে যেমন নতুন প্রযুক্তি প্রণয়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের চর্চা বেগবান করতে পারবেন, সরকারও প্রযুক্তি খাতে দেশীয় উদ্যোগের পৃষ্ঠপোষকতা করে ব্যয় সাশ্রয় করতে পারবেন।
রোম একদিনে তৈরি হয়নি, আমরাও একদিনে প্রযুক্তি উদ্ভাবনের শীর্ষে উঠে যেতে পারবো না। কিন্তু ছোটো ধাপগুলো যাতে পাড়ি দিতে পারি, সে সুযোগ সরকারকেই করে দিতে হবে।

হাবিজাবি গল্প ১

$
0
0
একটা জেব্রা আফ্রিকায় থাকতো। সারাদিন ঘাস খেতো আর সিংহ দৌড়ানি দিলে দৌড়াদৌড়ি করতো। বৃষ্টির পিছে পিছে একবার এদিকে আরেকবার সেদিকে করে সাভানায় চরে বেড়াতো। ভিল্ডেবিস্টের পালের সাথে নদীতে কুমীরের সাথে পাল্টি দিয়ে পার হতো।
হঠাৎ জেব্রার সাথে দেখা হলো এক কুঁজওয়ালা জেব্রার।
জেব্রা কুঁজওয়ালা জেব্রার সাথে আলাপসালাপ করে ঠিক করলো, আফ্রিকায় আর না। সে সৌদি চলে যাবে। ঐখানে উটের খামারে চাকরি করবে। বেতন দিয়ে কোনোমতে নিজের খেয়ে পরে চলে যাবে। সৌদি বড় আরামের জায়গা, শুধু মাঝে মধ্যে দুরন্ত আরব মমিন রাখালেরা একটু বিরক্ত করে। ঐখানে সিংহ নাই, কুমীর নাই, তবে বৃষ্টিও নাই। ঘাস পানি খামারেই পাওয়া যাবে, বেশি করে পানি খেয়ে নিলে কিছুদিন পর নিজের পিঠেই কুঁজ গজাবে, বৃষ্টির পিছে আর দৌড়াতে হবে না। বাকিটা আল্লাহ পাকের ইচ্ছা।
জেব্রা পরের ফ্লাইটেই সৌদি চলে গেলো।
বাকি জেব্রাদের জীবন কাটে আফ্রিকার সাভানায়। মাথার ওপর গনগনে সূর্য, ঝোপেঝাড়ে সিংহ, নদীতে কুমীর।
একদিন আমাদের জেব্রা ফিরে এলো। তার পিঠে কুঁজ গজায়নি, তবে মাথায় একটা সুন্দর টুপি। মুখে একটু ছাবা ছাবা দাড়ি।
অন্য জেব্রারা তাকে ঘিরে ধরে শুধালো, কীরে জেব্রা, সৌদি কেমন?
জেব্রা খ্যাঁক করে উঠে বললো, আমারে জেব্রা ডাকবি না।
বাকি জেব্রারা একে অন্যে মুখ দেখে নিয়ে বললো, তাইলে কী ডাকুম?
জেব্রা বুক ফুলিয়ে বললো, আমি এখন আলজেব্রা।

আছায্য পাটীগণিত ০১: খন্দকার, ইকবাল, মতি

$
0
0
মশহুর মাসিক পত্রিকা কিশোর আলোর অনিয়মিত তারকা লেখক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বিডিনিউজ২৪.কমে একটি কলাম প্রকাশ করেছেন, "ইতিহাসের ইতিহাস"শিরোনামে [সূত্র]। লেখাটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ (বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য এই পদটির কোনো বাংলা মনে হয় আর করা হয়নি, উপসেনানায়ক বলা যেতে পারে সম্ভবত) এয়ার ভাইস মার্শাল আবদুল করিম খন্দকারকে অপমান করা বিষয়ে। সম্প্রতি এ কে খন্দকার স্বনামধন্য কিশোর মাসিক কিশোর আলোর সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রথমা প্রকাশন থেকে একটি আত্মজৈবনিক গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন, তার শিরোনাম "১৯৭১: ভেতরে বাইরে"।
অধ্যাপক ইকবাল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাঁর অনুরাগের প্রকৃতি ও ইতিহাস বর্ণনা করে মুক্তিযুদ্ধের উপসেনানায়ক হিসেবে খন্দকারকে উপস্থাপন করে দুঃখ করে বলেছেন,
যখন আমি আবিষ্কার করেছি একটি বইয়ের বিষয়বস্তুর কারণে এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে অপমান করার চেষ্টা করা হচ্ছে তখন বিষয়টি আমাকে গভীরভাবে আহত করেছে।
এ কে খন্দকারকে কীভাবে কে কোথায় অপমান করার চেষ্টা করেছে, তার বিশদ বর্ণনায় অধ্যাপক ইকবাল যাননি, কেবল তার কারণটিকে সামনে এনেছেন। তিনি গভীর ক্ষোভ নিয়ে বলছেন,
আমরা আমাদের দেশে একজন মানুষকে তাঁর নিজের মত প্রকাশের জন্যে এভাবে অসম্মান করব আমি সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।
খন্দকারের লেখা বইটি আমি পুরোটা পড়িনি, বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে অধ্যাপক ইকবালও বিস্তারিত কিছু বলেননি, কিন্তু গুণী মানুষেরা কোনো কথা না বলেও অনেক কিছু বলে ফেলতে পারেন। রবি ঠাকুর এ ধরনের গুণীদের ওপর বিলা হয়ে লিখেছিলেন, তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো অধৈর্য হলে আমাদের চলবে না। একটু একটু করে পড়ে বুঝতে হবে, অধ্যাপক ইকবাল কী বলতে চেয়েছেন।
লেখার প্রারম্ভিক অংশ পড়ে বোঝা যায়, এ কে খন্দকার তাঁর বইতে এমন কিছু মত প্রকাশ করেছেন, যার প্রতিক্রিয়ায় কোনো এক রহস্যময় দুরুচ্চার্য মহল তাঁকে অপমান করার "চেষ্টা"করেছে। মানীর মান রক্ষার দায়িত্ব সকলেরই। কিন্তু মানীর মান রক্ষায় স্বয়ং মানীর কি কোনো দায় নেই?
এ কে খন্দকার মুক্তিযুদ্ধের উপসেনানায়ক, তাঁকে কে সেধে সেধে বিনা কারণে অপমান করতে চাইবে? কিন্তু খন্দকার নিজে কি নিজের এই পরিচয়ের প্রতি সুবিচার করেছেন? যে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জাফর ইকবাল তাঁর গভীর অনুরাগের কথা কয়েক প্যারা ধরে বিবৃত করেছেন, সে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিই কি খন্দকার সুবিচার করেছেন? কই, মুক্তিযুদ্ধের উপসেনানায়ক এবং একটি স্বাধীন দেশের বিমানবাহিনী প্রধানের গর্বিত পরিচয় নিয়ে তিনি তো ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ফৌজদারি অপরাধী খন্দকার মুশতাকের প্রতি অকম্পিত কণ্ঠে আনুগত্য প্রকাশে এতটুকু পিছপা হননি? তখন কি মুক্তিযুদ্ধের উপসেনানায়ক পরিচয়টির গায়ে কাদার ছিটে লাগেনি?
অধ্যাপক ইকবাল তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, হয়তো ব্যাপারটা খেয়াল করার ফুরসত পাননি তখন।
জেনারেল জিয়াউর রহমান যখন সশস্ত্র বাহিনী থেকে মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা আর সৈনিকদের বিদ্রোহের অজুহাতে নামমাত্র বিচারে বা বিনা বিচারে ধরে ধরে ফাঁসি দিলেন, যে বিমানবাহিনীর প্রধান এ কে খন্দকার স্বয়ং কয়েক বছর আগেও ছিলেন, সে বিমানবাহিনীকে জিয়া যখন প্রায় মুক্তিযোদ্ধাশূন্য করে ফেললেন, তখন মুক্তিযুদ্ধের উপসেনানায়ক কোথায় ছিলেন? জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রদূত হিসেবেই কি তিনি দায়িত্ব পালন করছিলেন না তখন? মুক্তিযুদ্ধের উপসেনানায়ক পরিচয়টি কি তখন আলমারিতে তুলে রাখা ছিলো?
অধ্যাপক ইকবাল তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, হয়তো ব্যাপারটা খেয়াল করার ফুরসত পাননি তখন।
কামরুল হাসান যাকে বলেছিলেন "বিশ্ববেহায়া", সেই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, যিনি জেনারেল মঞ্জুরসহ আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের মৃত্যুর জন্যে দায়ী বলে নানা কৌতূহলোদ্দীপক বিবৃতি ও প্রতিবেদন আমরা পত্রিকায় পড়তে পাই, সেই এরশাদের কেবিনেটে যখন মুক্তিযুদ্ধের উপসেনানায়ক এ কে খন্দকার পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে যোগ দিয়ে এরশাদের ধর্ম মন্ত্রী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দোসর রাজাকার মওলানা মান্নানের সহকর্মী হিসাবে কয়েক বছর দায়িত্ব পালন করে গেলেন, তখন পরিচয়টি কোথায় ছিলো? তিনি পরিকল্পনা মন্ত্রী থাকার সময় যখন সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পরিচয় মুছে ফেলা হলো, তখন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে অভীষ্ট ধরে সাধিত মহান মুক্তিযুদ্ধের উপসেনানায়কের পরিচয়টি লজ্জায় বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলো কি?
অধ্যাপক ইকবাল তখন দেশের বাইরে, এসব খোঁজ রাখার ফুরসত পাননি বোধহয়।
মুক্তিযুদ্ধের উপসেনানায়ক পরিচয়টির ওপর অতীতে অকাতরে ত্যাগ করা রহস্যময় হলদেটে তরলের দাগ এড়িয়ে অধ্যাপক ইকবালের কাছে এ কে খন্দকার কেবল সেক্টর কমাণ্ডারস ফোরামেরই প্রধান, যিনি অধ্যাপক ইকবালের সঙ্গে এক গাড়িতে পাশে বসে থেকে তাঁকে শিহরিত হওয়ার অমূল্য সুযোগ করে দেন। অধ্যাপক ইকবালের ভাষ্যে,
মনে আছে তিনি এবং তাঁর সহযোদ্ধারা একবার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন এবং এয়ারপোর্ট থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পর্যন্ত পথটুকু আমি গাড়িতে তাঁর পাশে বসে এসেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের এ রকম একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের পাশে বসে আছি চিন্তা করেই আমি শিহরিত হয়েছিলাম।
অধ্যাপক ইকবাল হয়তো অনেক আগেই মার্কিন সিনেটর ড্যানিয়েল প্যাট্রিক ময়নিহানের নাম শুনে থাকবেন, আমি মোটে সেদিন শুনলাম। এই ভদ্রলোক বলেছিলেন, You are entitled to your opinion. But you are not entitled to your own facts. এই কথাটুকু একটু থেমে, মন দিয়ে পড়ে, হৃদয়ঙ্গম করে বাকি কথাগুলো শুনুন।
এ কে খন্দকার তাঁর বইতে মোটা দাগে অভিমত (opinion) দিতে গিয়ে কিছু ঘটনাকে বাস্তবতার (fact) রূপ দিতে চেয়েছেন। এ কে খন্দকারের অভিমত প্রকাশের অধিকার রয়েছে, কিন্তু সে অভিমতের সমর্থনে নিজের অভিলাষ অনুযায়ী বাস্তবতা উৎপাদনের অধিকার তাঁর নেই। শুধু তাঁর কেন, কারোই নেই। তিনি নিজের অভিমতের পক্ষে যায়, এমন একটি গুজব (যা কিনা সেই গুজবের প্রাথমিক ধারকেরা নিজেরাই ক্ষমা চেয়ে নাকচ করেছেন [সূত্র]) নিজের বইতে গুঁজে দিয়ে বলেছেন, শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তাঁর ভাষণের শেষে জয় পাকিস্তান বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া নিয়েও খন্দকার তথ্যসূত্র সমর্থিত গ্রন্থনার বিপরীতে গিয়ে অভিমত দিয়েছেন। ইতিহাস নিয়ে অভিমত দিতে গেলে যে ডিউ ডিলিজেন্স ইতিহাস লেখকের কাছ থেকে পাঠক আশা করে, তার ব্যাপক ঘাটতি বইটিতে রয়েছে বলেই অনেক পাঠক অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
এ কে খন্দকার তাঁর পাঠককে প্রবঞ্চিত করেছেন এখানেই। বইটি তিনি লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের উপসেনানায়ক পরিচয়ে, কিন্তু সে পরিচয়টির প্রতি কোনো সুবিচার তিনি করেননি। মুক্তিযুদ্ধের উপসেনানায়ক পরিচয়টির প্রাপ্য সম্মান না দিয়ে যেভাবে তিনি অতীতে ফৌজদারি অপরাধীর প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন, যেভাবে এ মহান পরিচয়টিকে তিনি ধরাশায়ী করে ক্ষমতা জবরদখলকারীর রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন, যেভাবে এ পরিচয়ের মুখে চুনকালি দিয়ে তিনি আরেক ক্ষমতা জবরদখলকারীর কেবিনেটে রাজাকারের সহকর্মী হয়েছিলেন, একই অবহেলায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের উপসেনানায়ক পরিচয়টির মান ডুবিয়ে অসত্যভাষণের মাধ্যমে পাঠককে ঠকিয়েছেন। তিনি যা বলেছেন, তা সত্য হিসাবে প্রমাণ করতে পারেননি, কেবলই এক বৃদ্ধের ব্যক্তিগত হিসাবনিকাশতাড়িত অসংলগ্ন অভিমত তিনি পাঠককে গছিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের উপসেনানায়কের এ ভীমরতি কি সহজে মেনে নেওয়া যায়? মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফসল আজকের তরুণ পাঠকের কি ক্ষুব্ধ ও অপমানিত হওয়ার অবকাশ খন্দকার নিজেই করে দেননি?
কিন্তু আমপাঠকের মতো অধ্যাপক ইকবাল ক্ষুব্ধ বা অপমানিত কিছুই হননি। তিনি শুধু "মন খারাপ"করেছেন, তাও বেশি নয়, "একটু"।
আগেই বলেছি এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের বইটি পড়ে আমার একটু মন খারাপ হয়েছে।
এই তথ্যসূত্র-অসমর্থিত ও পরের-মুখে-ঝাল-খাওয়া বইটি লিখে খন্দকার মুক্তিযুদ্ধ ও নিজের মুক্তিযুদ্ধের উপসেনানায়ক পরিচয়টিকে অপমান করেছেন, এটা বোঝার মতো পরিপক্কতা হয়তো অধ্যাপক ইকবালের এখনও আসেনি। সবার মান-অপমান বোধ একরকম নয়, আমরা বুঝতে পারি।
কিন্তু এরপর খুব বিস্মিত হয়ে দেখি, খন্দকার যে অসত্য কথাগুলো বইতে বলেছেন বলে জাফর ইকবাল ব্যবচ্ছেদ করে দেখিয়েছেন, সেই ব্যবচ্ছেদের পরও অধ্যাপক ইকবাল বলছেন,
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলে একটা কথা আছে, মাওলানা আবুল কালাম আজাদও তাঁর মত প্রকাশ করার জন্য ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ নামে একটা বই লিখেছিলেন। সেই বই পড়ে বইয়ের সংক্ষিপ্ত একটা রূপ ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। পুরো বইটি পড়ে অনেকে মনে কষ্টে পেতে পারে বলে তিনি বলেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরে যেন পুরো বইটি প্রকাশ করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পর আমরা সেই বইটি পড়ার সুযোগ পেয়েছি। কাজেই ইতিহাসে সত্য যুক্ত করার জন্যে সময় নেওয়ার উদাহরণ পৃথিবীতে আছে– একজন মানুষকে অসম্মান করা হবে জানলে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
এখানে এসে বিভ্রান্ত ও হতচকিত হয়ে যাই। লেখার এক অংশে যেখানে অধ্যাপক ইকবাল নিজেই খন্দকারের বইতে গ্রন্থিত অসত্যকে কাটাছেঁড়া করে পাঠককে দেখালেন, একটু পর তিনিই আবার বলছেন, ইতিহাসে "সত্য"যুক্ত করার জন্য সময় নেওয়ার উদাহরণ আছে। ব্যাপারটা কেমন আঁশটে হয়ে গেলো না? অধ্যাপক ইকবাল কি ঘুরিয়ে এটাই বললেন না, যে খন্দকারের বইটি ইতিহাসে সত্য যুক্ত করে? এ কেমন স্ববিরোধিতা? আর অধ্যাপক ইকবাল কি অভিমত আর সত্যের মধ্যে পার্থক্য বোঝেন? মাওলানা আজাদের বইতে যা লেখা আছে, সেটি মাওলানা আজাদের অভিমত, যা সত্য হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। আজ যদি কেউ একটা বইতে লেখে, অধ্যাপক ইকবালের হাত রোজ রাত একটার সময় লম্বা হতে হতে হতে হতে শোবার ঘর থেকে ডাইনিং রুমে এসে ফ্রিজ খুলে একটা প্যাটিস বের করে নিয়ে আবার ছোটো হতে হতে হতে হতে ডাইনিং রুম থেকে শোবার ঘরে চলে যায়, এটা কি পঞ্চাশ বছর পর প্রকাশ করলেই সত্য হিসাবে ধরে নিতে হবে?
বাস্তব উদাহরণ থেকে কিন্তু আমরা দেখতে পাই, ইতিহাসে মিথ্যা যুক্ত করার জন্য দীর্ঘ সময় নেওয়ার উদাহরণই বরং কিছু জোচ্চোর প্রকাশক আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে।
অধ্যাপক ইকবাল বই পড়ে যে "একটু"মন খারাপ করেছেন, সে ক্ষত তিনি সারাবার জন্যে ধর্ণা দিয়েছেন প্রথমা প্রকাশনের কাছে। এবং সে আলাপচারিতার বিবরণ থেকে আমরা জানতে পারি, বইটির কোনো পাণ্ডুলিপি নেই, বইটি লেখা হয়নি, বরং খন্দকারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বইটি "প্রস্তুত"করা হয়েছে। মনের সেই "একটু খারাপ"ভাবকে সারানোর ঔষধ হিসাবে "মনের সান্ত্বনা"র জন্যে অধ্যাপক ইকবাল প্রথমা প্রকাশনের কাছ থেকে এই প্রস্তুতির ওপর একটু পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রার্থনা করেছেন।
অধ্যাপক ইকবাল লেখার এ পর্যায়ে এসে তাঁর অনুরাগভাজন খন্দকারকে নিষ্কৃতি দেওয়ার একটি উপায়ও খুঁজে পেয়েছেন।
বইটি লেখার দায়ভার কি শুধু লেখকের? প্রকাশককেও কি খানিকটা দায়ভার নিতে হবে না? আপত্তিকর কিংবা বিতর্কিত কিছু লিখে একজন লেখক সমালোচনা আর অসম্মান সহ্য করবেন এবং সেই সমালোচনা আর অসম্মান বিক্রি করে প্রকাশক অর্থ উপার্জন করবেন সেটি কেমন কথা? আমরা কি কোনোভাবে প্রকাশককেও দায়ী করতে পারি?
এ ব্যাপারে অধ্যাপক ইকবালের সঙ্গে আমি সর্বাংশে সহমত পোষণ করি। এবং দেখতে পাই যে তিনি খন্দকারের বইটিকে "আপত্তিকর"হিসাবে উল্লেখ করছেন।
কিন্তু এই "আপত্তিকর"রচনাকে তিনি লেখার আরেক অংশে "মত প্রকাশের স্বাধীনতা"হিসাবেও উল্লেখ করছেন। অর্থাৎ, তাঁর দাবিটি হচ্ছে, যারা মানী লোক, তাদের মত আপত্তিকর হলেও আমরা পাঠকেরা, যাদের কেবল অপমানিত হওয়ার সুযোগ আছে, তারা কিছু বলতে পারবো না। বললে যদি মানী লোকটি অপমানিত হন?
অধ্যাপক ইকবাল, যিনি খন্দকারের বইটি পড়ে অপমানিত হন না, মুক্তিযুদ্ধের উপসেনানায়কের মুখে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অসত্য অসংলগ্ন কথা শুনে ক্ষুব্ধ হন না, অতীতে তাঁর নিজের হাতে মুক্তিযুদ্ধের উপসেনানায়ক পরিচয়টিকে ভূলুণ্ঠিত করার উদাহরণ গোপন রেখে কেবল সেক্টর কমাণ্ডারস ফোরামে তাঁর নেতৃত্বের কথাটুকুই বলেন, কায়দা করে চেপে গেলেন, স্বয়ং সেক্টর কমাণ্ডারস ফোরামের অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধনায়কেরা কী তীব্র ভাব ও ভাষায় খন্দকারের বইটিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন [সূত্র]।
সেইসাথে অধ্যাপক ইকবাল এক আছায্য পাটীগণিতেরও সন্ধান দিয়েছেন আমাদের। তিনি আবিষ্কার করেছেন, এই "আপত্তিকর"বইটি লেখার দায়ভার যদি বইটির প্রকাশক মতি কিছুটা নেয়, তাহলে খন্দকার তাঁর সম্মান আবার ফেরত পাবেন। তাঁর কাছে সম্মান বিষয়টি বিস্কুটের মতো, আর অপমান সেই বিস্কুট কেড়ে নেওয়ার মতো। যদি কেউ কুকর্মের ভাগিদার হিসেবে হাজির হয়, তাহলে খন্দকার অর্ধেক বিস্কুট ফেরত পাবেন, এমনই মনে হয় তাঁর প্রস্তাব শুনলে।
আমার খুব ইচ্ছে আমাদের সবার কাছে সম্মানিত বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে খন্দকারের বক্তব্যের দায়ভার প্রকাশক খানিকটা হলেও গ্রহণ করে তাঁকে যেন তাঁর সম্মানটুকু ফিরিয়ে দেয়।
অধ্যাপক ইকবাল তুচ্ছ ব্লগ-ফ্লগ পড়ে সময় নষ্ট করবেন না জানি। তারপরও বিনয়ের সঙ্গে তাঁকে বলি, বইটি বিক্রি করে যে অর্থ প্রথমা প্রকাশন উপার্জন করছে, তার একটি নির্দিষ্ট শতাংশ কি খন্দকার রয়্যালটি হিসাবে পাচ্ছেন না? তাঁর অসম্মানের বিনিময়ে মতি প্রকাশক একলাই কামাচ্ছে, ওনাকে কি কিছুমিছু দিচ্ছে না?
দ্বিতীয়ত, এ কে খন্দকার তো হামাগুড়ি দেওয়া শিশু নন, যে ওনাকে ভুলিয়েভালিয়ে বই "প্রস্তুত"করে মতি ওনাকে অপমানের দিকে ঠেলে দেবে। উনি সবকিছু জেনে বুঝে যেমন খন্দকার মুশতাকের কাছে আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন, সবকিছু জেনেবুঝে যেমন জিয়ার রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন, সবকিছু জেনেবুঝেই যেমন এরশাদের মন্ত্রী আর মাওলানা মান্নানের সহকর্মী হয়েছিলেন, তেমনই এ বইটাও সবকিছু জেনেবুঝেই লিখেছেন (আসলে "প্রস্তুত"করতে সহায়তা করেছেন)। মুক্তিযুদ্ধের উপসেনানায়ক পরিচয়টিকে বাংলাদেশে সবচেয়ে অপমান যদি কেউ করে থাকে, তিনি আবদুল করিম খন্দকার নিজেই।
এতো কথার পর মুখে চলে আসা থুতু গিলে ফেলে তৃতীয় অনুরোধটা বিনয়ের সঙ্গেই করি, মুক্তিযুদ্ধের উপসেনানায়কের অসম্মান বিক্রি করে পয়সা কামানো মতি প্রকাশকের পত্রিকা কিশোর আলোতে পরবর্তী লেখাটি কী নিয়ে লিখবেন স্যার?

নৌমন্ত্রী বিষয়ক হড়ুড়ে গল্প

$
0
0
গভীর রাত।

চারদিকে কুয়াশা।

পদ্মার স্রোত নোঙর ফেলে রাখা ফেরিটিকে পাশ কাটিয়ে বয়ে যাচ্ছে দক্ষিণে। হিম বাতাস একটু পর পর ঘা দিচ্ছে ফেরির গায়ে।

পাজেরোর সিটে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছেন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। কুয়াশায় ফেরি চলাচল বন্ধ। সন্ধ্যার দিকে মাদারিপুর ছেড়ে কাওড়াকান্দির দিকে রওনা হয়েছিলো তার গাড়িবহর। ভেবেছিলেন ভালোয় ভালোয় শিমুলিয়া ঘাটে গিয়ে পৌঁছাতে পারলে হরতালের আগে ঢাকায় ফিরে সারাটা দিন টিভিতে হিন্দি সিনেমা দেখে কাটিয়ে দেবেন। টাটকা খেজুড়ের গুড়ের ভাঁপাপিঠা টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে দিয়েছে তার এক ভাবী। মিষ্টি হেসে বলেছে, ঢাকায় গিয়া খাইয়েন। মজা লাগলে আমার কথা মনে কইরেন গো ভাইজান।

শাজাহান খান পাজেরোতে মোচড়ামুচড়ি করে আবার জুতমতো শোওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু শোওয়া যায় না। শালারা গাড়ি বানিয়েছে কিন্তু শোওয়ার বন্দোবস্ত রাখে নাই। কেমন মিস্ত্রি এরা? এরা কি জানে না যে এই গাড়ি ফেরিতে উঠতে পারে, আর সেই ফেরি কাওড়াকান্দি ঘাট ছেড়ে যাওয়ার আধঘণ্টার মাথায় মাঝপদ্মায় কুয়াশার কারণে আটকা পড়তে পারে? যত্তোসব মুরুক্ষু। মনে হয় গরু-ছাগলের ছবিও চিনে না শালারা।

ধোঁয়া ওঠা ভাঁপাপিঠা আর টিফিন ক্যারিয়ার হাতে ভাবীর মিষ্টি হাসির কথা ভাবতে ভাবতে শাজাহান খানের চোখ ঘুমে বুঁজে আসে। তার ড্রাইভার মন্টুও ঘুমে ঢলে পড়েছিলো, কিন্তু সে অল্পতেই বেজায় নাক ডাকে বলে তাকে আরেক গাড়িতে গিয়ে বসতে বলেছেন শাজাহান। গাড়িতে আপাতত আর কেউ নেই।

কিছুদিন আগেই লঞ্চডুবি হয়েছে কাওড়াকান্দি ঘাটের কাছেই। কথাটা মনে পড়তেই শাজাহান খানের ঘুম ঘুম ভাবটা চটে গেলো। সন্ধ্যায় চায়ের সঙ্গে ভাঁপাপিঠা খেতে খেতে চাচাতো ভাইয়ের নাতি পিঙ্কুর সঙ্গে গল্প করছিলেন তিনি। ক্ষুদে পিঙ্কুকে তার মা রোজ ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ায়। পিঙ্কু এসে তাই তার মন্ত্রী দাদাকে জিজ্ঞাসা করছিলো, দাদাজান, পদ্মা নদীতে নাকি শীতের রাইতে ডুবা লঞ্চের পেসিঞ্জার সব উইঠ্যা আসে?

শাজাহান খান চোখ গোল করে বলেছিলেন, হ রে নাতি! উইঠ্যা টর্চ ফালাইয়া দেখে, দুষ্ট পুলাপান সব ঘুমাইছে কি না। যদি দেখে কুন পুলা জাগনা, আইসা কপ কইরা তারে ধইরা পদ্মার মধ্যে টাইন্যা লইয়া যায়!

পিঙ্কু ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে একটা ভাঁপাপিঠা তুলে নিয়ে মায়ের কাছে ছুটে চলে গিয়েছিলো।

কিন্তু গল্পটা এখন মনে পড়ে যাওয়ায় শাজাহান খানের গা একটু ছমছম করতে থাকে। কী ভয়ানক কথা! পদ্মা নদীতে যা ডুবেছে, তাতো গন কেস। তারা যদি আবার উঠে এসে টর্চ মেরে লোকজনের সন্ধান করা শুরু করে, তাহলে ক্যামনে কী?

শাজাহান খান দামি পশমিনা চাদর দিয়ে নিজেকে আরো এক প্রস্থ মুড়ে মাথা ঢেকে শুয়ে পড়লেন।

কতোক্ষণ তিনি এভাবে শুয়েছিলেন, শাজাহান খান জানেন না, কিন্তু হঠাৎ এক ঝলক আলো যেন গাড়ির জানালা দিয়ে তার মাথা বরাবর এসে পড়লো।

শাজাহান খান চাদরের ফাঁক দিয়ে আলগোছে মাথা বের করে দেখলেন, একটা ভূতুড়ে অবয়ব তার গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করছে। তীব্র আলোয় ছেয়ে গেছে চারদিক।

শাজাহান খান ফুঁপিয়ে উঠলেন। ধড়মড়িয়ে উঠে বসতে বসতে বললেন, আমার কোনো দোষ নাই রে ভাইটু। পরিবহন শ্রমিক, গার্মেন্টস শ্রমিক, সুন্দরবনের ডলফিন, এগুলি নিয়া ব্যস্ত থাকি। নৌপরিবহন নিয়া মাথা ঘামানির সময় পামু কই রে ভাইটু? তোমরা আল্লাহর মাল, তোমাগের আল্লাহয় নিয়া গেছে। আবার ক্যান আইলা ভাইটু? আমি একজন মন্ত্রী, তোমাগের লগে ক্যামনে পদ্মার তলে যাই? রহম করো ভাইটু, রহম করো।

মন্টু দরজা খুলে মাথা ভেতরে ঢুকিয়ে মন্ত্রীর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে তার কাঁধ ধরে সন্তর্পণে একটা ঠ্যালা দিয়ে বললো, আরে ও স্যার, উডেন উডেন! শিমুলিয়া আইসা পড়লাম তো। চা-চু খাইবেন নি কিছু?

শাজাহান খান চোখ পিটপিট করে মন্টুকে কিছুক্ষণ দেখেন, তারপ চোখ ডলে আশেপাশে তাকান। টর্চের আলো নয়, ভোরের রোদে ভরে গেছে গাড়ির ভেতরটা। ডুবে যাওয়া লঞ্চের অতৃপ্ত আত্মারা নয়, মন্টুই তার গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকছিলো।

তার মানে কোনো সমস্যা নেই, ভাবলেন উল্লসিত শাজাহান। নিরাপদে ঢাকায় ফিরে যাবেন তিনি। আবারো আগের মতো নৌপরিবহন মন্ত্রকের হাল ধরবেন। আরো চার বছরের জন্য।

শাজাহান রিয়ার ভিউ মিররের দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসলেন শুধু।

গরুটারই চরিত্র ভালো নয়

$
0
0

সবাই আগেই টের পেয়েছিলো, গরুর শ্লীলতাহানির সালিশে বেদম মজা হবে। তাই বিকেলের দিকে এলাকার লোক সরোয়ার মেম্বারের বাড়ির প্রশস্ত উঠানে এক মহোৎসব বসিয়ে দিলো।
সরোয়ার মেম্বার স্থানীয় মুরুব্বিদের নিয়ে বসার সময়ই ফিসফাস চলছিলো রবাহূতদের মাঝে। গ্যালো ইউপি নির্বাচনে সরোয়ার মেম্বারের কানের পাশ দিয়ে গুলি গিয়েছিলো, সতেরো ভোটে হেরেছিলো মাঝাপাড়ার কালাম মেম্বার, সে তার স্যাঙাৎ শফিককে নিয়ে সালিশে মুরুব্বি হিসেবে উপস্থিত। খেলা না জমেই যায় না।
সরোয়ার মেম্বার কেবল প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার তালেব মাস্টার আর গ্রামের মসজিদের ইমাম মৌলবি সদরুদ্দিকে শুধিয়ে ফট করে রায় দিয়ে বসলো, ধর্ষিতা গরুটিকে কিনে নিতে হবে কিশোর মশিউরের বাপকে।
আর তখনই জমে উঠলো খেল।
মুরুব্বি কালাম সরোয়ার মেম্বারের বাড়ির ফিনফিনে সাদা কাপে পরিবেশিত চায়ে গগনবিদারী চুমুক দিয়ে গলা খাঁকরে বললো, কেন?
এই একটি প্রশ্নের পর গোটা সালিশ চুপ। শুধু একটু দূরে একটা লিচু গাছে এক বেয়াদপ কাঠঠোকরার সশব্দ অধ্যবসায় প্রথমবারের মতো সকলের মরমে পশলো।
সরোয়ার মেম্বার ঘাস খেয়ে মেম্বার হয়নি। সে পায়ের ওপর পা তুলে গম্ভীর গলায় বললো, সেইটাই দস্তুর। কোনো মেয়েছেলের উপর এই বলাৎকার ঘটে থাকলে আমরা বলতাম, দুইজনের বিবাহ দিয়ে দাও। সংসার করুক। এই লাফাঙ্গা মশিউর গিয়ে বলাৎকার করলো জাবেদ আলীর অবোলা গরুটাকে। এখন গরু তাকে কিনে নিতে হবে।
এবার সাদা কাপে বাজখাঁই চুমুকের পর শোনা গেলো কালামবন্ধু শফিকের মিহি গলার আওয়াজ, কেন?
সরোয়ার মেম্বার এবার তাকায় তালেব মাস্টারের দিকে। তালেব মাস্টার তাকায় মৌলবি সদরুদ্দির দিকে। মৌলবি সদরুদ্দি আড়চোখে হাতের ঘড়ি আর উঠানে গাছের ছায়া দেখেন। মাগরিবের ওয়াক্ত হতে দেরি আছে।
সরোয়ার বলে, আবার কেন বলেন কেন শফিক ভাই? মশিউর জাবেদ আলীর গরুর ইজ্জত লুটছে। এখন এই বেইজ্জত গরু নিয়া জাবেদ আলী কই যাবে?
জাবেদ আলী ফুঁপিয়ে ওঠে, আমার কাজলী গাইটারে হারামজাদা মশিউর দিনে দুপ্রে খোলা আসমানের নিচে একটা ঘন্টা ধরে ... ।
আর বলতে পারে না জাবেদ আলী, তার গলা ধরে আসে। জাবেদের প্রতিবেশিনী আসমা চেঁচিয়ে ওঠে, আমরা সবাই দেখেছি, হারামজাদা মশিউর কাজলী গাইটাকে একেবারে সর্বনাশ করে ছেড়ে দিছে। আরো সর্বনাশ করতো, কিন্তু আমরা দূর থেকে চিক্কুর দিয়ে বললাম, ওরে হারামজাদা তুই শুধু ঐখানে দাঁড়া তোর বিচি যদি হাঁসুয়া দিয়ে না ফেলছি ...।
সরোয়ার মেম্বার হাত তোলে, বুবু থামেন।
আসমা চুপ করে যায়। কাঠঠোকরাটাও থেমে যায় হঠাৎ। উঠানের মানুষ মৃদু গুঞ্জন করে ওঠে, না, সরোয়ার মেম্বার একটা মরদ বটে।
কালাম মেম্বার দীর্ঘদিন ধরে মেম্বারির দায়িত্ব থেকে বঞ্চিত থাকলেও সে লোকটা তো কালাম মেম্বারই, মেম্বারি তার রগে মজ্জায়। সে আরেকটি রসঘন চুমুক দেয় চায়ের কাপে, একটা কাঠবিড়ালি শিউরে উঠে তরতরিয়ে পালিয়ে যায় পেছনের কাঁঠাল গাছের উচ্চতর ডালে।
কালাম মেম্বার বলে, এক ঘণ্টা ধরে?
জাবেদ আলী ফোঁস করে ওঠে, হাঁ! কত্তবড় শুয়ার হলে একটা অবোলা জীবের ওপর একটা ঘণ্টা ধরে ...।
আবারও তার গলা ধরে আসে।
শফিক সপ্রশংস দৃষ্টিতে দূরে উঠানের মেঝেতে বসে থাকা মশিউরকে দেখে। কালাম মেম্বার বলে, এ তো পরিষ্কার মিছা কথা মেম্বার সাহেব। এক ঘণ্টা ধরে একা একটা বাচ্চা ছেলে এই কাম কীভাবে করবে?
সালিশের দর্শকদের মাঝে জোর গুঞ্জন ওঠে। তাই তো?
কালাম মেম্বার মৃদু হেসে বলে, এইখানে এক ঘণ্টা ধরে এই কাজ করার মতো কেউ আছেন? থাকলে হাত তোলেন।
মশিউরের পাশে বসে থাকা মশিউরের পিতা আলতাব খপ করে মশিউরের সরণোন্মুখ কব্জি চেপে ধরে। বাকি সবাই উসখুশ করে নড়েচড়ে বসে বা দাঁড়ায়।
সরোয়ার মেম্বার নিজের ঘরের কাপের চায়ে ভুরু কুঁচকে চুমুক দেয়। বলে, আপনি কী বলতে চান কালাম ভাই?
কালাম মেম্বার কাপের চা শেষ করে কাপ নামিয়ে রেখে গামছা দিয়ে ঠোঁট মোছে। তারপর হাসিমুখে বলে, এক ঘণ্টার কথা বাদই দিলাম। তিরিশ মিনিট কে কে পারবেন? হাত তোলেন।
মশিউর গর্বিত চোখে উপস্থিত ভিড়কে যাচাই করে। প্রৌঢ়রা মাথা নাড়ে, জাবেদ আলীর দাবিতে সত্যতার গন্ধটা একটু একটু করে ফিকে হয়ে আসে।
তালেব মাস্টার গলা খাঁকরে বলেন, কিন্তু একটা শ্লীলতাহানি হয়েছে, এটা তো সত্য, নাকি? সাক্ষীর তো অভাব নাই।
কালাম মেম্বার মধুর হাসে। বলে, জাবেদ আলী জানলো কীভাবে, যে মশিউর তার আদরের কাজলী গাইকে এক ঘণ্টাব্যাপী শ্লীলতাহানি করেছে?
জাবেদ আলী গর্জে ওঠে, এই মশিউর হারামজাদারে যখন আমরা দৌড়ানি দিয়ে ধরলাম, তখন তো সে নিজেই স্বীকার করছে সব! আর ... আর ... এই যে আসমাবু দেখছে, সালেহাবু দেখছে, ঐ যে মনসুরের মেয়ে পপি সেও দেখছে নিজের চোখে, যে এই অমানুষ মশিউর কাজলীর উপর কী করে গিয়ে চড়াও হইছে!
কালাম মেম্বার হাসে। শফিকও হাসে।
সরোয়ার মেম্বার গম্ভীর গলায় বলে, হাসেন কেন কালাম ভাই?
এবার কালাম মেম্বার থেমে যায়। উঠানে সম্মিলিত শ্বাসের শব্দ হুট করে মিলিয়ে যায়। কাঠঠোকরাটা অনিশ্চিত কয়েকটা ঠোকর দেয় লিচু গাছের কাণ্ডে।
প্রতিটি শব্দ চিবিয়ে চিবিয়ে কালাম মেম্বার বলে, একটা ঘণ্টা ধরে যদি এই নামরদ দুধের কিশোর মশিউর জাবেদ আলীর কাজলী গাইয়ের সঙ্গে কিছু করেই থাকবে, তো কাজলী গাই কেন আপত্তি করলো না?
সবাই পার্শ্ববর্তীর মুখ দেখে। তাই তো?
কালাম মেম্বার বলে, কেন কাজলী গাই দুইটা হাম্বা হাম্বা বলে আশেপাশের গরুবাছুর বা মানুষকে জানান দিলো না, যে মশিউর তার শ্লীলতাহানি করতেছে?
তালেব মাস্টার অস্বস্তিভরে জাবেদ আলীর মুখ দেখেন। মৌলবি সদরুদ্দি আবারও আড়চোখে গাছের ছায়া আর হাতের ঘড়ি দেখে নেন।
শফিক বলে, একটা ঘণ্টা ধরে এই ঘটনা কাজলী গাই ঘটতে দিলো কেন? সে তো অন্য সময় হাম্বা হাম্বা ডাকে, এই একটা ঘণ্টা সে কেন চুপচাপ ছিলো? সে কি নিজের ইচ্ছায় অবোলা ছিলো তবে?
কালাম মেম্বার চাপা গর্জন করে বলে, জাবেদ আলী তোমার গাইটার চরিত্র ভালো না। এই কথা আর দশজনের সামনে এসে বলতে হবে, আমি কখনও কল্পনা করি নাই। কিন্তু সত্য কথা এইটাই। তুমি তোমার গাইরে সঠিক সহীহ তরিকায় বড় করতে পারো নাই।
মশিউর আর আলতাবের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
জাবেদ আলী চেঁচিয়ে ওঠে, তার মানে কী? আমার কাজলীর কী দোষ? সে ছিলো মাঠে বান্ধা, তারে ঘাস খাওয়ানোর জন্য আসমাবু নিয়া গেলো, তারপর আসমাবু বাড়ি ফিরলো দুইটা দানাপানি মুখে দেওয়ার জন্য। তারপর আবার মাঠে ফিরা গিয়া দেখে এই হারামজাদা মশিউর লুঙ্গি তুলে কাজলীরে ...।
আবার অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে থেমে যায় জাবেদ আলী।
কালাম মেম্বার হিংস্র হাসে, আড়চোখে সরোয়ার মেম্বারকে মাপে সে। বলে, আসমা যে বাড়ি ফিরা গেলো, দানাপানি মুখে দিলো, কাজলীর কাছ থেকে কোনো কমপেলেন কি সে এই সময়ের মধ্যে পাইছে? হ্যাঁ? তোমার কাজলীর চরিত্র যদি ভালোই হবে, সে কেন দুইটা লম্বা হাম্বা ডাক দিয়া আসমারে ডাকলো না?
জাবেদ আলী গর্জে ওঠে, আরে গাইয়ের আবার চরিত্র কী?
কালাম মেম্বার ঠা ঠা করে হেসে বলে, তাইলে গাইয়ের আবার শ্লীলতা কী?
সরোয়ার মেম্বার গলা চড়িয়ে বলে, কালাম ভাই, কথা প্যাঁচায়েন না বড় ভাই। মশিউর জাবেদ আলীর গাইরে কী করছে এইটা এখন অঞ্চলের বেবাক মানুষ জানে। এখন শাস্তির পালা, শাস্তি কী দিতে হবে সেটাই কন।
কালাম মেম্বার মৃদু হেসে বলে, আমি তো এইখানে কোনো অপরাধই দেখতে পাচ্ছি না মেম্বার সাহেব। একটা বাচ্চা ছেলে, একটা ডবকা গাইয়ের কাছ থেকে কী ইশারা পাইয়া এমন কাম করে, আপনিই বিচার করেন। এই বয়সে তো কত রকম ভুলই মানুষ করে। তাই বলে কি কাউরে জোর করে দুশ্চরিত্র গাইগরু বেইচা দিবেন নাকি? আমি তো বলি শাস্তি দিতে হইলে কাজলী গাইরেই পঞ্চাশটা দোররা মারার কাম। বেলেল্লা গরু, পর্দাপুশিদার কোনো ঠিক নাই।
আলতাব সম্মতিসূচক সজোর কাশি দেয়। মশিউর মৃদু হাসে। জনতা গুঞ্জন তোলে। কালাম মেম্বারের ধার কমে নাই। সতেরো ভোট কম পেয়েছে তো কী হয়েছে?
সরোয়ার মেম্বার অসহিষ্ণু গলায় বলে, এটা একটা কথা নাকি? একটা দামড়া ছেলে একটা নিরীহ গরুরে ধর্ষণ করবে আর আপনারা তার ওকালতি করবেন?
শফিক সরু গলায় বলে, ধর্ষণ তো হয় যদি ধরেন দুইজনের মধ্যে মতের অমিল থাকলে।
কালাম মেম্বার কথাটা টুক করে তুলে নেয়। বলে, জাবেদ আলীর বেলেল্লা কাজলী গাই যে অরাজি ছিলো, এইটা বুঝার উপায় কী গো মেম্বার সাহেব? একটা ঘণ্টা সে ইয়ে পেতে চুপচাপ দাঁড়ায়ে থাকলো, একটা হাম্বারব পর্যন্ত নাই। বেচারা মশিউরের উপর কী কষ্টটাই না গেছে এই একটা ঘণ্টা? কী রে মশিউর, কষ্ট পাস নাই?
মশিউর দাঁত বার করে হাসে।
আসমা চেঁচিয়ে ওঠে, গরু কবেত্থেকে মানুষের সঙ্গে এই কামে রাজি হওয়া শুরু করলো?
কালাম মেম্বার কড়া গলায় বলে, জাবেদ আলী, তোমার বুজিরে বলো চুপ থাকতে। ব্যাটাছেলেদের সালিশে জেনানারা কথা বলে কেন?
জাবেদ আলী কিছু বলে না, আগুনঝরা চোখে কেবল তাকায় কালামের দিকে।
আসমা তবু চেঁচায়, আরে আমি দেখলাম, সালেহাবু দেখলো, পপি দেখলো, তারপরও আপনেরা কন দোষ গাইটার?
কালাম মেম্বার চকিতে তাকায় মৌলবি সদরুদ্দির দিকে। মৃদু হেসে বলে, হুজুর, শুনলেন মেয়েলোকের কথা? আরে এইসব কেসে কমপক্ষে চারজন নারী সাক্ষী লাগে। তোমরা আছো তিনজন। তোমাগো চৌঠা সাক্ষী কই? আনো তারে। ডাকো এই সালিশে।
জাবেদ আলী ফ্যালফ্যাল করে তাকায় মৌলবি সদরুদ্দির দিকে। মৌলবি সাহেব গলা খাঁকরে বলে, দ্যাখো কালাম, ব্যাপারটা হইতেছে গিয়ে ...।
কালাম মেম্বার গর্জে ওঠে, ব্যাপার পরে হবে মৌলবি সাহেব! আগে হাদিসকোরানের বিধানটা বলেন! জবরদস্তি চোদার কেসে নারী সাক্ষী কয়জন লাগে? চারজনের কমে হয় নাকি হয় না?
উঠানে জোর গুঞ্জন ওঠে। অভিজ্ঞরা সপ্রশংস চোখে কালাম মেম্বারকে দেখেন। একটা ফিসফাস ওঠে, আসমাদের বাড়ির মেয়েছেলেদের ভোটের কারণেই সতেরোটা ভোট কালাম মেম্বারের পাতে কম পড়েছে কি না।
সদরুদ্দি কেশে গলা সাফ করে নিয়ে বলেন, তা দ্বীনের বিধিতে চারজনই লাগে বটে।
জাবেদ আলী বলে, আমার কাজলী গাই নিজেই তো চতুর্থ সাক্ষী!
শফিক চিকন গলায় হা হা করে হাসে। কালাম মেম্বার হাসতে হাসতে গামছা দিয়ে চোখের কোণ মুছে বলে, জাবেদ আলী, তুমি কি মশিউরের বাপের কাছে কাজলীরে বেচনের জন্যই এই রকম সালিশের এন্তেজাম করাইলা? হ্যাঁ? আরে গরুর আবার সাক্ষ্য কী? গরু কি কথা কইতে পারে?
জাবেদ আলী এবার মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, বলে, ক্যান ক্যান, গরুর যদি খারাপ চরিত্র থাকতে পারে, সাক্ষ্য থাকবে না ক্যান?
কালাম মেম্বার হাতে কিল মেরে বলে, তাহলে ডাকো তোমার কাজলী গাইরে। জিজ্ঞাসাবাদ হোক। সে কি বাংলা ভাষা পারে? আইনকানুন দেওয়ানী ফৌজদারী হাদিসকোরান ইজমাকেয়াস সে বোঝে কিছু?
জাবেদ আলী ধুপ করে আবার মোড়ায় বসে পড়ে, তারপর সানুনয় চোখে তাকায় সরোয়ার মেম্বারের দিকে।
সরোয়ার মেম্বার মন্দ্রস্বরে গর্জে ওঠে, বাকোয়াজি বন্ধ করি আমরা। মশিউর গরুটারে বেইজ্জতি করছে এইটা ফাইনাল। এইবার শাস্তি হবে। শাস্তি সব থেকে নরম শাস্তিই বলতেছি। কাজলী গাইরে আলতাবের কাছে বিক্রি করা হবে। মশিউর তার বাপের গাইয়ের সঙ্গে যা খুশি করুক, কেউ আপত্তি করবে না। কিন্তু জাবেদ আলীর গাইয়ের উপর সে হামলা করতে পারে না।
জাবেদ আলী ফুঁপিয়ে ওঠে, কাজলী রে ...।
কালাম মেম্বার এবার পকেট থেকে কৌটা বার করে এক খিলি পান মুখে ঠেসে বলে, গরুর জায়গা গোয়ালে। গরু গোয়ালে থাকবে, খড়বিচালি খাবে, গোয়াল ঘরের দেখশোন করবে, গরম উঠলে আমাদের মাঝাপাড়ার হাশেমের ষাঁড়টারে দিয়া পেট করাতে হবে, তারপর বাছুর দিবে, দুধ দিবে। এই হচ্ছে গরুর জীবন। আলেমওলামারাও এই কথাই বলেন। তুমি জাবেদ আলী গরুরে ঘরের বাইরে খোলা মাঠে ছাইড়া রাখবা, গরু খালি গায়ে ওলান ঝুলায়ে উদাম ঘুরবে, কাজল দেওয়া চোখে কচি কচি ছেলেদের দিকে আড়ে আড়ে চাইবে, আর তারপর তার ওয়াসওয়াসায় ফাঁসায়ে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেদের এক ঘণ্টা ধরে খাটাবে, আর সালিশে তার চরিত্র নিয়া দুইটা কথা বললে তোমরা বলবা কালাম মেম্বার সতেরোটা ভোট কম পাইছে। বরকত নাই জাবেদ আলী, বরকত নাই। এইসব কি ভালো?
মশিউর আর আলতাব মাথা নাড়ে। মোটেও ভালো নয়।
শফিক মিহি গলায় বলে, আদুল গরু হইলো গিয়া পাকা তেঁতুলের মতো।
এরপর সালিশের বাতাবরণটাই নষ্ট হয়ে যায়। একেকজন একেক কথা কইতে থাকে, মৌলবি সদরুদ্দিকে উদ্ধারের জন্যে উঠানে গাছের ছায়া ক্রমশ মাগরিবের ওয়াক্তের দিকে ধেয়ে আসে। কাঠঠোকরাটা লিচুকাঠে মাথা ঠুকে মরে।

মধুমালতী ডাকে আয়

$
0
0
আজ লীগি ভাই সাশ্রুনয়নে বিম্পি ভাইয়ের বুকে
বুক রেখে পথে নেমে এসে দেয় যতো অনাচার রুখে
মুসলিম ভাই সুখে চোখ বোঁজে হিন্দুর আলিঙ্গনে
জামাতি আমির বোনে সুখনীড় সিপিবি নেতার সনে
অবকর্নেল ব্লাডি সিভিলেরে অকাতরে টানি কাছে
বলিতেছে, তবু মুখোমুখি এক আশাতীত ফুল আছে।
ডানের হস্ত আজ তটস্থ বামের পরশা লাগি
এমেপাশ ঘোরে নিরক্ষরের নামের ভরসা মাগি
নির্বাচিতের হাতে হাত রাখে শত জামানতহারা
আবাল বৃদ্ধ সাথে করে আনে তরুণী বণিতা দারা
এক দাবি তুলে মুখরিত আজ পুরুষের পাশে নারী
তেঁতুলের শ্বাসে মিছিলের মাঝে কাঁপে আলেমের দাড়ি
গর্জনে কাঁপে আকাশ বাতাস, তর্জনে মাতে নদী
অর্জনপ্লাবী বর্জনস্রোত বহে চলে নিরবধি
কী সেই জাদুতে নেতিতে-ইতিতে হেন গদোগদো প্রেম?
সে কোন পরশপাথর ডলিয়া সকলই বনিলো হেম?
কোন ভ্রমরের পরাগে পুষ্প হৈয়া ফুটিলো কাঁটা?
কেষ্ট-ফাটানো কলসী জুড়িলো কোন কাঁঠালের আঠা?
আহা কী আজব ঘটিলো সিলেটে - থুক্কু - জালালাবাদে?
কী কারণে পথে নামিলো সকলে হাতে-হাত, কাঁধে-কাঁধে?
উত্তর করি দান,
বাঁচাতে সিলেট, হটাতে তার আগে জাফর নাফরমান।
Viewing all 119 articles
Browse latest View live


<script src="https://jsc.adskeeper.com/r/s/rssing.com.1596347.js" async> </script>