Quantcast
Channel: রয়েসয়ে
Viewing all 119 articles
Browse latest View live

নৈনং ক্লেদয়ন্তি

$
0
0

পূর্বমেঘ

অচেনা বিশাল শহরের আকাশছোঁয়া সব ইমারত কৃপণের মতো ছায়া গুটিয়ে জড়ো করে যে যার পায়ের কাছে। আকাশে অগ্রহায়ণের সূর্য সাগ্রহে তাকিয়ে আছে পৃথিবীর রৌদ্রকাতর গালের দিকে। লীনা ওড়না দিয়ে নিজের মুখটা মুছে নেয় আবার। এ নগরীর রুক্ষ উষ্ণতার অন্য রূপ সে জানে, তাই কাকার অপরাধী দৃষ্টির মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না সে।
রাস্তায় লঙ্গরখানার বাইরে ক্ষুধার্ত বালকের সারির মতো ছটফট করছে পরস্পরের গায়ে প্রায় গা ঠেকিয়ে দাঁড়ানো একেকটি যান, তাদের বনেটের ভেতর চাপা স্বরে ধুঁকছে এঞ্জিন, আর গর্ভের যাত্রীরা সবাই ছটফট করছে। লীনা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে যানজটকে পথচারীর চোখে দেখে। বড়লোকের গাড়ির ভেতরে বসে থাকা ঝকঝকে একজন দু'জন করে নারী পুরুষ। সবার চোখেমুখে ক্রোধ, মাঝে মাঝে একেকজন পাতলা কাগজের মতো রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে গিয়ে সেই ক্রোধের প্রলেপ মুছে সরিয়ে দেয়, তার নিচে দগদগে অসহায় ভীতি দেখা যায়। কিন্তু শহরের মানুষেরা আবার চট করে রেগে উঠতে জানে, তারা হাত পা নেড়ে কাঁচের ওপাশে গাড়ির নিজস্ব আবহাওয়ায় বসে কী কী যেন বলতে থাকে ফোনে। কেউ কেউ আবার কানে তার গুঁজে চুপ করে বসে থাকে। যাদের বয়স একটু কম, তারা মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে টিপতে থাকে সমানে। হয়তো তারা খু্ব এসএমএস করে। হয়তো বাড়িতে তাদের মাকে এসএমএস করে বলে, আমি ভালো আছি, একটু পর বাড়ি ফিরবো।
লীনা গাড়ির চালকদেরও মন দিয়ে দেখে, তাদের চেহারা তুলনামূলকভাবে নিরুদ্বিগ্ন। কয়েকজনের মুখে বেশ দেঁতো হাসি। কেউ কেউ একটু ক্লান্ত, বিরক্ত, স্টিয়ারিঙের ওপর তাদের আঙুল টপাটপ কোনো এক তালের ছক হারিয়ে অসংলগ্নভাবে নড়ছে। লীনা তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ের ছাপ, রাগের আঁচড়ের দাগ খোঁজে, পায় না।
কাকা তাকে গলা চড়িয়ে ডাকে, যাবি না?
লীনা তার দুই পায়ের পাতার মাঝে মাটিতে নামিয়ে রাখা গ্যালনটা আবার তুলে নেয়। তার কাঁধটা আবার টনটন করে ওঠে। একটি ভবনের ছায়া থেকে সরে ফুটপাথ ধরে এগোতেই আবার অগ্রহায়ণের সূর্য রোদের হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করে তাকে। এ শহর নিজের নামটি তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে অফুরান ক্লান্তি আর শ্রান্তিতে।
এ শহরেই তার বাবা আসতো, সপ্তাহে তিনদিন।
জাহেদ তার ভাইঝির হাত ধরে চুপচাপ পা চালায়। লীনার হাত থেকে গ্যালনটা সে নিতে চেয়েছে কয়েকবার, লীনা দিতে চায় না, জোর করে নিজের শরীরের সঙ্গে চেপে ধরে রাখে। সে এখন আর চেষ্টা করছে না। মেয়েটা যা চায়, তা-ই হোক।
গতকাল সেই সোনাডাঙা থেকে শুরু হয়েছে লীনার ধকল। মা তাকে দুপুরে পেট ভরে ডিমের ঝোল আর মুসুরের ডাল দিয়ে ভাত খাইয়ে দিয়েছে, যদিও জাহেদ কাকা বার বার বলেছে, অনেক দূর যেতে হবে বাসে, এতো ভাত খাওয়া ঠিক হচ্ছে না, কিন্তু মা শোনেনি। শামীম ভাই জ্বর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, বোনকে বিদায় জানানো হয়নি তার। জাহেদ কাকা ফুলতলা টেম্পো স্ট্যান্ডে পৌঁছেই তাকে বলছিলো, দেখিস, পেট গুলাবে। ধরি বসতি পারবি? লীনা জোরে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেছে। সোনাডাঙা পর্যন্ত ধরে বসতে পারলেও বাসে উঠে বসার পর বেশিক্ষণ তার সাধ্যে কুলায়নি। জাহেদ কাকা তাকে জানালার পাশে বসিয়েছে সে কারণেই। মাঝরাত পার করে যখন দৌলতদিয়ায় এসে থেমে গেছে বাস, তখন লীনার পেটের ভেতরটা একেবারেই শূন্য।
আগে কখনও ঢাকামুখী সড়কে বাসে চড়েনি সে। অন্ধকার রাতে মহাসড়ককে এক ভীষণ অজগরের মতো মনে হচ্ছিলো লীনার কাছে, যে কেবলই গিলে খাচ্ছে পথের পাশের জমাট অন্ধকার, জোনাকির হাট, ম্রিয়মান ল্যাম্পপোস্ট, অন্ধকারে মগ্ন নিচু মাঠ, প্রকাণ্ড বাবলা আর শিমুল গাছের সারি, যার চোয়াল এক সময় গিয়ে গ্রাস করছে সোনাডাঙা টার্মিনাল। ক্রমশ সে অজগরের পেটের ভেতর ঢুকে পড়ছে সে, আর একটু পর পর তার নিজের পাকস্থলী উগড়ে দিচ্ছে বাড়ি থেকে খেয়ে আসা ভাত।
টিমটিমে বাতি জ্বালিয়ে যে ভাতের ঝুপড়ি হোটেলগুলো দৌলতদিয়া ঘাটের রাস্তায় সারি সারি দাঁড়িয়ে, তার পাশে বাসের দীর্ঘ সারিতে সে প্রথম দেখেছে, যানজট কাকে বলে। ফেরির অপেক্ষায় নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে থাকা সেই বাসগুলোর জানালায় তারই মতো মানুষের ক্লান্ত চোখ, একটু পর পর তারই মতো কেউ না কেউ অকাতরে বমি করছে, এরই মাঝে পতঙ্গের মতো শসা, পেয়ারা, মুড়ি, সিঙ্গারা নিয়ে সেই বাসকে ঘিরে ভনভন করছে ফেরিওয়ালারা। জাহেদ তাকে আবার ভাত খেতে সাধলেও লীনা রাজি হয়নি।
লঞ্চঘাট ফেরিঘাট থেকে খুব বেশি দূরে নয়, আরও অনেকেই হাতে বা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে সেদিকে ক্লান্ত পায়ে হাঁটছিলো। লীনার চোখ ফেরিঘাটের পেছনে সারিবদ্ধ বাসের চালকের আসনে বসা মানুষগুলোকে ত্রস্ত চোখে দেখছিলো শুধু। প্রায় সব ড্রাইভারই নেমে পড়েছে বাস থেকে, কেউ ভাতের হোটেলে ভাত খেতে গেছে, কেউ রাস্তায় পায়চারি করে বিড়ি টানছে, সিটের ওপর হেলান দিয়ে ঝিমাচ্ছে কেউ। লীনার চোখ কেবল একের পর এক বাসের চালককে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো। জাহেদ শক্ত মুঠিতে তার হাত চেপে একটু আকর্ষণ করে বলেছিলো, আয় মা, জলদি যাই, এইখানে আর কোনো কাজ নাই আমাদের।
লীনার তৃষিত চোখ তবুও চালকের আসনগুলো আস্বাদন করে চলছিলো। কী করে এরা এ সময়ে, এতদূর বাস চালিয়ে এসে? তারা কি খায় কিছু? খেয়ে বাড়িতে ফোন করে? স্ত্রীর সাথে, কন্যার সাথে কথা বলে? বলে, আমি ভালো আছি, দৌলদ্দিয়ায় আসি পৌঁছলাম এই মাত্র, তা তোমরা খাইছো রাত্রে? এখন ঘুমাও, সকালে আবার কথা কব।
ফেরিঘাট থেকে লঞ্চঘাট পর্যন্ত আবছায়া পথটুকু ঘোরের মধ্যে কেটে যায় লীনার। তাকে পাশ কাটিয়ে ঢাকামুখী মানুষেরা জোর পায়ে এগিয়ে যায়। জাহেদ লঞ্চঘাটে পৌঁছেও তাকে আবার কিছু খেতে সাধে। লীনা বোঝে, কাকার ক্ষুধা লেগেছে। সে মৃদু স্বরে শুধু বলে, আমি পানি খাই, তুমি ভাত খায়ে নেও।
রাতের তৃতীয় প্রহরে লঞ্চের নিচে পদ্মা আস্তে আস্তে গভীর আর চঞ্চল হয়ে ওঠে তস্করের মতো, দৌলতদিয়া একটু একটু করে সারিবদ্ধ অগণিত বাস আর তাদের অচেনা চালকদের নিয়ে দূরে সরে যায়।
তারপর পাটুরিয়ায় নেমে আবার বাস ধরতে হয়। এবার আর লীনার বমি পায় না, ডিজেলপোড়া গন্ধ আর ঝাঁকুনি আর নতুন কিছু হরণ করে নিতে পারে না তার শূন্য শরীর থেকে, সে জাহেদের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। স্বপ্নে সে ফিরে যায় নিস্পন্দ নিস্তরঙ্গ ফুলতলায়।
ভোরে গাবতলিতে নেমে জাহেদ লীনাকে নিয়ে যায় তেলেভাজার দোকানে। সেখানে আরো আরো ভ্রমণক্লান্ত মানুষ ফোলা ফোলা মুখে পরোটা দিয়ে আলু ভাজি ডিম ভাজি খায়, অস্বচ্ছ সবুজাভ কাচের গ্লাস থেকে ঢকঢক করে পানি খায়, তারপর চায়ের কাপ ঠোঁটে ছুঁইয়ে সমস্ত ক্লান্তি সেখানে দ্রবীভূত করার চেষ্টা করে। লীনা কোনোমতে দুটো পরোটা খায়। জাহেদ চা খেতে খেতে শূন্য চোখে দোকানের বাইরের পৃথিবীটুকু দোকানের দরজার ফ্রেমে গেঁথে দেখে। লীনা ভাবে, বাসের ড্রাইভার লোকটা এখন কী করবে? সে কি ঘুমোবে? নাকি আবার বাস ঘুরিয়ে ফিরে যাবে পাটুরিয়ায়, পরের খ্যাপে? যদি ঘুমোয়, তো কোথায় ঘুমোবে? তার কি ঘুমোবার একটা জায়গা আছে এ শহরে? নাকি সে পথের পাশে কোথাও বাস থামিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে ভেতরেই?
তেলেভাজার দোকান থেকে বেরোবার পর লীনার কানে শুধু এক একটা সংখ্যা চিৎকার করে বলে যেতে থাকে ঢাকা শহর। ১ নম্বর, ১০ নম্বর, ১৪ নম্বর। তার শরীরের ক্লান্ত পেশীগুলো ক্ষণে ক্ষণে স্মরণ করিয়ে দেয়, একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। লীনা হলারের ভেতরে, বাসের ভেতরে বসে এক নম্বর থেকে আরেক নম্বরে এসে নামে, তারপর আবার হলারে ওঠে, বাসে ওঠে। নম্বরের সাথে শহরটা পাল্টায় না, একই রকম অকরুণ দানবত্ব নিয়ে একটু একটু করে পিছিয়ে গিয়ে তাদের জন্য পথ করে দেয় কচুক্ষেতের, ক্যান্টনমেন্টের, কাকলীর। লীনার চারপাশে ঘনিয়ে আসে শুধু গাড়ি আর গাড়ি, তার ভেতরে হরেক পদের মানুষ, কারো চোখে শ্রান্তিজাত রক্তিমাভা, কারো চোখে ঘন রোদচশমা। এক সমুদ্র মানুষের ভিড়ে তার চোখের সামনে আস্তে আস্তে আরো কুৎসিত হতে থাকে মহানগরী, আস্তে আস্তে তার চারপাশের সড়ক ভরে ওঠে প্রকাণ্ড সব গাড়িতে, সেসব গাড়ি নবজাতকের দুঃখ নিয়ে তারস্বরে চেঁচায়, আর সমস্ত পৃথিবী কাঁপতে থাকে জলের নিচে মাছের আলোড়নে ত্রস্ত পদ্মের ডাঁটার মতো।
লীনার পৃথিবী এভাবেই কেঁপে উঠেছিলো, যখন এক শনিবার বিকেলে বাবাকে ফোন দিয়ে সে আর বাবার উত্তর শুনতে পায়নি। বরং অচেনা এক লোক তার নাম্বারে কল দিয়ে দায়সারা কণ্ঠে বলেছিলো, আপনাদের বাড়িতে পুরুষ লোক কে আছে, তারে ফোন দেন। শামীম ভাই ভুরু কুঁচকে ফোন ধরে হ্যালো বলার কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে তার মুখটা পাংশু হয়ে যায়, রুদ্ধ গলায় সে শুধু বলে, কেন, কেন, কারা করলো, কেন করলো? তারপর সে কাঁদতে থাকে তাদের চেনা পৃথিবীকে কম্পিত করে, বুক চাপড়ে শুধু বলে, আব্বারে আগুন দিয়ে মারি ফেলিছে। আগুন দিয়ে জ্যান্ত পুড়ায়ে মারি ফেলেছে আমার বাবারে। ইয়া মাবুদ, কেন?
লীনা পরে জানতে পারে, তার বাবার অপরাধ ছিলো, ইলিয়াস নামে কোনো এক হারিয়ে যাওয়া মানুষের খোঁজ না জেনেই রাজধানীর বিশ্বরোডের পাশে বাস থামিয়ে ভেতরে ঘুমিয়ে পড়া। শুক্রবার সারারাত গাড়ি চালিয়ে বাবা ঢাকায় গিয়েছে, একটু ঘুমোবে না সে? সোনাডাঙা থেকে দৌলতদিয়া, তারপর ফেরিঘাটের সেই দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষা, তারপর আবার পাটুরিয়া থেকে গাবতলি হয়ে ভোরে ঈগল পরিবহনের স্ট্যান্ড পর্যন্ত বাস চালিয়ে তার বাবা কোথায় ঘুমোবে? ঢাকায় কি তাদের ঘুমোনোর জন্য কোনো ঘর আছে? বাসের ভেতর ঘুমোনো কি অপরাধ এই শহরে? ইলিয়াসের খোঁজ ষোল কোটি মানুষের কেউ দিতে পারেনি, পরে টেলিভিশনে দেখেছে লীনা। কিন্তু ইলিয়াসের লোকজন দায়ী করেছে তার বাবাকেই।
কাকলী থেকে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে সুদৃশ্য সব ভবন আর মানুষের মুখ লীনার চোখ এড়িয়ে যায়। বাবার লাশটা ফিরিয়ে আনতে গিয়েও ভুগতে হয়েছে তাদের। তার বাবাকে শুধু ইলিয়াসের লোকেরাই দায়ী করেনি, বাসের মালিকও হয়তো মনে মনে দায়ী করেছে। বাবার সাথে সাথে বাসটাও পুড়ে ছাই হয়েছে, হয়তো সেই শোকেই কাতর ছিলো কাপড়িয়া সাহেব। দুই দুইজন মন্ত্রী তার পোড়া বাবার লাশটার কাছে এসে সাংবাদিকের মাইকের সামনে কথা বলা শুরু করেছে দেখেই হয়তো চক্ষুলজ্জার খাতিরে অ্যামবুলেন্সের ভাড়াটা পকেট থেকে বার করে দিয়েছিলো লোকটা। নাহলে হয়তো জাহেদ কাকাকে তার বাবার লাশ আনার জন্য এর ওর কাছে হাত পাততে হতো। বলতে হতো, আমার ভাইয়ের দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাটা কইরে দেন আপনারা বড় মানুষেরা, আল্লাহর দোহাই লাগে।
গুলশান ২ এ নামার সময় লীনার কানে ঝনঝন করে বাজছিলো মন্ত্রীদের মেকি আহাউহু কথাগুলো। নোংরা রাজনীতি, নেতিবাচক আচরণ পরিহার, আরো কিছু গম্ভীর ঝনঝনে শব্দের নিচে ক্যামেরার সামনে লজ্জিতের মতো চাদরের নিচে সবটুকু লুকিয়ে পড়ে ছিলো তার বাবা। দুই বাঘা বাঘা মন্ত্রীর ধবধবে পাঞ্জাবি পায়জামা আর কুচকুচে মুজিব কোটের সামনে সত্যটুকু সাদায় কালোয় পরিস্ফূট হয়ে ছিলো সে দৃশ্যে, নোংরা রাজনীতি আর নেতিবাচক আচরণের খেসারত সবটুকুই লীনার বাবাকে দিতে হয়েছে। মন্ত্রীরা কথা বলতে বলতে মুখস্থ গোলগোল শব্দগুলো হারিয়ে ফেলছিলো বারবার, সাংবাদিকরা ধৈর্যভরে তাদের গোঁফের নিচে মাইক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, এক পাশে বিরক্ত জ্বলজ্বলে চোখে দাঁড়িয়ে ছিলো বাসের মালিক, কোথাও দেখা যাচ্ছিলো না কাকাকে, আর মাঝে মাঝে করুণাভরে ক্যামেরার চোখ ফিরছিলো শায়িত বদর বেগের সজ্জিত অঙ্গারের দিকে। নোংরা রাজনীতি আর নেতিবাচক আচরণকে ঐ সাদা কাপড়টুকু দিয়ে যতোটুকু পারা যায়, ঢেকে রাখার চেষ্টা করছিলো এই শহরের মানুষেরা। দুই মন্ত্রীই টেলিভিশনের ওপাশে দেশের মানুষকে শুনিয়ে শুনিয়ে আশ্বাস দিয়েছিলেন, নিহতের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। তারপর শ্রমিক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে দশ হাজার টাকা ধরিয়ে দেওয়া হয় কাকার হাতে। ক্যামেরা আর মাইকের আশপাশে জড়ো হয়ে থাকা ধবধবে সাদা আর কুচকুচে কালো জামাকাপড় পরা মানুষেরা নীরবে বুঝিয়ে দেন, মাংস পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া ভাইকে নিয়ে বেড়াল পার হতে হবে জাহেদ কাকাকে।
ফুলতলায় বাবাকে ফিরিয়ে এনে কাপড় সরিয়ে নোংরা রাজনীতি আর নেতিবাচক আচরণ এক নজর দেখেছিলো লীনা। জ্ঞান ফেরার পর কাকা তাকে বলে, গোসল দেওয়ানো শেষ মা। তুই থাক, ভাইজানের কবরটা দিয়ে আসি। লীনার শুধু মনে হয়, বাবা আর কখনো দৌলতদিয়ায় থেমে ফোন করবে না তাকে, সকালে ঢাকায় পৌঁছে জিজ্ঞাসা করবে না তারা ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করেছে কি না, বাড়ি ফেরার পথে কাগজে মোড়ানো এক টুকরো তালমিছরি এনে দিয়ে বলবে না, এটা খেলি পরে পড়ালিখায় মাথা খোলে।
লীনা এক হাতে গ্যালনটা আঁকড়ে ধরে জাহেদের হাত ধরে পা চালায়। খুব বেশি দূরে নয় তার গন্তব্য।
জাহেদ থমকে দাঁড়ানোর পর লীনা ফুটপাথ থেকে মুখ তুলে প্রথমে কাকার দিকে, তারপর কাকার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকায়। তাদের একটু সামনে ক্লান্ত পায়ে হাঁটছেন এক মহিলা। তার হাত ধরে হাঁটছে এক কিশোরী। তার হাতে একটি গ্যালন।
পিয়া অবশ্য গ্যালনটা মায়ের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে আপত্তি করে না। তার বাহু অসাড় হয়ে আছে, তাই একটু পর পর গ্যালনটা মায়ের হাতে দিয়ে সে একটু বিশ্রাম করে নেয়। বাস থেকে কাকলীতে নেমে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ ধরে হাঁটতে হয়েছে তাদের।
মা বগুড়া থেকেই বলছিলো, গ্যালনটা একেবারে ঢাকায় গিয়েই ভর্তি করতে। পিয়া রাজি হয়নি। শহরটাকে চেনে না সে, তাই যা নেওয়ার, তা একেবারে বাড়ি থেকে ভর্তি করে নেওয়াই তার কাছে ঠিক মনে হয়েছে। নাহয় একটু কষ্ট করতেই হলো, বার বার, রোজ রোজ তো আর এই কাজ করতে হবে না। কিন্তু এখন পুরো কাজী নজরুল এভিনিউ পাড়ি দিয়ে তার মনে হচ্ছে, হয়তো মায়ের কথাই ঠিক ছিলো। কিন্তু, খালি গ্যালন নিয়ে এলে এখানেই বা কোত্থেকে ভর্তি করতে পারতো সে?
অগ্রহায়ণের আকাশ মা আর মেয়েকে উদার হয়ে ক্লান্ত করে। ছায়াহীন রাজধানীর পথ ধরে তারা মন্থর পায়ে হাঁটে, গন্তব্য খুব বেশি দূরে নয়।
পিয়ার চোখে ভাসে খবরের কাগজে দেখা তার বাবার জুতো পরা পোড়া পা, বাসের জানালা দিয়ে বেরিয়ে আছে। বাবার বাকিটুকু বাসের ভেতরে আগুনের ভীষণ কুণ্ডলীতে অদৃশ্য।
মা কিংবা পিয়া, কেউই প্রথমটায় ভাবেনি, নাসিরের পরিণতি এমন হতে পারে। পাগলাটে বাবা সারাদিন গান নিয়ে থাকে, হঠাৎ হঠাৎ এখানে ওখানে চলে যায়, দূর দূরান্তের ফাংশনে গিয়ে গান গায়, এর বাড়িতে ওর বাড়িতে থাকে, দশবার কল করলে একবার ধরে বলে, হুঁ হুঁ, আসবো তো, ভাত খেয়েছিস? আসবো আমি, ভাবিস না। ফাংশন শেষ করেই আসবো। তোর মা কী করে? ভাত খেয়েছে সে? তনয় কই?
বাবার ঐ জুতোপরা পা-টুকুই খটকা জাগিয়ে আর খটকা বাঁচিয়ে রেখেছিলো। বার বার কল দেওয়ার পরও যখন সে আর ফোন ধরে না, তখন মা পত্রিকা বুকে চেপে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো, চল পিয়া, থানায় যাই।
বগুড়া থেকে সিলেট বহুদূর। যমুনা আর মেঘনা নদী পাড়ি দিয়ে যেতে হয় চণ্ডীপুলে, যেখানে বাবার বাসটা পুড়িয়ে দিয়েছিলো ইলিয়াসের লোকজন। সবাই গাড়ি থেকে নেমে পালিয়ে যেতে পেরেছিলো, বাবা পারেনি। বাবা বুড়ো মানুষ, সত্তর বছর বয়স, দেখতে দেখতে বাসটাকে গিলে খেয়ে ফেলে আগুন, সাথে খায় বাবাকেও। বাবা হয়তো শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলো জানালা দিয়ে লাফিয়ে নামতে, পারেনি। তার একটা পা পৃথিবীর জন্যে জুতোটাকে রেখে গেছে, যাতে কন্যা আর স্ত্রী এসে তাকে শনাক্ত করতে পারে।
বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে মানিক পীরের টিলায় কবর হয়ে গিয়েছিলো বাবার। সেকেন্ড অফিসার আমিনুল ভদ্রভাবেই তাদের সঙ্গে কথা বলে, বাবার পরিচয়পত্র দেখতে চায়, তারপর বলে, আসেন আমাদের সঙ্গে।
থানায় জব্দ করা বাসের পোড়া কঙ্কালটা দেখিয়ে আমিনুল বলে, দেখেন আপনার বাবার কোনো জিনিস ভিতরে পান কি না। পিয়া সেই বাসের ভেতরে ছাই ঘেঁটে বাবার ঘড়ির বেল্ট আর ভিজিটিং কার্ডের অর্ধেকটা পায়। বাকি অর্ধেকের ছাই সেই বাসের ভেতরে পড়ে ছিলো, হয়তো বাবারও বাকি অর্ধেকের ছাইয়ের সঙ্গে।
পিয়া থানার টয়লেটের বেসিনে অনেক ক্ষণ ধরে হাত পরিষ্কার করার চেষ্টা করছিলো, কিন্তু তার মনে হচ্ছিলো, তার সারা শরীর একটু একটু করে ভরে যাচ্ছে বাবার ছাইয়ে।
ইলিয়াস কোথায়, বাবা জানতো না। বাবা জানতো শুধু গান। ইলিয়াসের লোকেরা যদি জিজ্ঞাসা করতো, তাহলেও হয়তো বাবার উত্তর দেওয়ার সুযোগ হতো। তারা কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। তারা জানতো, নোংরা রাজনীতি আর নেতিবাচক আচরণের জন্যে নাসিরকেই পুড়তে হবে। একের পর এক মোটর সাইকেলে চড়ে জোড়ায় জোড়ায় এসে শিবিরের ছেলেরা বাসে নিষ্ঠার সঙ্গে আগুন ধরিয়ে ফিরে গেছে দক্ষিণ সুরমায়।
পিয়া মায়ের হাত থেকে আবার গ্যালনটা নিজের হাতে নেয়। অগ্রহায়ণের আকাশের নিচে জ্বলতে থাকে ছায়াহীন নগর। তার নিচে পিয়া দেখতে পায়, অদূরে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক আস্তে আস্তে এগোচ্ছেন। তার অবসন্ন হাতে ঝুলছে একটা গ্যালন।
রমজানকে মনু আসতে দিতে চায়নি। বার বার বলছিলো, যাইয়েন না। আবার যদি আগুন দেয়, এইবার যদি আপনে মরেন? পোলাটারে তো মাইরা ফালাইলো, যাইয়েন না, বাড়িতে থাকেন, বাড়িতে।
রমজান তবুও বের হয়েছে। মনুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছে, লিখনরে দেইখো। আমার কিচ্ছু হইব না। কতদিন বাড়িতে বইসা থাকন যাইব? বাইর তো হইতেই হইব। আইতাছি আমি।
লিখন বাবাকে ছাড়তে চায় না তবু, সে এসে পা জড়িয়ে ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ভাইয়া মরে যাওয়ায় সে এখন খাটের পুরোটা অংশ জুড়ে শুতে পারে ঠিকই, কিন্তু রাতের বেলা তার ভয় করে। আগে ভাইয়ার ওপর ঘুমের ঘোরে পা তুলে দিলে ভাইয়া ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতো, বলতো, এই লিখন, সইরা ঘুমাও, ঠিকমত ঘুমাও। গায়ে পা দিও না। এখন ঐ শূন্যতার ধাক্কায় লিখনের ঘুম ভেঙে যায়, সে রাতের বেলা মাঝে মাঝে উঠে মাকে ডাকে। মনু পাগলের মতো ছুটে আসে, বলে, কী হইছে, কী হইছে লিখন? কই আগুন লাগছে?
অনেকটা জোর করেই লিখনকে নিজের শরীর থেকে ঠেলে দূরে সরিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছে রমজান। বারবার পেছনে তাকিয়ে দেখে, দরজার চৌকাঠে মাথা ঠেকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে মনু, তার গালে বিশীর্ণা নদীর মতো অশ্রুর হলরেখা, তার দৃষ্টি অনির্দিষ্ট অতীতের দিকে। লিখন মায়ের কোমরে মাথা ঠেকিয়ে রমজানকে দেখে, বাবা ঘাড় ফেরালে সে হাত নাড়ে।

রমজান গ্যালনটা নিয়ে জোরে পা চালায়। কালিয়াকৈর থেকেই গ্যালনটা ভর্তি করে এনেছে সে। গুলশানে কোথায় সে এই গ্যালন ভর্তি করবে?
ছেলেটা ঢাকা দেখেনি। বারবার ঘ্যান ঘ্যান করছিলো, চলো না আব্বা, নিয়া চলো। আমি তোমারে মাল তুলতে হেল্প করমুনি। ঢাকা দেইখা আসি, চলো।
ঢাকা দেখতে সমস্যা হয়নি কোনো। সেদিন নগরীতে উত্তাপ ছিলো, নিরুদ্বেগ ব্যস্ততাও ছিলো। নির্বিঘ্নেই ঢাকা দেখেছে রমজানের ছেলে, সদরঘাট দেখেছে, মোগলাই পরোটা আর পেপসি খেয়েছে এক দোকানে। ফেরার পথে গাজীপুর চৌরাস্তায় বসে বাপ ব্যাটা এক সঙ্গে নাস্তাও খেয়েছে। ডিম ভাজা দিয়ে পরোটা খেতে খেতে নিউজিল্যান্ড নিয়ে বকবক করছিলো ছেলেটা। কিচ্ছু পারে না এডি, আমাগো মাশরাফি আর সোহাগ গাজী আর রুবেল কি বলিং করছে, হ্যারা সবডি ম্যাচ হাইরা গেছে। বাংলাওয়াশ।
ছেলেকে ভ্যানের ভেতর বসিয়ে রাস্তাটা একটু উজিয়ে দেখতে যাওয়াই ভুল হয়েছিলো রমজানের। মিনিট পাঁচেক পর ফিরে এসে সে দেখে, যেখানে তার গাড়িটা থাকার কথা, সেখানে এক ভীষণ আগুনের কুণ্ড। আর তার পাশে রাস্তায় হাত পা ছড়িয়ে ছাই মাখা সঙের মতো কে যেন বসে। কাছে এসে তার বুক ধক করে ওঠে, কারণ ঐ গাড়িটা তারই ভ্যান, আর ঐ সং তারই দগ্ধ পুত্র। ছেলেটা কাঁপছিলো ঝড়ে সুপারি গাছের পাতার মতো, মুখে কোনো কথা নেই, একটা অস্পষ্ট অবিরাম গোঙানি শুধু শোনা যাচ্ছিলো। আশেপাশের লোকজন তাড়াতাড়ি অ্যামবুলেন্সে খবর দিয়ে বলেছিলো, ভাই ঢাকা মেডিকেলে লইয়া যান, দেখেন আল্লাহ রহম করে কি না। নিজেদের মাঝে নিচু স্বরে তারা কী বলছে, সেটাও রমজান শুনতে পেয়েছিলো।
তবুও বৃন্ত যেমন ফুলকে ধরে রাখে, সেভাবে আশা ধরে রাখে জীবনকে। বার্ন ইউনিটের ডাক্তারদের দেখে রমজান ভেবেছিলো, ছেলেকে নিয়েই বাড়ি ফিরতে পারবে সে। ছেলেটা তিন দিন ধরে শুধু গোঙাচ্ছিলো, ডাকছিলো আল্লাহকে, প্রত্যুত্তর শোনার ফুরসতও তার ছিলো না। ভোরের দিকে বাবাকে বলেছিলো, আব্বা, বাসায় যামু, বাসায় নিয়া চলো আব্বা, বাসায় যামু, মার কাছে যামু আব্বা। রমজানের মনের ভেতরে সামান্য একটু আশা বিশাল নিরাশাকে গলা টিপে ধরে বলছিলো, ছেলেটা ভালো হয়ে যাবে, ওকে একটা ক্রিকেট ব্যাট কিনে দিও, ভালো হয়ে যাবে ছেলে। কিন্তু ভোর যখন আরো পরিস্ফূট হয়, হাসপাতালের পাশে গাছের শাখায় মদকল পাখির গান শোনা যায়, তখন শেষবারের মতো খিঁচুনি দিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ব্যান্ডেজে মোড়া বাচ্চা ছেলেটা নিথর হয়ে যায়। ইলিয়াসের খোঁজ না জানার অপরাধেই কি জাতীয়তাবাদ আর ইসলামের বরকন্দাজরা পুড়িয়ে মারলো তাকে? নাকি নির্দলীয় সরকারের জন্যে একটাও নিরপেক্ষ লোকের নাম না জানার পাপে? অথবা সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়ে যাওয়ার সময় বাড়ি থেকে দূরে সন্ধ্যা পর্যন্ত কালৈয়াকৈরের গহীনে শালবন কেটে বানানো চকে ক্রিকেট খেলার স্পর্ধার শাস্তি দেওয়া হলো ওকে? ওর বেলায় অজুহাতটা কী ছিলো আসলে?
রমজান নিজের বাহুতে চোখ মুছে পা চালায়, তার হাতের গ্যালন হঠাৎ ত্বরণে একটু দুলে ওঠে।
রমজান দেখতে পায়, কয়েক গজ সামনে শ্লথ গথিতে পথ চলছে এক বোরখা পরা উত্তরযৌবনা, তার হাতে ধরা একটি গ্যালন। তার সামনে এক লুঙ্গি পাঞ্জাবি স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরিহিত বৃদ্ধ, তারও হাতে গ্যালন। তার সামনে আরো একজন। এবং আরো একজন। এবং আরো গ্যালন হাতে মানুষের সারি সামনে।

উত্তরমেঘ

অলকার প্রাসাদের মতো সুদৃশ্য বাড়িটির সামনে উর্দিপরা আর উর্দিছাড়া বলিষ্ঠ মানুষের ভিড়। ভিড়ের ফাঁকে বিদ্যুতের মতো দীপ্তিময়ী সুন্দরী রমণীও আছেন দুয়েকজন।
ইন্দ্রধনুর বিচিত্র বর্ণ নিয়ে সে প্রাসাদের দেয়াল সজ্জিত। কৃপাপ্রার্থী নারীদের হাতে সেখানে লীলাকমল, তাদের কেশপাশে কুন্দপুষ্প, লোধ্রপুষ্পের পরাগে তাদের মুখ পাণ্ডুর। সদাপুষ্পময় অলকার বৃক্ষের মতো সে প্রাসাদের চারপাশে মধুলোভী উন্মত্ত ভ্রমরকূলের মতো নেতা আর কর্মীদের সমাগম। দীপ্তিময় পুচ্ছের গৃহময়ূরের মতো সেখানে উপদেষ্টারা বিরাজমান, তাদের কেকাধ্বনিতে চারদিক মুখরিত। সেখানে আনন্দ থেকেই অশ্রু দেখা দেয়, অন্য কোনো কারণে নয়, সেখানে বেদনার একমাত্র কারণ পুষ্পশরাঘাত, তাও প্রিয়জনের সান্নিধ্যে ক্ষণিকের মাঝে তার মোচন হয়।
ক্রুদ্ধ কর্মীরা সে প্রাসাদের বাইরে গুঞ্জন করছে, সরকার পানির লাইন কেটে দিয়েছে। সকাল থেকে ম্যাডামের বাড়িতে পানি নাই। উপস্থিত পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনারের কাছে গিয়ে কৈফিয়ত দাবি করছে কেউ কেউ, কেউ কেউ বাড়ির আশপাশের পথে ক্ষণস্থায়ী মিছিল করছে, সিটি করপোরেশন কেন এখনও পানির ট্যাঙ্কার পাঠালো না, এ নিয়ে মোবাইল ফোনে ত্রস্ত উদ্বেগে উঁচু গলায় কথা বলছেন নেতাস্থানীয়রা।
দূরান্ত থেকে গ্যালন হাতে শোকশ্রান্ত মানুষের সারি এসে জমতে শুরু করে সে প্রাসাদের সামনে। পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া মানুষদের স্বজনেরা জানেন, এ প্রাসাদে বাস করেন কোনো এক বিরহী যক্ষী, আসনবিরহে যার বাহু থেকে শিথিল হয়ে পড়েছে স্বর্ণবলয়। দুইদিন ধরে তার কর্মীরা গর্জন করছেন, ম্যাডামের বাড়িতে পানি নেই।
সে প্রাসাদের বাইরে বলিষ্ঠ যুবাদের প্রহরা, তাদের প্রহরার স্তর শেষে পুলিশের প্রাচীর, সে প্রাচীরের ওপারে বিশেষ সিকিউরিটি ফোর্সের অবসরপ্রাপ্ত সেনাদের চক্রব্যূহ, আর সে চক্রব্যূহের কেন্দ্রে প্রাসাদের ভেতরে বিরহী যক্ষী এক প্রস্তরকঠিন নির্বিকার নিষ্করুণ ভালোবাসাহীন অনীহার অর্গল তুলে পাহারা দিচ্ছেন কোনো এক ভীষণ দুর্নিবার আগুনের শিখাকে, যে আগুন কেবল ছড়িয়ে পড়ে জনপদ থেকে জনপদে, শকট থেকে শকটে, মানুষ থেকে মানুষে।
স্বজনের অঙ্গার হাত থেকে মুছতে না পেরে স্বজনেরা সবাই এক এক গ্যালন পানি বয়ে এনেছেন যক্ষীর কাছে। সে প্রাসাদে সরকারবাহিত পানি যদি না-ও আসে, অগ্রহায়ণের আকাশের সূর্যকে ঢেকে কোনো মেঘ যদি না-ও ভাসে, নরমেধ যজ্ঞের ঐ শিখাটুকু কি তাদের নৈবেদ্যে নিভবে না? ভূমি ভেদ করে ভূকন্দলী ফুল বেরিয়ে এসে কি বলবে না, এবার পৃথিবী অবন্ধ্যা হবে?

সর্বরোগীহর

$
0
0
কয়েকদিন বাদেই কস্তুরের বিয়ে। তাই একটু অন্যমনস্ক হয়ে থাকে সে। অফিসে কেউ প্রথমবার ডাকলে সে সবসময় ঠিকমতো শুনে ওঠে না যেন, দ্বিতীয়বার একটু জোরে ডাকতে হয়।
সহকর্মীদের অনেকেই বিবাহিত। তারা কস্তুরের আসন্ন বিয়ের কথাও জানে। কস্তুরের মুখে অনেকে নিজের এক বছর, দেড় বছর, দুই বছর, কেউ কেউ পাঁচ বছর অতীতের বিম্ব দেখে মিটিমিটি হাসে। অবিবাহিত দুয়েকজন ডেঁপো তাকে এটা সেটা বলে লজ্জা দেওয়ার চেষ্টা করে। কস্তুর অবশ্য তাতে দমে যায় না। সে মিটিমিটি হাসে আর গোঁফে তা দেয়। তারপর আবার একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।
বসও এসে মশকরা করেন, বলেন, দেখো, কামের কল্পনায় যেন কাজে সমিস্যা না হয়। এখন থেকেই দুটোকে আলাদা করে ফেলতে হবে। সেপারেশন অফ স্টেট অ্যান্ড চার্চের মতো। অফিসে কাজ, বাড়িতে কাম। তাহলেই জীবনটা ধনধান্যেপুষ্পেবসুন্ধরায় একেবারে গিসগিস করবে।
ইন্টার্নশিপ করতে আসা দুটি টলটলে তরুণী সন্দেহভরা চোখে বস আর কস্তুরকে দেখে আড়চোখে।
কস্তুরের সহকর্মিনীরাও তাকে সাহস যোগায়। চম্পাচামেলি চৌধুরী বয়সে কস্তুরের চেয়ে বছর তিনেকের বড়, তিনি লাঞ্চে অকাতরে বিড়ি ফোঁকেন আর কস্তুরকে সাহস যোগান, বলেন, বাসর রাতে বেড়াল মেরে দিও। লজ্জা ঘেন্না ভয়, এ তিন থাকতে নয়।
বেড়ালের কথা শুনে কস্তুর আবার অন্যমনস্ক হয়ে যায়। বাসর রাতে প্রতীকী বেড়াল বধের উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠার বদলে একটা সুখসুখ স্বপ্নস্বপ্ন আলোআলো ভাব ফুটে থাকে তার চেহারায়।
কিন্তু যতোই দিন কাছে আসে, কস্তুর একটু একটু গম্ভীর হয়ে যায়। আগে যেমন কাজের ফাঁকে হঠাৎ একটু ব্রেক নিয়ে চেয়ারটায় হেলান দিয়ে টলটলে ইন্টার্ন মেয়েদের ফিরে অন্যমনস্ক হয়ে কী একটা ভাবতো সে, সেই ভাবনার আকাশে ঈশানাগত মেঘ যেন এ টি এম শামসুজ্জামানের মতো ভিলেনি আকার ইঙ্গিত দেয়।
বিবাহিত সহকর্মীরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে সমঝদারের হাসি হাসে। তারা জানে, জাহাজকে সতর্ক থাকতে হয় বন্দরের আশেপাশে এসেই। তীরবর্তী তরঙ্গেই তরীর তিরোধান ঘটে বেশি। তারা পিঠ চাপড়ে সাহস দেয় কস্তুরকে। টলটলে ইন্টার্ন মেয়েগুলো সাবধানে সবকিছু ঢেকেঢুকে বসে।
কিন্তু ক্রমশ কস্তুরের মুখের সুখচ্ছটা কমে আসতে দেখে একদিন অফিসের গুরুজনেরা ঠিক করেন, সময় হয়েছে। লাঞ্চের পর অবিবাহিত দুটো ছোকরাকে টলটলে ইন্টার্ন দুটোর সঙ্গে আরেক ব্রাঞ্চে পাঠিয়ে দিয়ে তারা পিয়ন বাদশাকে হাঁক দিয়ে বলেন, বাদশা রে, চা লাগা। এলাচি দিয়া গরম গরম তুরন্ত!
কস্তুর একটু উৎকণ্ঠিত চোখে অগ্রগামীদের মুখের দিকে তাকায়, কী যেন খোঁজে।
একজন বলেন, দ্যাখো, শুরুতেই বলি, এই যে গণ্ডারের শিং, বাঘের নুনু, তক্ষকের তেল, এগুলি আসলে কুসংস্কার। বুচ্ছো না?
কস্তুর নড়েচড়ে বসে।
পশুবান্ধব সহকর্মীটি জোর দিয়ে বলেন, আমি গ্যারান্টি দিয়া বলতে পারি, এইসবে আসলে কোনোই ফায়দা হয় না। সবই বোগাস। আরবান লিজেন্ড। যুগ যুগ ধরে চলে আসা মিথলজি, মেয়েদের অর্গাজমের মতোই। শিল্প সাহিত্যের চিপাচাপায় এইসব আছে, বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব নাই।
অন্যেরা একটু উসখুস করে। আনমনা হয়ে পড়েন দুয়েকজন, বাকিরা জোর গলায় সমর্থন দেন, ঠিক ঠিক।
বক্তা কস্তুরের ঊরুতে দুর্যোধনী চাপড় দিয়ে বলেন, কাজেই তুমি যদি এই মুক্তবাজার অর্থনীতিতে নেপাল বা আসাম থেকে গণ্ডারের শিং আনানোর অর্ডার দিয়াও থাকো, আমি শুধু বলবো, দ্যাট ওয়াজন্ট ওয়াইজ। গণ্ডারের শিং তো বাস্তবে গণ্ডারের লোম। গণ্ডারের শিং গুড়া করে দুধ আর চীনাবাদামের গুঁড়ার সঙ্গে মিশিয়ে কোঁৎ করে গিলে ফেললে যেসব ঘটনা ঘটে বলে প্রচার করা হয়, তা আসলে ঘটে না। নিশ্চিত থাকো।
কস্তুরের চেহারায় যেন সামান্য আশঙ্কার ছায়া পড়ে।
বক্তা বাঘের নুনু ও তক্ষকের তেল সম্পর্কেও জোর আশ্বাস দেন, কিছুই নাকি ঘটে না।
কস্তুরের মুখটা আরো এক পর্দা আঁধার হয়ে আসে।
একজন ক্ষীণ গলায় বলেন, ষাণ্ডার তেলে কিন্তু উপকার পাওয়া যায়।
এবার কস্তুর একটু ধাতস্থ হলেও পশুমিত্র তেড়ে আসেন চেয়ার ছেড়ে। তক্ষককে হিন্দিতে বলে ষাণ্ডা, তার তেলে কী এমন হাতিঘোড়া হতে পারে? তক্ষক কি সয়াবিন না নারিকেল যে তাকে পিষে তেল বার করতে হবে? আর সেই তেলে তো রোগ জীবাণু কিলবিল করবে। সেই তেল মাখার পর এঞ্জিন চিরতরে ডাউন হয়ে পড়বে না, তার নিশ্চয়তা দেবে কে?
তার আবেগমথিত ভাষণে ষাণ্ডার তেলের উপকারপন্থী একটু দমে যান। আরেকজন বলেন, ডাহুক পাখির মাংস ভুনা করে খেলে কিন্তু আসলেই শরীরে একটা জোশ আসে। সারাদিন মনমরা হয়ে ঘুরছেন, এক থাল ভাত খান ডাহুক পাখির গোশভুনা দিয়ে, দেখবেন কিছুক্ষণের মধ্যেই দুনিয়াটাকে মনে হবে নরম নরম, গরম গরম ... ।
অন্যেরা থামিয়ে দেন তাকে। পশুমিত্র কিছু বলেন না, আনমনে কী যেন ভাবেন।
ডাহুকলিপ্সু তবুও বকে চলেন, ইন্ডিয়াতে, এগজ্যাক্ট জায়গাটা মনে নাই, মহারাষ্ট্র না গুজরাট কোথায় যেন গোড়াবন পাখি পাওয়া যায়। আহা, গোড়াবন পাখির স্যুপ, একেবারে গুষ্টিশুদ্ধা চুপ!
আবারও থামিয়ে দেওয়া হয় তাকে।
ষাণ্ডার তেলবিলাসী বলেন, ডাহুক পাখির গোস্তের ব্যাপারে আসলে জোর দিয়ে কিছু বলা যায় না। আসলে দৈনিক কচুবনকে দিয়ে একটা জরিপ করানো প্রয়োজন। আজকাল জরিপ ছাড়া এভাবে কিছু বলা ঠিক না।
সবাই তাকে কড়া চোখের চাহনিতে পুড়িয়ে ছাই করে বসিয়ে দেন।
এতক্ষণ চুপ করে শোনা একজন বলেন, এ সবই হচ্ছে বেদেদের বুদ্ধি। এরা এইসব গণ্ডার ফণ্ডার, বাঘছাগ, তক্ষক টক্ষক, ডাহুক মাহুক ধরে, আর বোকাসোকা লোকজনকে সেগুলো গছায়। এইসব সেবন করে সাদেক হোসেন খোকা কখনও আলতাফ হোসেন গোলন্দাজ হতে পারবে না। আপনারা কেউ সাধনা ঔষধালয়ের মহাদ্রাক্ষারিষ্টের নাম শুনেছেন?
কস্তুরের মুখে আলোআলো ভাবটা ফিরে আসে। সে হৃষ্টচিত্তে বলে, আমি শুনেছি, আমি শুনেছি।
কামানরাঙা [অলঙ্করণ: সুজন চৌধুরী]
মহাদ্রাক্ষারিষ্টভক্ত গদগদ গলায় বলেন, আমাকে আমার এক বড় ভাই এর খোঁজ দিয়েছিলেন। নামে নয়, গুণে পরিচয়। আমি বলবো, কস্তুর, তুমি এটা এস্তেমাল করে দেখো। একদম শুরু থেকেই। শুরু থেকে শুরু করার কোনো বিকল্প নাই ভায়া।
বাদশা ট্রেতে এতক্ষণে চায়ের কাপ সাজিয়ে ঘরে ঢোকে। সবাই তড়িঘড়ি করে চায়ের কাপ টেনে নিয়ে যখন চুমুক দিচ্ছে, তখন বস মুখ খোলেন।
চায়ের কাপটিকে সানি লিওন জ্ঞান করে ফড়াৎকারে এক প্রলয়ঙ্করী চুমুক দিয়ে তিনি বলেন, কস্তুর, এইসব ফটকাদের কথায় কান দিও না। কলকাতায় শপিংটপিং করতে যদি যাওয়া হয়, ডাবুর শিলাজিৎ বা থ্রি নট থ্রি ক্যাপসুল আনাও। ব্যাক আপ হিসাবে কলিকাতা হারবাল।
এঁচড়ে পাকারা স্তব্ধ হয়ে যায়। কস্তুর প্যাড টেনে নিয়ে সাগ্রহে খসখস করে নোট করে।
আরেকটি জোরালো চুমুকের পর বস বলেন, অফিস শেষে একদিন হামদর্দ ঔষধালয়ে গিয়ে হানা দিও। বাদশাহী বটিকা অথবা সাফুকে সুজাক, কিংবা যদি তোমার প্রয়োজন পড়ে, দুইটাই।
কস্তুরের প্যাডে কলম দৌড়ায় জেরোনিমোর ঘোড়ার মতো।
বস এক একটি পিলেচমকানো চুমুক মেরে মেরে চায়ের কাপটিকে প্রথম দফায় তৃপ্ত রমণীর মতো হাফখালি করে এনে বলেন, বরযাত্রা তো যাবে চট্টগ্রাম, নাকি? আগেই কাউকে পাঠিয়ে দিও। কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের কী একটা সালসা আছে, নামটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তবে ওটায় মকরধ্বজ প্লাস সারিবাদ্যরিষ্ট প্লাস দশমূলারিষ্ট প্লাস স্বর্ণসিন্দুর প্লাস মহাদ্রাক্ষারিষ্ট। পশু পাখি সোনা দানা মূলা দ্রাক্ষা কোনো কিছুরই অভাব ওতে নাই রে বাছা।
কস্তুরের প্যাড থেকে সূক্ষ্ম ধোঁয়া ছোটে সিলিঙের পানে।
বস আড়নয়নে সবার দিকে চান একবার, তারপর আনমনে বলেন, তবে তোমরা আজকালকার পোলাপান। বড় হয়েছো ভ্যাজাল খেয়ে খেয়ে। দুধে পানি আর পাউডার, এক তেলে অন্য তেল, মরিচে ইটের গুঁড়া, লবণে আয়োডিনের অভাব। কেবল যে কোনো একটায় তোমাদের কাজ না-ও হতে পারে। সেক্ষেত্রে শক্তি ঔষধালয়ের মৃতসঞ্জিবনী সুরার সাথে উদ্যম সুধা, কিংবা ধরো গিয়ে সাধনা ঔষধালয়ের সারিবাদী সালসার সাথে ধনঞ্জয় মোদক মিলিয়ে সেবন করে দেখতে পারো। খোকাকে শুধু গোলন্দাজ হলেই চলবে না, ব্লিৎজক্রিগও চালিয়ে যেতে হবে সিজনের পর সিজন। হিটলারি হিটের জন্যে পারমুটেশন কম্বিনেশনের কোনো বিকল্প নাই।
ষাণ্ডার তেলবিলাসী কস্তুরের প্যাড থেকে পৃষ্ঠা ছিঁড়ে হাঁক ছেড়ে বলেন, বাদশা রে, ছয় কপি ফোটোকপি কর।
একজন ভয়ে ভয়ে বলেন, আমরা তো খালি এক দিকের কথা চিন্তা করছি, অন্য দিকের কথাও তো আমাদের ভাবতে হবে, তাই না?
বস নাক কুঁচকে বলেন, অন্য দিক মানে? য়্যাই খাচ্চর পোলা তুমি কী বলতে চাও, য়্যাঁ? এই বয়সেই এইসব কী?
কস্তুর তাড়াতাড়ি বলে, না না আপাতত একদিক নিয়েই আলোচনা হোক, একদিক নিয়েই।
লজ্জা পেয়ে সহকর্মী বলেন, আরে ধ্যৎ আমি বলতে চাচ্ছি, খালি কস্তুরের কথা ভাবলেই তো চলবে না। বাচ্চা একটা মেয়ের ওপর এইভাবে জেনেটিক্যালি মডিফায়েড হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া কি ঠিক? হারমিওনি গ্রেঞ্জারের ওপর হাল্ককে লেলিয়ে দিলে তো চলবে না।
কস্তুর শুধরে দেয়, বলে, জেনেটিক্যালি নয়, কেমিক্যালি। জেনেটিক্সের ব্যাপারগুলো অন্যরকম, পরে বুঝিয়ে বলবো'ক্ষণ।
বস হাসেন মিটিমিটি। বলেন, সে বন্দোবস্তও আছে বৈকি। আয়ুর্বেদ ও হেকিমী জগতে কোনো জেন্ডার বায়াস নাই। হামদর্দের রফিকুননেছা, সাধনার পতরঙ্গাসব, শক্তি ঔষধালয়ের লাবণী মোদক আছে, বেছে নাও যেটা খুশি! পারমুটেশন কম্বিনেশন রে বাছা, পারমুটেশন কম্বিনেশন।
কস্তুর ফোটোকপিয়ারের নিচে মিশনারি পজিশনে যাওয়ার আগেই পৃষ্ঠাটা আবার বাদশার হাত থেকে হাতিয়ে নিয়ে কলম ছোটায়।
বস নিজের কাপের চা শেষ করে বলেন, এককালে ঢাকায় হালুয়া পাওয়া যেতো নানারকম। পালংতোড়, বিজলি কা খাম্বা, উলট বব্বর, রাত বাকি বাত বাকি। তারপর ছিলো মশলা পান, কী সব বাহারি নাম তাদের ... ফিরে ফিরে আসি, যেও না সাথী, লৌহ কপাট কর রে লোপাট, পথে হলো দেরি, দীপ জ্বেলে যাই। আহ, কী দিনই না ছিলো সেসব। আজ আর কিছুই নেই। সেই পানও নাই সেই শানও নাই। কী সব ইয়াবা, বিজয় ট্যাবলেট, শক্তি দই ... অবক্ষয়, বুঝলে, অবক্ষয়!
কস্তুরের কলম পাওয়ার প্লে নিয়ে মাঠে নামে।
এদিক ওদিক দুদিক নিয়েই চিন্তা করা সহকর্মীটি এবার আবারো চিন্তিত হয়ে পড়েন। ভয়ে ভয়ে শুধান, আচ্ছা, মিয়া বিবি দুইজনই নাহয় অস্ত্রশস্ত্র বুঝে পেলো। কিন্তু পাড়াপড়শীদের কী হবে?
কস্তুরের মুখ অন্ধকার হয়ে আসে। সে ধরা গলায় বলে, আমার ঘরটা আসলে না খুব শক্তপোক্ত না। একটু জোরে সাউন্ড দিয়ে সিনেমা দেখলেও বাইরে থেকে শোনা যায়। মানে, ঐ যে ডকুমেন্টারি আর কি। প্রকৃতি, বিজ্ঞান, মহাবিশ্ব নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রের কথা বলছিলাম। যেগুলোতে অ্যাটেনবোরো, ব্রায়ান কক্স, এরা থাকেন। আমি তো এগুলোই দেখি। অন্য কিছু নয় কিন্তু।
বস শূন্য কাপটা তুলে নিয়ে আনমনে চুমুক দিতে গিয়ে আবার নামিয়ে রেখে বলেন, পাড়াপড়শীদের জন্যও ব্যবস্থা আছে বই কি। উত্তম ঘুমের জন্য শরবতের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়াতে পারো শক্তিশেল আয়ুর্বেদের নিদ্রানীহার, ভীমধ্বজ কেমিক্যালসের নিন্দিয়া কি বুন্দিয়া, যশোহর ঔষধালয়ের পড়শীপ্রিয় আরকশৃঙ্গার। আশেপাশের চল্লিশ বাড়ির মানুষকে বিলাতে হবে অবশ্য। তবে এর চেয়ে সহজ ব্যবস্থা হচ্ছে ইনজিনিয়ার ডেকে ঘরে ফলস প্যানেল বসানো।
কস্তুরের মুখে আবার সেই সুখচ্ছটা ফিরে আসে, সে সুখসুখ স্বপ্নস্বপ্ন আলোআলো মুখে প্যাড চুরমার করে শুধু নোট নিতে থাকে, নোট নিতে থাকে, নোট নিতে থাকে ... ।

অভিনন্দন হে পাত্র চোখ টিপি !
বিভিন্ন কারিগরি পরামর্শের জন্যে বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার ষষ্ঠ পাণ্ডবের কাছে।

বাসে আগুন দেওয়ার বিরুদ্ধে সাধারণের প্রস্তুতি কী হতে পারে?

$
0
0

পাবলিক বাসে বিএনপি ও জামাত-শিবিরের নেতা কর্মীরা যেভাবে নির্বিকার চিত্তে আগুন ধরিয়ে মানুষ খুন করছে, তা ঠেকাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কোনো উপযোগী কৌশল এখনও চোখে পড়ছে না। সংখ্যার অপ্রতুলতা এবং চোরাগোপ্তা হামলার ধরনের কারণেই প্রতিটি গণপরিবহনকে রক্ষা করা তাদের পক্ষে দুরূহ।

কিন্তু এ ধরনের অগ্নিসংযোগের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকেও প্রতিরোধ করে তুলতে হবে। তা না হলে সম্পদহানির পাশাপাশি প্রাণহানিও আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যেতে পারে।

এ ব্যাপারে সরকারের করণীয় অনেক কিছুই আছে। সবচেয়ে প্রথমে যে পদক্ষেপটি নেওয়া উচিত, তা হলো প্রতিটি পাবলিক বাসে একটি করে ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখার জন্য বাসমালিকদের নির্দেশ দেওয়া। পাঁচ কেজি ড্রাই পাউডার ভর্তি একটি ফায়ার এক্সটিংগুইশারের মূল্য মাত্র ১,২০০ টাকা। তাই অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতির বিপরীতে এই বিনিয়োগ বাস মালিকদের জন্য কোনো সমস্যাই নয়।

দ্বিতীয়ত, এই ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহারের জন্যে বাসচালক ও হেল্পারদের নিয়ে দমকল বিভাগ সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করতে পারে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, আগুন লাগলে মানুষের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হয় আগুন থেকে দূরে পালানো। অগ্নি নির্বাপনের জন্য প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, নাহলে ফায়ার এক্সটিংগুইশার বাসের সঙ্গে পুড়ে কালি হবে।

তৃতীয়ত, শুধু বাসচালক নয়, সাধারণ মানুষকে উদ্দেশ করেও ফায়ার এক্সটিংগুইশারের ব্যবহার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে এ প্রশিক্ষণটি ফায়ার ব্রিগেডের মাধ্যমে করানো সম্ভব হবে না, যেহেতু অডিয়েন্স অনেক বড়। তাই পত্রিকা ও টেলিভিশনকে এ ব্যাপারে এগিয়ে এসে সংক্ষিপ্ত তথ্যচিত্র নির্মাণ করে জনগণকে জনস্বার্থে প্রচারিত বিজ্ঞাপন হিসাবে দেখাতে হবে।



এছাড়া ইউটিউবে কীভাবে ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহার করতে হয়, তার নির্দেশিকাও রয়েছে অগণিত (উদাহরণ ০১)। নিজে দেখুন, পরিচিত সকলকে দেখান।

এ কাজ যতো দ্রুত করা সম্ভব হবে, ততো বেশি মানুষের প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব হবে।

এ ব্যাপারে পুলিশ, দমকল বিভাগ, মিডিয়া ও সরকারের আশু তৎপরতা দেখতে চাই।

ছাগদূতম

$
0
0


মানবাধিকারবার ঘটনাটা আজকাল ছোঁয়াচে
এতদিন করে যেতো শুধু হিউম্যান রাইটস ওয়াচে
অ্যামনেস্টিও মাঝে মাঝে বলে যেতো, এ কী কচ্ছো?
না না ভাই, তোমাদের বিচার তো অতীব অনচ্ছ!
চুপচাপ শুনে গিয়ে, যতোবার বলা হয় বুঝিয়ে
মানবাধিকারবারি জল ঘোলা করে আরো উজিয়ে।
গত ক'দিনের মাঝে মাথা গুণে দেখি, দিশা পাই নে,
মানবাধিকারবারি যতো আছে খাড়া এক লাইনে
চুনোপুঁটি অধিকার থেকে শুরু করে জাতিসংঘ
সব্বার চাপে কাঁপে গরিবের ভাবী এই বঙ্গ
কে যে কার আগে দেবে বিবৃতি, উদ্বেগ ও নিন্দা
উপদেশ একটাই, কসাই কাদেরে রাখো জিন্দা।
দিয়ো নাকো ফাঁসি তারে, ভারি বাজে মৃত্যুর দণ্ড
মানবতা হয় তাতে একেবারে পয়মাল, পণ্ড
না হয় মেরেছে কাদু দু'বছর বয়সের শিশুকে
তাই বলে ফাঁসি তার যায় মোটে মেনে নেওয়া কি সুখে?
হাত ফসকিয়ে তার গুলি ছুটে লোক মরে চারশো
তাই বলে ফাঁসি? হবে বড় বাজে প্রতিক্রিয়া পার্শ্ব
নুনু ফসকিয়ে কোনো একাদশী হলো ধর্ষিতা, তার
আগে খুন হয়ে গেছে ভাইবোনমাতা তার, পিতা তার?
যা হবার হয়ে গেছে, অতীতের এতো কথা ভুলিয়া
কসাই কাদেরে রাখো বাঁচিয়ে, ও ফাঁসি নাও তুলিয়া।
আহা বড় মায়া লাগে মানবাধিকারবারিগুলোকে
এতো ভালো লোক আর নাই বুঝি দ্যূলোকে ও ভূলোকে
কাদেরের তরে কাঁদে এক সুরে বৃদ্ধ ও জোয়ানে
কোথায় ছিলো রে এরা সে সুদূর সেভেন্টি ওয়ানে?
পোকামাকড়ের মতো মরেছে মানুষ এই দেশটায়
মানবাধিকারবারি তখন কি ছিলো কোনো চেষ্টায়
তিরিশ লক্ষ প্রাণ বাঁচানোর? হে হে, জাতিসংঘ!
ইতিহাসে লেখা তোর কুদরত রঙ্গবিরঙ্গ।
সারা দুনিয়ায় আছো যত চুতমারানির ছাও রে
পেয়েছো গরিব তাই কাছা তুলে পাছা মেরে যাও রে
শুনে রাখো, এ বিচারে কখনোই মৃত্যুর দণ্ড
যথেষ্ট নয়, ঐ অপরাধ এতোই প্রচণ্ড।
আমাদের পশ্চাতে অণুবীক্ষণ ধরে গু খুঁজে
আগে সাফ করে নাও নিজ পশ্চাতে হাগাটুকু যে।
জাতিসংঘের ছাতি ছায়া দেয় কসাইকে কিল্লাই?
বিবৃতি বাদ, আগে এ জবাব দেন, নাভি পিল্লাই।

বিজয় দিবসে বাংলাদেশের জন্মদিন না

$
0
0
বিজয় দিবসে জন্মদিন না, এ কথা জানে না বলো কে?
জানে ফুল ফল পাতা লতা পাখি
জানে মামি ফুপু জানে খালা কাকী
জানে খালবিল, জানে নদী নালা
জানে চাচা মামা ফুপা খালু শালা
জানে ফার্মের মুরগি পায়রা
বেয়াই শ্বশুর ননদ ভায়রা
জানে প্রতিবেশী দরদিয়া ভাবী
জানে প্রাইভেট মাদ্রাসা ঢাবি
জানে মজহার ফারুকী আমিষু
জানে কোল ধরে দোল খাওয়া শিশু
জানে বোকাসুধা আকাট বলদও।


জানে না মন্ত্রী পলকে।

বামাতির ছড়া ০০১

$
0
0
ফেসবুকে কিছু পড়শী
সদাই অনলবর্ষী
স্ট্যাটাসে আগুন জ্বলে শতগুণ "আমি বিপ্লব করসি!"
যখনই জামাত ধকলে,
তারা থেমে যান সকলে,
স্ট্যাটাসের খাতা ফুল-পাখি-পাতা-লতা নিয়ে যায় দখলে।
কভু ফুকো কভু গ্রামশি
তুলো ধুনে হলো আমসি
নামজাদা যতো বামজাদা কন, "শুরু হলে নাহি থামসি!"
মারা যায় যদি গোআ রে
বিপ্লবীদের খোঁয়াড়ে
দ্রোহের অনল নিভে গিয়ে ছোটে আগরবাতির ধোঁয়া রে।
ছাইভস্মতে ফুঁ দি না,
মুসলীম লীগ বাপের পুত্র বাম, তোগো মোরা চুদি না।

বোবায় ধরে যখন

$
0
0
নেহারুল বার বার জ্যামিতি বাক্স খুলে দেখে নিচ্ছিলেন, ভেতরে সবকিছু ঠিক আছে কি না। কাঁটাকম্পাস, চাঁদা, প্লাস্টিকের ছয় ইঞ্চি রুলার, পেন্সিল, পেন্সিলকাটুনি, পেন্সিলমুছুনি, প্রবেশপত্র, "আল্লাহু"লেখা একটা পিতলের ছোট্ট বোতাম। প্রতিবার জ্যামিতি বাক্স বন্ধ করার পর তাঁর মনে সন্দেহের একটা কাঁটা রুই মাছের ছোটো কাঁটার মতো ঘাই দিচ্ছে কেবল। সবকিছু কি নিয়ে এসেছেন তিনি? কোনো কিছু বাদ পড়েনি তো? বসে বসে আর কিছু করার নেই বলে একটু পর তিনি আবারও জ্যামিতি বাক্স খুলে হন্তদন্ত তদন্ত করেন। কাঁটাকম্পাসটার প্যাঁচ ঘুরিয়ে দেখে নেন, ঠিকমতো টাইট হচ্ছে কি না। আলোর দিকে তুলে চাঁদার গায়ে পঁয়তাল্লিশ আর ষাট ডিগ্রির মোটা দাগগুলোকে তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করে আবার যত্ন করে ঢুকিয়ে রাখেন বাক্সে। রুলারটার ধারে আঙুল বুলিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করেন, কোথাও কোনো খাঁজ ধরা পড়ে কি না।
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা দুই বগলে দুটো কাগজের বোন্দা নিয়ে ঘরে ঢুকতেই আশেপাশের সবাই চাবি দেওয়া পুতুলের মতো উঠে দাঁড়ালো। উপদেষ্টা টেবিলের ওপর বোন্দা দুটো সযত্নে নামিয়ে রেখে অলস হাত নেড়ে সবাইকে বসার ইঙ্গিত করেন।
নেহারুল বসতে গিয়ে পেছনে খোঁচা খেয়ে উহ করে ছিটকে সটান উঠে দাঁড়ান আবার। তাঁর আসনে পেন্সিল দাঁড় করিয়ে রেখেছে বেঞ্চের বাম পাশে বসা অসভ্য পরীক্ষার্থী।
বিশেষ উপদেষ্টা কড়া চোখে নেহারুলের দিকে তাকান। নেহারুল কাঁদো কাঁদো মুখে পাশের সিটের পরীক্ষার্থীকে দেখিয়ে বলেন, "স্যার, ও আমার সিটে পেন্সিল উঁচু কৈরা ধরছে স্যার। ব্যথা পাইছি।"
বিশেষ উপদেষ্টা পকেট থেকে ছোটো একটা প্লাস্টিকের হাতলওয়ালা নিরীহ চেহারার কাঁচি বের করে বোন্দার সুতো কাটতে কাটতে কড়া গলায় বললেন, "আহ, জাফর সাহেব, এসব কী হচ্ছে?"
নেহারুল সন্তর্পণে খুব খেয়াল করে আবার সিটে বসেন।
জাফর নামের বিটকেল পরীক্ষার্থী দাঁত বের করে হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে বললো, "আমার নাম জাফর। তোমার নাম কী?"
নেহারুল গোমড়া মুখে হাত বাড়িয়ে বললেন, "আমি নেহারুল ... এ কী? তোমার হাতে আঠা কেন?"
জাফরের দন্তপঙক্তি মুখের ভেতরের ছোট্ট ঘরে বেশিক্ষণ বদ্ধ থেকে অভ্যস্ত নয়, তারা জগৎটাকে দেখতে ব্যাকুল, হাসতে হাসতে সে বলে, "হ্যাঞ্ছেকের আগে হাতে ছ্যাপ দিয়া লৈছি।"
নেহারুল আঁ আঁ করে চিৎকার করে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, "স্যার, বাথরুমে যামু স্যার! এই জাফর আমার হাতে থুতু মাখায় দিছে স্যার!"
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তখনও কাঁচি দিয়ে বোন্দার সুতো কাটছিলেন, এবার তিনি মুখ তুলে চশমার ওপর দিয়ে কিছুক্ষণ আমলার চোখে নেহারুল আর জাফরকে দেখে নেন। নেহারুল ডান হাতটা বারবার প্যান্টের পায়ায় ঘষেন।
উপদেষ্টা আবার সুতো কাটতে কাটতে আমলার গলায় বলেন, "জাফর সাহেব, বি ওয়ার্নড। দিস সর্ট অফ টমফুলারি ইজ নট অ্যাডভাইজেবল অ্যাট অল ইন দ্য অগাস্ট প্রেজেন্স অফ অনারেবল ইনভিজিলেটরস। প্লিজ বিহেইভ ইয়োরসেলফ।"
জাফর নামের পরীক্ষার্থী মিহি গলায় বলে, "স্যার ইংরাজি বুঝি না। বাংলায় কন।"
উপদেষ্টা এবার কাঁচি টেবিলের ওপর রেখে চশমা খুলে হাতে নিয়ে জাফরকে মনোযোগ দিয়ে দেখেন। নেহারুল জাফরের দিকে বিবাদীর কম্পাসকঠোর আঙুল তাক করে বলেন, "স্যার ও ইংরেজি জানে না কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী হৈতে চায়। এদিকে আমার হাতে থুতু দিছে।"
উপদেষ্টা ঘোঁঁৎ করে একটা শব্দ করে বলেন, "মিস্টার নেহারুল, প্লিজ গো অ্যান্ড ওয়াশ ইয়োর হ্যান্ডস।"
নেহারুল কড়া চোখে জাফরের দিকে তাকান। জাফর দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলে, "মসিদের ইমাম উর্দুতে খোতবা কয়। পরীক্ষার হলের ইমাম ইংরাজিতে খোতবা কয়। কিচ্ছু বুঝি না। কী দ্যাশে যে আইলাম রে মামা!"
নেহারুল গট গট করে হল ছেড়ে বেরিয়ে এসে করিডোরের শেষ মাথার টয়লেটে ঢুকে বেসিনে ট্যাপ ছেড়ে পানির ধারার নিচে ডান হাত গুঁজে দেন। পরীক্ষার শুরুতেই একটা অঘটন ঘটলো। বাকি পরীক্ষা কেমন হয় কে জানে?
বাথরুমের ঘোলা আয়নায় নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে নেহারুল শিউরে ওঠেন। গভীর রাত পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন তিনি। পুরো সিলেবাস ভাজা ভাজা করেছেন, সব সূত্র মুখস্থ করেছেন, টেস্ট পেপার খুলে নমুনা পরীক্ষা দিয়ে হাতের লেখার গতি খতিয়ে দেখেছেন, শেষমেশ বলপয়েন্ট কলমগুলো খুলে এক দুই লাইন করে লিখে সেগুলোর মান যাচাই করে কলমের বাক্সে ভরে তারপর এক গ্লাস দুধ খেয়ে শুয়ে পড়েছেন। কিন্তু সারারাত ঠিকমতো ঘুম হয়নি, ছটফট করে এপাশ ওপাশ করে শুয়েছেন, শেষটায় অন্ধকার আকাশ থেকে পুরোপুরি মিলিয়ে যাবার আগেই উঠে পড়েছেন। অনিদ্রিত রাত ফুরিয়ে যাবার আগে তাঁর চোখের নিচে তিলক কেটে রেখে গেছে অন্ধকার হাতে।
আঁজলা ভরে পানি নিয়ে নিজের মুখে ছিটাতে ছিটাতে নেহারুল টের পেলেন, ভীষণ ঘুম পাচ্ছে তাঁর। একটু চা খেতে পারলে বড় ভালো হতো। কিন্তু যানজট এড়িয়ে আগে আগে পরীক্ষার হলে পৌঁছানোর জন্য হুড়োহুড়ি করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছেন তিনি, চায়ের কাপে কোনোমতো দুটো চুমুক দিয়েই। মুখ ধুতে ধুতে নেহারুল সিদ্ধান্ত নেন, পরীক্ষায় পাশ করে আবার শিক্ষামন্ত্রী হতে পারলে তিনি পরীক্ষার হলে চা খাওয়ার অনুমতি দিয়ে আইন পাশ করাবেন। জামাতার কাছে শুনেছেন, বিদেশে পরীক্ষার হলে ছেলেপিলে কফির ফ্লাস্ক নিয়ে বসে, কুটকুট করে চকলেট বার চিবাতে চিবাতে পরীক্ষার খাতায় হিজিবিজি লেখে। তাঁর দেশ আর কতো কাল পিছিয়ে থাকবে?
পকেট থেকে চেক কাটা রুমাল বের করে নিজের হাত মুখ মুছে নেহারুল আবার পরীক্ষার হলে ফিরে এলেন।
বিশেষ উপদেষ্টা হলঘরে পায়চারি করছিলেন, নেহারুলকে হলে ঢুকতে দেখে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। তারপর গটগটিয়ে কাছে এগিয়ে এসে বললেন, "মিস্টার নেহারুল, হ্যাভ ইউ এনি আইডিয়া, হোয়াট টাইম ইট ইজ? এগারোটা বাজে। আপনি পরীক্ষা দেবেন কখন?"
নেহারুলের বুক ধক করে ওঠে। এগারোটা বেজে গেলো? পরীক্ষা তো বারোটায় শেষ। তিনি এখন তিন ঘণ্টার পরীক্ষা এক ঘণ্টায় শেষ করবেন কীভাবে?
নেহারুল পাগলের মতো ছুটে গিয়ে নিজের আসনে বসে পরীক্ষার খাতা আর প্রশ্নপত্র টেনে নিলেন। জ্যামিতি বাক্স খুলতে গিয়ে টের পেলেন, বাক্স জাম হয়ে গেছে, খুলছে না কিছুতেই। কলমের বাক্স থেকে কলম টেনে নিয়ে বের করে দেখলেন, কলমের কালি প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। বাক্স হাঁটকে কেবল কণ্ঠার কাছে একটু নীল জমে থাকা মন্থিতসমুদ্রবর্তী শিবের মতো একটা কলম খুঁজে পেলেন তিনি, সেটা নিয়ে খাতা টেনে লিখতে গিয়ে থমকে গেলেন তারপর।
এসব কী প্রশ্ন এসেছে?
প্রশ্নপত্রের পাতা উল্টাতে গিয়ে নেহারুলের মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। এ কী? এসব কী প্রশ্ন? এতো কঠিন কেন? অঙ্কগুলো এতো লম্বা কেন? কোন সূত্র খাটবে এখানে? এসব শব্দের মানে কী? উপপাদ্য সম্পাদ্য এগুলো কোন বই থেকে এসেছে? ভাব সম্প্রসারণের নিচে লেখা লঁফে, সে লেজেক্সামাঁ দেজোথ। এর মানে কী?
পাশ থেকে জাফর দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলে, "মামু, রফাটটা এট্টু দ্যাও দেহি!"
নেহারুল ফুঁসে উঠে বলেন, "রফাট? হোয়াট দ্য হেল ইজ রফাট? ইটস কল্ড ইরেইজার!"
বক্তৃতা মঞ্চের ওপরে দাঁড়িয়ে বিশেষ উপদেষ্টাও বলেন, "ইয়েস, ইটস কল্ড ইরেইজার। দেয়ার ইজ নো সাচ থিং ইন দিস ওয়াইড ওয়াইল্ড ওয়ার্ল্ড টু বি অ্যাড্রেসড বাই দ্য ইগনোমিনিয়াস নেইম অফ রফাট। ঔনলি ইন দি ডিপেস্ট ডারকেস্ট ডানজন অফ দ্য ডিভিয়াস ডেলিঙ্কোয়েন্ট ড্রাকুলা মে ওয়ান অর টু রফাটস ক্রল অ্যান্ড ক্রাউচ।"
জাফর দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলে, "এত্তো ইংরাজি! বাপরে বাপ, আমার রফাট লাগতো না!"
নেহারুল চোখ পাকান। জাফর কাছে ঘেঁষে এসে ফিসফিসিয়ে বলে, "আমার পরীক্ষা শ্যাষ। তোমার পরীক্ষা ক্যামন হইছে?"
নেহারুল প্রাণপণে পরীক্ষার খাতার ওপরে নিজের নাম, ক্রমিক নং, নিবন্ধন নং, জাতীয় পরিচয়পত্রের নং, বাবার নাম, মায়ের নাম, উপজেলা, পোস্ট অফিস, পাসপোর্ট নং, মালয়েশিয়ায় খালাতো শালার সেই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নং, সব লিখতে লিখতে টের পান, কলমের কালি ফুরিয়ে আসছে। ফুঁপিয়ে উঠে তিনি বলেন, "আমি তো পরীক্ষা দিতেই পারলাম না। এতো কঠিন কঠিন প্রশ্ন!"
জাফর হাসতে হাসতে বলে, "প্রশ্ন কঠিন তো কী হইছে? ফেসবুকে তো প্রশ্ন উত্তর সবই দিয়া দিছে। তুমি পাও নাই?"
নেহারুল কলম তুলে বাতাসে ঝাড়তে ঝাড়তে খাতায় হিজিবিজি লিখতে গিয়ে থমকে গেলেন। "প্রশ্ন ফেসবুকে চৈলা আসছে?"
জাফর চোখ টিপে বলে, "হ, গত পরশুই তো চৈলা আসছে। আহারে, তুমি পাও নাই, তাই না? তোমার আব্বা আম্মা তোমারে প্রশ্ন যোগাড় কইরা দেয় নাই?"
নেহারুল উদভ্রান্তের মতো ডানে বামে তাকান। ডানে বামে দিগন্তের কাছে গিয়ে মিলিয়ে গেছে পরীক্ষার হলের দেয়াল। তার নিচে লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি পরীক্ষার্থী আড়মোড়া ভাঙছে, কেউ কেউ ফ্লাস্ক খুলে চা খাচ্ছে বিদেশী ছাত্রদের মতো, কেউ কেউ বিড়ি টানছে, নিজেদের মধ্যে গল্পগুজবও করছে। সবার মুখ হাসি হাসি। ওদের সবার পরীক্ষা ভালো হয়েছে। প্রশ্ন কমন পড়েছে। ওদের বাবা মা ওদের প্রশ্ন যোগাড় করে দিয়েছে, সল্ভ করে দিয়েছে। নেহারুলের বাবা মা কোথায় ছিলেন গত পরশু দিন?
বক্তৃতা মঞ্চ থেকে চশমার ওপরে দুটো জ্বলন্ত আমলার চোখ নেহারুলের দিকে তাক করে বিশেষ উপদেষ্টা বললেন, "মিস্টার নেহারুল, হ্যাভ ইউ কোয়াইট ফিনিশড অলরেডি?"
নেহারুল ডুকরে কেঁদে উঠে বলেন, "স্যার স্যার স্যার, আমার প্রশ্ন কমন পড়ে নাই স্যার! ইটস নট ফেয়ার স্যার! সবার পরীক্ষা ভালো হয় কীভাবে?"
বিশেষ উপদেষ্টা একটা হলদে আমলার হাসি হেসে বললেন, "উই আর বাউন্ড টু পিক ঔনলি দ্য ভেরি বেস্ট, মিস্টার নেহারুল। আপনার পরীক্ষা কেমন হচ্ছে?"
নেহারুল উঠে দাঁড়িয়ে ধরা গলায় বলেন, "স্যার, এটা অন্যায়। সবার পরীক্ষা ভালো হলে সবাই এ প্লাস পাবে। তখন শিক্ষামন্ত্রী হবে কে?"
এবার বিশেষ উপদেষ্টা এগিয়ে এসে হাই বেঞ্চের ওপর এক পাটি পাছা পেতে বসে একটা পা দোলাতে দোলাতে হাসিমুখে বলেন, "সবাই যদি এ প্লাস পায়, সবাইকে শিক্ষামন্ত্রী বানানো হবে। কোনো সমিস্যা?"
জাফরও হাসতে হাসতে একটা পেন্সিল উঁচিয়ে বলে, "কোনো সমিস্যা?"
হলভর্তি পরীক্ষার্থী এবার নেহারুলের দিকে ঘুরে তাকিয়ে সমস্বরে বলে, "কোনো সমিস্যা?"
নেহারুল উদভ্রান্তের মতো ডানে বামে তাকান। বিশেষ উপদেষ্টা তাঁর গলা চেপে ধরে, দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে তাঁর। ওদিকে জাফর তাঁরই জ্যামিতি বাক্স অবলীলায় খুলে ভেতর থেকে পেন্সিলকাটুনি বের করে তার ভয়ানকদর্শন পেন্সিলটাকে চোখা করতে থাকে। পেন্সিলের চোকলা বের হতে থাকে সমানে, ক্রমশ চোকলায় ঢেকে যায় বেঞ্চ, এর মাঝে ছোট্টো গোল একটা ফাঁকা জায়গায় জাফর তার কালান্তক পেন্সিলটাকে সটান উঁচু করে পেতে রাখে। বিশেষ উপদেষ্টা নেহারুলের গলা টিপে ধরে তাঁকে সেই পেন্সিলের ওপর বসিয়ে দেন।
হলভরা লোকে স্নেহসিক্ত কণ্ঠে শুধায়, "কোনো সমিস্যা?"
নেহারুল ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর অনুভব করেন, তাঁর সারা শরীর ঘামে ভিজে আছে। ডালিয়া তাঁর কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করছে, "অ্যাই, কী হইছে? কোনো সমিস্যা?"
নেহারুল চুনকাম করা সিলিঙের দিকে তাকিয়ে পরম স্বস্তি বোধ করেন। আহ, পরীক্ষার হলে নেই তিনি। এসব পরীক্ষাটরীক্ষার দিন বহু আগেই পার করে এসেছেন।
ডালিয়া বিছানার পাশে রাখা তেপায়ায় ঢাকনা দিয়ে রাখা পানির জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে নেহারুলের দিকে এগিয়ে ধরে, "তোমারে বোবায় ধরছিলো। ন্যাও পানি খাও।"
নেহারুল ঢক ঢক করে পানি খেয়ে গ্লাস শূন্য করে আবার ডালিয়ার দিকে বাড়িয়ে ধরে অস্ফূটে বলেন, "আরেকটু ...।"
ডালিয়া জগ থেকে পানি ঢালে। নেহারুল চোখ বন্ধ করে পরম তৃপ্তির সঙ্গে স্মরণ করেন, পরীক্ষার বিভীষিকাময় দিন ফুরিয়েছে তাঁর। এখন আর কোনো পরীক্ষা নেই। জেগে থাকা আধো ঘুমের রাতভর উৎকণ্ঠা, সকালে পরীক্ষার আগে রিকশা সিএনজি পাকড়ে যানজটের অংশ হওয়ার তাড়া, যানজট ঠেলে সময়মতো হলে পৌঁছানোর দুশ্চিন্তা, পরীক্ষায় প্রশ্ন কমন না পড়ার আঘাত, কিছুই নেই। এ যেন নরকবাসের সাজা থেকে বেকসুর খালাস। আসলেই তো, লঁফে, সে লেজেক্সামাঁ দেজোথ। নরক, সে তো অন্য লোকের পরীক্ষা। কে বলেছিলো কথাটা? জঁ পল সাখথ? নাকি মিশেল প্লাতিনি?
ডালিয়া পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় তাঁর দিকে। নেহারুল গ্লাসে রসিয়ে রসিয়ে ছোটো ছোটো চুমুক দেওয়ার ফাঁকে বলেন, "বোবা খালি একা আমারে ধরে নাই বৌ। গোটা জাতিরেই ধরছে। দেখি, পাশ ফিরা শুই আবার।"

পিএসসি আর জেএসসি পরীক্ষার কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে?

$
0
0
বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রের সাম্প্রতিক সংযোজন পিএসসি আর জেএসসি পরীক্ষা শিক্ষার মানোন্নয়নে কী ভূমিকা রাখছে, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত ছাত্র-অভিভাবকদের সামনে হাজির করেছেন কি না, আমার জানা নেই। কয়েকটি বিষয় মাথায় রেখে একটু চিন্তা করলে মনে হয়, গুটিকয় বাটপার ছাড়া এই দুই পাবলিক পরীক্ষা বৃহত্তর জনসমাজের আর কোনো কাজে আসবে না।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিকের জন্যে ৫ বছর, মাধ্যমিকের জন্যে ৫ বছর আর উচ্চ মাধ্যমিকের জন্যে ২ বছর সময় বরাদ্দ করা আছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও কম বেশি একই স্তরে বিভক্ত। প্রাথমিক স্তরের একটি স্কুল থেকে মাধ্যমিক স্তরের আরেকটি স্কুলে যাওয়ার জন্যে ভর্তি পরীক্ষায় বসতেই হয়, প্রাথমিক স্তরের স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার ফল তাতে খুব একটা কাজে আসে না। একইভাবে মাধ্যমিক স্তরের স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কলেজে ভর্তি হতে গেলেও ভর্তি পরীক্ষায় বসতে হয়, উচ্চ মাধ্যমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে গেলেও ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়। কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে এসএসসির ফল একটি মোটাদাগের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির ক্ষেত্রে এসএসসি আর এইচএসসি পরীক্ষার ফল সম্মিলিতভাবে মোটাদাগের নিয়ামকের কাজ করে। এই নিয়ামক দিয়ে কারা ভর্তি পরীক্ষায় বসার যোগ্য হবে, সেটি ঠিক করা হয় কেবল। বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে ভর্তি পরীক্ষার ফলের।
যদি নামী স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষার জন্য পিএসসির ফলকে নিয়ামক হিসেবে গ্রহণ করার রেওয়াজ শুরু হয়, সেক্ষেত্রে এই পরীক্ষাকে যৌক্তিক বলে মনে করা যেতে পারে। কিন্তু জেএসসি পরীক্ষার যৌক্তিকতা কোথায়? মাধ্যমিক স্কুলে অষ্টম শ্রেণীর পর একই স্কুলের নবম শ্রেণীতে শিক্ষালাভের সুযোগ থাকে, আরেকটি ভিন্ন শিক্ষায়তনে ভর্তির জন্যে নিয়ামক হিসেবে এই পরীক্ষার ফল ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। এই পরীক্ষাটি তাহলে কেন নেওয়া হচ্ছে?
আরেকটু তলিয়ে দেখলে আমরা দেখবো, এক স্কুলের পঞ্চম শ্রেণী থেকে আরেকটি স্কুলের (অপেক্ষাকৃত "ভালো") ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তির জন্যে অভিভাবকদের প্রত্যাশাজতিন যে চাপ থাকে, তার সঙ্গে কোচিং ব্যবসার সরাসরি যোগ আছে। অভিভাবকদের এই আকুতিকে কাজে লাগিয়ে কোচিং সেন্টারগুলো ব্যবসা করে, এবং পঞ্চম শ্রেণী থেকে ষষ্ঠ শ্রেণীতে উত্তরণের জন্যে ভর্তি প্রক্রিয়াটিকেও বাণিজ্যিকীকরণের সুযোগ এই পিএসসির মাধ্যমে প্রশস্ত হচ্ছে।
এখানেই প্রশ্নফাঁসের অর্থনীতি একটু খতিয়ে দেখতে হবে। এককালে টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন বিক্রি হতো, সে বাণিজ্যের অর্থনীতি নিষিদ্ধ মাদক বাণিজ্যের অর্থনীতির মতো। কিন্তু এখন প্রশ্ন চলে আসছে ফেসবুকের বিভিন্ন পেইজে, এবং সরাসরি শিক্ষামন্ত্রক থেকে এই ফাঁসের ব্যাপারটিকে হয় অস্বীকার করা হচ্ছে, নয়তো তাচ্ছিল্যের সাথে দেখা হচ্ছে। মোবাইল-ফেসবুক বন্ধ করে দেওয়ার মতো নির্বোধ আহাম্মকি কথাবার্তা বলে কর্তাব্যক্তিরা মানুষের মনোযোগকে অন্যদিকেও নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ফেসবুকে ফাঁস করা প্রশ্নের অর্থনীতিটা ভিন্ন, এখানে প্রশ্নটি আর টাকার বিনিময়ে ক্রয়যোগ্য পণ্য নেই, বরং আরেকটি ভিন্ন ও বৃহত্তর বাণিজ্যের দিকে এই ফাঁস-হওয়া-প্রশ্নের-ভোক্তাকে (অর্থাৎ অভিভাবক) ঠেলে দেওয়ার একটি মাধ্যমমাত্র।
সে আলোচনার আগে একটু চিন্তা করে দেখি, প্রশ্ন ফাঁস হলে কী হয়? একবার প্রশ্ন ফাঁস হয়ে গেলে এবং নাগালের ভেতরে থাকা উন্মুক্ত মাধ্যমে (যেমন ফেসবুকে) চলে এলে পরীক্ষার্থীর সামনে দুটি পথ থাকে, হয় প্রশ্নটি যোগাড় করে কাজে লাগানো (অসৎ পদ্ধতি), নয়তো প্রশ্নটি উপেক্ষা করে নিজের প্রস্তুতির ওপর ভরসা রাখা (সৎ পদ্ধতি)। এখন যদি দবীর আর কবীর নামের দু'জন "লেখাপড়ায় মোটামুটি ভালো"পরীক্ষার্থীর মধ্যে যদি তুলনা করে দেখি, তাদের গেম মেইট্রিক্স হবে এমন:
এখানে মনে রাখা ভালো, দবীর বা কবীর কেউ উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন ফাঁস করিয়ে আনছে না, তারা নিরীহ পরীক্ষার্থী, এবং প্রশ্ন ফাঁস তাদের উদ্যোগ ছাড়াই ঘটে যাচ্ছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কাজে না লাগালে দবীর বা কবীর বড়জোর এ মাইনাস পাবে, কিন্তু কাজে লাগালে তারা এ প্লাস পাবে। এরকম পরিস্থিতিতে দবীর আর কবীর, দু'জনের জন্যেই ডমিন্যান্ট স্ট্র্যাটেজি বা লাভজনক কৌশল হচ্ছে অসৎ হওয়া। এবং শেষ পর্যন্ত তারা দু'জনই অসৎ হবে, এটাই এই গেমের ন্যাশ ভারসাম্য। প্রশ্ন ফাঁসের গেমে যেসব "লেখাপড়ায় মোটামুটি ভালো"রা সৎ থাকবে, তারা পরীক্ষার ফলের বিচারে অন্যদের তুলনায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটা পিএসসি পরীক্ষার্থীরা ঠিকমতো না বুঝলেও তাদের অভিভাবকরা বোঝেন, এবং সোৎসাহে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন যোগাড় করে সন্তানকে দেন।
কাজেই প্রশ্ন ফাঁস করে উন্মুক্ত ডোমেইনে তুলে দিলে একটা জনগোষ্ঠীর বড় অংশ তাৎক্ষণিক লাভের আশায় অসৎ হয়ে পড়ে।
শিক্ষামন্ত্রক এই পরিস্থিতির জন্যে এককভাবে দায়ী। পরীক্ষার্থী বা অভিভাবকদের ঘাড়ে দোষ দেওয়া নিরর্থক, কারণ তারা প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার প্রক্রিয়াটি উদ্যোগ নিয়ে ঘটাচ্ছে না।
উন্মুক্ত ডোমেইনে প্রশ্ন ফাঁস করে দিলে প্রশ্নটির আর পণ্যমূল্য থাকে না, কিন্তু সেটি বাজারে ভালো ফলের একটি বাড়তি সরবরাহ তৈরি করে। যেসব পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে, সেসব পরীক্ষায় যারা এ প্লাস পাচ্ছে, তাদের মধ্যে কারা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কাজে লাগিয়েছে, আর কারা লাগায়নি, তা বোঝার উপায় কারোই থাকে না। পরীক্ষা নেওয়ার অনেক উদ্দেশ্যের মধ্যে একটি হচ্ছে পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষার গুরুত্ব অনুধাবনে সমর্থ করে তুলে অনাগত জীবনের নানা পরীক্ষার জন্যে প্রস্তুত করা, আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি জনগোষ্ঠী থেকে যোগ্যতর একটি অংশকে সে জনগোষ্ঠীর জন্যে বিভিন্ন ভূমিকায় কাজে লাগানোর জন্য কম যোগ্যতরদের থেকে পৃথক করা। প্রশ্ন ফাঁস করলে এ দুটি উদ্দেশ্যই মার খায়। তাহলে কোন উদ্দেশ্য সাধিত হয়?
পিএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসকে যদি আমরা নমুনা আলোচ্য হিসেবে ধরি, তাহলে আমরা দেখবো, বাংলাদেশে যতো সংখ্যক ভালো মাধ্যমিক স্কুল আছে, ততো সংখ্যক ভালো প্রাথমিক স্কুল নেই। কাজেই প্রাথমিক স্কুলের ভালো ছাত্ররা যদি পিএসসি পরীক্ষায় ভালো করে, এবং প্রাথমিক স্কুলের মাঝারি ও খারাপ ছাত্ররা যদি পিএসসি পরীক্ষায় খারাপ করে, তাহলে মাধ্যমিক স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীতে কেবল পিএসসি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতেই তাদের ভর্তি করা সম্ভব হতো, কিংবা অন্তত পিএসসি পরীক্ষার ফলকে ষষ্ঠ শ্রেণীর ভর্তি পরীক্ষায় একটি জোরালো নিয়ামক হিসেবে ব্যবহার করা যেতো। এটিই স্বাভাবিক এবং আদর্শ পরিস্থিতি। কিন্তু এই পরিস্থিতি ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি প্রক্রিয়ায় কোচিং বাণিজ্যবান্ধব নয়। কোচিং ব্যবসা তখনই জমবে, যখন ভর্তি পরীক্ষার্থীদের জোরালো নিয়ামকের ভিত্তিতে আর ফিল্টার করা যাবে না। উন্মুক্ত ডোমেইনে প্রশ্ন ফাঁস করে দিলে এই ব্যাপারটিই ঘটে, মুড়ি-মুড়কি সব সমান দর হয়ে পড়ে। মাঝারি মাপের কবীর ও দবীর তখন ভালো মাপের সগীরের সঙ্গে এ প্লাস পেয়ে এক কাতারে চলে আসে। এবং যেহেতু নিজেদের মধ্যে আর পৃথক করার মাপকাঠি অবশিষ্ট থাকে না, কবীর-দবীর-সগীর তিনজনই তখন কোচিং বাণিজ্যের ভোক্তায় পরিণত হয়।
একই প্রক্রিয়া এসএসসি ও এইচএসসির ক্ষেত্রেও খাটে।
আমার বিবেচনায় জেএসসি সম্পূর্ণ নিরর্থক একটি পরীক্ষা, যেটি কোনো বাছাইয়ের কাজে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবে না। যেহেতু এক ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উত্তরণের প্রশ্নও এক্ষেত্রে নেই (যে স্কুলে অষ্টম শ্রেণী আছে, সেখানে নবম ও দশম শ্রেণীও থাকে), এই পরীক্ষাটি কেন নেওয়া হচ্ছে, সে উদ্দেশ্যও স্পষ্ট নয়। কিন্তু পাবলিক পরীক্ষা মানেই প্রতিযোগিতা, এবং অভিভাবকদের পক্ষ থেকে সে পরীক্ষায় ভালো করার জন্য পরীক্ষার্থীর ওপর চাপ, কাজেই এ পরীক্ষাটিও কোচিং বাণিজ্যের উদরপূর্তির কাজে লাগছে কেবল।
পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা বাড়িয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কেবল কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে সহযোগিতা করছে। এই সহযোগিতার পেছনে আর্থিক লেনদেন আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য সবাইকে আহ্বান জানাই।
শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য আপাতত প্রাথমিক করণীয় একটাই, শিক্ষকের মানোন্নয়ন। শিক্ষায়তনে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা-সুবিধা বাড়ানো হোক, শিক্ষকের পেশায় মেধাবীদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা হোক।
সবার আগে পিএসসি ও জেএসসি নামের এই নিরর্থক কোচিংতোষী দুটি পাবলিক পরীক্ষা বাতিল করা হোক।

ফিলিপ কিনড্রেড ডিকের একটি গল্পের ভূমিকার অনুবাদ

$
0
0
[আইজাক আজিমভ বা আর্থার সি ক্লার্ক আমাদের কাছে যতোটা পরিচিত, ফিলিপ কে ডিক ততোটা নন। আমি নিজেই তাঁর লেখা গল্পগুলো পড়া শুরু করেছি মাত্র কয়েক বছর আগে। তাঁর গল্পগুলোর মধ্যে নিতান্ত গড়মানের গল্প যেমন আছে, তেমনি পাঠককে স্তব্ধ করে দেওয়ার মতো গল্পের সংখ্যাও কম নয়। আমার বিবেচনায় কল্পবিজ্ঞান ছোটোগল্পের মধ্যে সেরাগুলোর মধ্যে আর্থার সি ক্লার্কের "নাইন বিলিয়ন নেইমস অব গড"আর ফিলিপ কে ডিকের "সেকেণ্ড ভ্যারাইটি"রয়েছে।
ডিকের গল্পগুলো কেমন, সেটা পাঠক নিজেই পড়ে যাচাই করে নিতে পারবেন।
আমি কল্পবিজ্ঞান লেখকদের লেখার পেছনে ভাবনা নিয়ে কোনো লেখা পেলে আগ্রহ নিয়ে পড়ি। ডিজনি ফিল ডিকের "কিং অব দ্য এল্ভস"নিয়ে সিনেমা বানাবে, কয়েকদিন আগে এমন কথা শুনে আবার তার গল্পসমগ্রের প্রথম খণ্ড খুলে গল্পটা পড়া শুরু করেছিলাম। পড়তে পড়তে ফিল ডিকের প্রথম বিক্রি হওয়া গল্প "রুগ"-এর ওপর তার লেখা একটি নোট পেয়ে ভাবলাম, এটা বাংলায় ভাবানুবাদ করে তুলে দিই।]
নিজের প্রথম গল্পটা বিক্রি হওয়ার পর লোকে প্রথমেই যা করে, সবচেয়ে জিগরি দোস্তকে ফোন করে ঘটনাটা তাকে জানায়। কিন্তু সে যখন মুখের ওপর ফোন রেখে দেয়, তখন ধন্ধে পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু একটা সময় গিয়ে বোঝা যায় ব্যাপারটা, দোস্তও গল্প বিক্রি করার চেষ্টা করছে, কিন্তু এখনও করে উঠতে পারছে না। তখন লোকে একটু ধাতস্থ হয়। কিন্তু বউ ঘরে এলে তাকে যখন ব্যাপারটা বলা হয়, সে তো আর মুখের ওপর ফোন রেখে দিতে পারে না, উল্টে অনেক খুশি হয়।
আমি যখন ফ্যান্টাসি অ্যান্ড সায়েন্স ফিকশনের অ্যান্থনি বাউচারের কাছে রুগ বিক্রি করলাম, তখন আমি একটা গানের রেকর্ডের দোকানে খণ্ডকালীন কামলা দিচ্ছি, আর খণ্ডকালীন লেখালিখি চালিয়ে যাচ্ছি। আমাকে যদি তখন কেউ জিজ্ঞাসা করতো, আমি কী করি, আমি সবসময় বলতাম, আমি একজন লেখক। বার্কলির ঘটনা এটা, সন ১৯৫১। সবাই তখন লেখক। কেউ কোনো গল্প বিক্রি করে উঠতে পারেনি। আমি যাদের চিনতাম, তাদের বেশিরভাগই ভাবতো পত্রিকায় গল্প বিক্রি করাটা একটা খোট্টামো আর সম্মানছাড়া কাজ; তুমি গল্প লিখেছো, বন্ধুদের সামনে জোরে জোরে পড়েছো, তারপর সেটার কথা শেষমেশ সবাই ভুলে গেছে। সে সময় বার্কলি এমন ধারাই ছিলো।
সবাই তব্দা খাইয়ে দেওয়ার কাজে আমার জন্যে আরেকটা সমস্যা ছিলো, আমার গল্পটা ছোটো কোনো পত্রিকায় সাহিত্যিক কর্ম ছিলো না, ছিলো কল্পবিজ্ঞান গল্প। বার্কলির লোকে সে সময় কল্পবিজ্ঞান পড়তো না (অল্প কিছু বিদঘুটে ভক্ত বাদে, যাদের দেখলে জীবন্ত সব্জি বলে মনে হতো)। "কিন্তু তোমার সিরিয়াস লেখালিখি কদ্দূর?", লোকজন আমাকে শুধাতো। আমার অবশ্য ধারণা ছিলো, রুগ বেশ সিরিয়াস একটা গল্প। এতে ভয়ের কথা আছে, বিশ্বস্ততার কথা আছে, ধোঁয়াটে ভয়ঙ্করের কথা আছে, আর আছে একটা ভালো প্রাণীর কথা, যে সেই ভয়ঙ্করের কথা পছন্দের লোকজনকে জানাতে পারে না। এরচেয়ে সিরিয়াস আর কী হতে পারে? লোকজন সিরিয়াস বলতে আসলে বোঝাতো "গুরুত্বপূর্ণ"। সংজ্ঞা অনুযায়ীই কল্পবিজ্ঞান ছিলো অগুরুত্বপূর্ণ। রুগ বিক্রি হওয়ার পরের কয়েক হপ্তা আমি কুঁকড়ে থাকতাম, কারণ আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে আমার গল্প, যেটা কি না আবার কল্পবিজ্ঞান, বিক্রি করে আমি একটা সিরিয়াস আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছি।
পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে গেলো, যখন আমি এই কল্পবিশ্বাসকে লালন করতে লাগলাম যে আমি হয়তো লেখক হিসেবে করে খেতে পারবো। আমার মনের মধ্যে কল্পনাটা ছিলো এমন, আমি রেকর্ডের দোকানে আমার কামলা ছেড়ে দিয়ে একটা আরো-ভালো টাইপরাইটার কিনে পুরোটা সময় লিখে যাবো, আর এই করে করে আমার বাড়ির কিস্তির টাকা শোধ করে যেতে পারবো। তখনই আবার মনে হতো, এই বুঝি লোকজন এসে পাকড়ে ধরে নিয়ে যাবে, আমার ভালোর জন্যেই। সুস্থ হওয়ার পর আর এসব চিন্তা মাথায় খেলবে না। আবার রেকর্ড স্টোরের কাজে ফিরে যাবো (কিংবা সুপারমার্কেট, কিংবা জুতো পালিশের কাজে)। লেখক হওয়া আসলে ... কীভাবে বোঝাই ... একবার এক দোস্তকে শুধালাম, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে সে কোন খাতে ঢুকবে, সে ব্যাটা বললো, "আমি জলদস্যু হবো।"সে একেবারে খাড়ার ওপর সিরিয়াস ছিলো।
রুগ বিক্রি হলো, তার কারণ টোনি বাউচার আমাকে ছক কেটে দেখিয়েছিলো, মূল লেখাটা কীভাবে পাল্টানো উচিত। ওর সাহায্য ছাড়া আমি হয়তো এখনও রেকর্ডের দোকানে পড়ে থাকতাম। আমি খুবই সিরিয়াসলি বলছি এ কথা। টোনি তখন একটা ছোটো লেখার টোল চালাতো তার বার্কলির বাড়ির বৈঠকখানায় বসে। সে আমাদের গল্পগুলো জোরে জোরে পড়ে শোনাতো, আর আমরা টের পেতাম --- গল্পগুলো যে নাখাস্তা, শুধু তা-ই নয় --- গল্পগুলোকে কী করে সারিয়ে তোলা যায়। আমাদের লেখা গল্পগুলো ভুয়া ছিলো, এটা ধরিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট নয়, এমনটাই মনে করতো টোনি; গল্পটার আগাপাশতলা পাল্টে সেটাকে একটা শিল্পকর্ম কীভাবে করে তোলা যায়, সে ব্যাপারেও সে সহায়তা করতো। হপ্তায় এক ডলার করে দাম হাঁকাতো সে। এক ডলার! এ দুনিয়ায় যদি কখনো কোনো ভালো মানুষ থেকে থাকে, সেটা অ্যান্থনি বাউচার। আমরা তাকে সত্যিই ভালোবাসতাম। হপ্তায় একবার সবাই একসাথে বসে পোকার খেলতাম আমরা। পোকার, অপেরা আর লেখালিখি, সবই টোনির কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। আমি ওকে বড় মিস করি। ১৯৭৪ সালে একবার স্বপ্নে দেখলাম, মরে গিয়ে পরের দুনিয়ায় চলে গেছি, টোনি সেখানে সব ঘুরিয়ে দেখাবে বলে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। স্বপ্নটার কথা ভাবলে চোখ জলে ভরে যায়। দেখলাম, সে ঐ বাঘাটোনির রূপ ধরেছে, ব্রেকফাস্ট সিরিয়ালের বিজ্ঞাপনে যেমনটা দেখায়। স্বপ্নে সে আনন্দে ডগমগ করে উঠেছিলো, আমিও। কিন্তু ওটা একটা স্বপ্ন; টোনি বাউচার মরে গেছে। কিন্তু আমি এখনও লেখক, ঐ লোকটার জন্যেই। আমি যখনই একটা উপন্যাস বা গল্প লিখতে বসি, এই লোকটার কোনো না কোনো স্মৃতি মনে পড়ে। হয়তো সে-ই আমাকে শিখিয়েছে, লিখতে হয় লেখার প্রতি ভালোবাসা থেকেই, উচ্চাশা থেকে নয়। এ জগতে সব কাজের জন্যেই এটা একটা ভালো শিক্ষা।
এই ছোটোগল্পটা, রুগ, একটা সত্যিকারের কুকুরকে নিয়ে, যে টোনির মতোই এখন বিগত। সত্যিকারের কুকুরটার নাম ছিলো স্নুপার, আর আমি যেমন আমার কাজে বিশ্বাস করি, স্নুপারও তেমনি নিজের কাজে বিশ্বাস করতো। তার কাজ ছিলো (যা মনে হয় আর কী) খেয়াল রাখা, যাতে কেউ এসে তার মালিকের আবর্জনার পাত্র থেকে খাবার চুরি না করে। স্নুপার এই ভুল ধারণায় ভুগছিলো যে তার মালিক ঐ আবর্জনাকে মূল্যবান মনে করে। প্রতিদিন তারা কাগজের ঠোঙা ভর্তি সুস্বাদু খাবার বয়ে নিয়ে খুব সাবধানে একটা শক্ত ধাতব পাত্রের ভেতরে রাখে, তারপর ঢাকনাটা শক্ত করে এঁটে দেয়। হপ্তা যখন ফুরোয়, তখন পাত্রটা ভরে ওঠে --- আর তখন সৌরজগতের সবচেয়ে দুষ্ট সত্ত্বাগুলো একটা ইয়াব্বড় ট্রাকে চড়ে এসে সে খাবার চুরি করে। হপ্তার কোন দিন এটা ঘটে, স্নুপার সেটা জানতো, সবসময়ই শুক্রবারে ঘটে ব্যাপারটা। শুক্রবার ভোর পাঁচটার দিকে স্নুপার ডাকা শুরু করতো। আমার বউ আর আমি চিন্তা করে দেখলাম যে ঠিক ঐ সময়ই আবর্জনাকর্মীদের অ্যালার্ম ক্লক বাজতে শুরু করে। ওরা কখন বাড়ি ছাড়ে, স্নুপার সেটা জানতো। সে ওদের শুনতে পেতো। কী ঘটতে যাচ্ছে, একমাত্র সে-ই জানতো, বাকিরা কিছুই পাত্তা দিতো না। স্নুপার নিশ্চয়ই ভাবতো, সে পাগলে ভরা একটা গ্রহে বাস করে। তার মালিকরা, আর বার্কলির বাকি সবাই, শুনতে পেতো যে আবর্জনাকর্মীরা আসছে, কিন্তু কারো কোনো চ্যাতবোধ ছিলো না। প্রতি হপ্তায় স্নুপারের ঘেউঘেউ শুনে আমার মাথা বিগড়ে যাওয়ার দশা, কিন্তু আমি স্নুপারের যুক্তি নিয়ে যতোটা উদ্বেলিত ছিলাম, আমাদের জাগানোর ব্যাপারে তার উন্মত্ত চেষ্টা নিয়ে ততোটা বিরক্ত ছিলাম না। আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এই কুকুরটার চোখে দুনিয়াটা কেমন? আমরা যেভাবে দেখছি, ও নিশ্চিত সেভাবে দেখছে না। সে নিজের একটা পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাস দাঁড় করিয়ে নিয়েছে, ওর জগদ্দর্শন আমাদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন, কিন্তু যেসব প্রমাণের ওপর ও সেটা দাঁড় করিয়েছে, সেগুলোর কথা ভাবলে, সে জগদ্দর্শন যৌক্তিক।
এটাই আমার সাতাশ বছরের পেশাদার লেখালিখির ভিত্তির একটা আদিরূপ: আরেকটি মানুষ, বা আরেকটি প্রাণীর মনের ভেতরে ঢুকে তার চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করা। সে আমাদের বাকিদের চেয়ে যতো ভিন্ন হবে, ততোই ভালো। একটা সজ্ঞান সত্ত্বাকে দিয়ে আমি শুরু করি, তারপর তার জগত নিয়ে অনুসিদ্ধান্তে আসি। তার পৃথিবী কেমন হবে, তা পুরোপুরি জানা নিশ্চিতভাবেই অসম্ভব, কিন্তু ভালো অনুমান তো করাই যায়। আমি এই ধারণাটা ক্রমশ গড়ে তুলি যে প্রতিটি প্রাণীই বাকিদের চেয়ে ভিন্ন এক জগতে বাস করে। আমি এখনও এ ধারণাকে সত্য মনে করি। স্নুপারের চোখে আবর্জনাকর্মীরা ছিলো ক্ষতিকর আর ভয়ানক। আমার মনে হয়, আমরা যেভাবে তাদের দেখেছি, স্নুপার তারচেয়ে ভিন্নভাবে দেখেছে।
এই ধারণাটা, যে প্রত্যেক প্রাণী বাকিদের চেয়ে ভিন্ন চোখে দুনিয়াটাকে দেখবে, সবাই এ ব্যাপারে আমার সাথে একমত হবে না। টোনি বাউচার একজন বিশেষ বড় সংকলককে (ধরা যাক তার নাম জে.এম.) রুগ পড়ানোর ব্যাপারে উদগ্রীব ছিলো, যদি সে গল্পটাকে কোথাও কাজে লাগায় এ-ই ভেবে। মহিলার প্রতিক্রিয়ায় আমি তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলাম। "আবর্জনাকর্মীরা দেখতে ওরকম নয়", তিনি লিখলেন আমাকে, "তাদের পেন্সিলের মতো সরু ঘাড় আর ল্যাগবেগে মুণ্ডু থাকে না। তারা লোকজনকে ধরে খায় না।"আবর্জনাকর্মীরা দেখতে কেমন, আমার গল্পে তার বর্ণনায় মনে হয় ডজনখানেক ভুল তিনি ফর্দ করেছিলেন। আমি পাল্টা লিখলাম, ব্যাখ্যাসহ, যে হ্যাঁ, তিনি ঠিকই ধরেছেন, কিন্তু একটা কুকুরের চোখে --- আচ্ছা ঠিকাছে, কুকুরটাও ভুল করেছে। ঠিকই তো। কুকুরটা এই ব্যাপারে একটু পাগলা ছিলো। এখানে তো যে-সে কুকুর আর যে-সে কুকুরের চোখে আবর্জনাকর্মী নিয়ে কথা হচ্ছে না, বরং একটা পাগলাটে কুকুর --- যে কি না প্রতি হপ্তায় আবর্জনার পাত্রের ওপর হামলা দেখে দেখে পেগ্লে গেছে। কুকুরটা মরিয়া হয়ে উঠেছে, আমি সেটাই বোঝাতে চেয়েছি। সত্যি বলতে কী, এটাই আমার গল্পের মূল প্রতিপাদ্য; কুকুরটার হাতে আর কোনো উপায় নেই, আর এই সাপ্তাহিক আয়োজন তাকে পাগল করে তুলেছে। আর রুগের দল সেটা জানতো। তারা সেটা উপভোগ করতো। তারা কুকুরটাকে খ্যাপাতো। তারা কুকুরটার পাগলামোতে আশকারা দিতো।
মিস জে.এম. আমার গল্পটা তাঁর সংকলনে নিলেন না, কিন্তু টোনি সেটা ছাপালো, এখনও ছাপা হচ্ছে গল্পটা; এখন গল্পটা হাই স্কুলে পাঠ্য করা হয়েছে। এক হাই স্কুল ক্লাসের সাথে আমি এ নিয়ে কথা বলছিলাম, যাদের বাড়ির কাজ হিসেবে গল্পটা দেওয়া হয়েছে, সব ক'টা বাচ্চাই গল্পটা বুঝতে পেরেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এক অন্ধ ছাত্র গল্পটা সবচেয়ে ভালো ধরতে পেরেছে। সে শুরু থেকেই বুঝতে পেরেছে, রুগ মানে কী। কুকুরটার হালছাড়া ভাব, কুকুরটার হতাশ ক্রোধ, আর ক্রমাগত পরাজয়ের তিক্ত উপলব্ধি। হয়তো ১৯৫১ আর ১৯৭১ সালের মধ্যে সাধারণ জিনিসের বিপদ আর রূপান্তরের মধ্যেই আমরা বেড়ে উঠেছি, যা আমরা আগে কখনো বুঝতে পারিনি। কী জানি। যাই হোক, রুগ, আমার প্রথম বিক্রি, আত্মজৈবনিক; আমি কুকুরটাকে ভুগতে দেখেছি, আর একটু বুঝতে পেরেছি (খুব বেশি না, কিন্তু একটুখানি হয়তো), কী তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিলো, আর আমি তার হয়ে কথা বলতে চেয়েছিলাম। এটাই গোটা ব্যাপারটা। স্নুপার কথা বলতে পারতো না, আমি পারতাম। আমি তা লিখতে পারতাম, কেউ সেটা ছাপাতে পারতো আর অনেকে সেটা পড়তে পারতো। সাহিত্যের এটাই করণীয়: কণ্ঠহীনের কণ্ঠ হয়ে ওঠা। এ লেখকের নিজের স্বর নয়, যে সকল স্বর অশ্রুত থেকে যায়, তারই যোগফল।
স্নুপার নামের কুকুরটা মরে গেছে, কিন্তু গল্পের যে কুকুরটা, বরিস, সে জীবিত। টোনি বাউচার মরে গেছে, যেমনটা আমিও একদিন মারা যাবো, আর হায়, আপনিও। কিন্তু যখন ঐ হাই স্কুল ক্লাসে রুগ নিয়ে কথা বলছিলাম, ১৯৭১ সালে, গল্পটা বিক্রির ঠিক কুড়ি বছর পর --- স্নুপারের ঘেউঘেউ আর তার যন্ত্রণা, তার মহৎ চেষ্টা, সবই জীবন্ত ছিলো, যা তার প্রাপ্য। আমার গল্পটা একটি জন্তুর প্রতি আমার উপহার, একটি জন্তু যে এখন দেখেও না, শোনেও না, আর বেঁচেও নেই। কিন্তু যা-ই বলেন না কেন, সে ঠিক কাজটিই করছিলো। এমনকি মিস জে.এম. সেটা না বুঝলেও। (রচনাকাল: ১৯৭৮)

Article 11

$
0
0
বাংলাদেশ ক্রমশ শিশুদের জন্য বিপদজনক একটি দেশ হয়ে উঠছে।
খবরের কাগজে চোখ রাখলে প্রায় প্রতিদিনই কোনো দুর্ঘটনা বা অপরাধের কথা পড়ি, যেখানে ভিক্টিম এক বা একাধিক শিশু। ধর্ষণের পর শিশুদের হত্যা করার খবরটি মোটামুটি সাপ্তাহিক একটি ঘটনায় পরিণত হয়েছে, কিন্তু সেগুলো নিয়ে আমাদের খুব বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। ব্যাপারটাকে অনেকটা ভূমিকম্প বা ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে দেখার একটা প্রবণতা আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে। হয়তো মিডিয়া আমাদের এই ঘটনাগুলোর লাইভ কাভারেজ দেখাতে পারে না বলে আমরা বেশি সাড়াশব্দ করি না। তবে গতকাল ঢাকার শাহজাহানপুরে একটি গভীর কূপের ভেতরে চার বছর বয়সী একটি শিশুর উদ্ধার তৎপরতার বিজ্ঞাপনখচিত কাভারেজ মিডিয়া যেভাবে দেশবাসীকে উপহার দিয়েছে, একটি শিশুর ধর্ষণ ও হত্যার দৃশ্য সেভাবে দেখালে হয়তো আমরা চুপ করে গিয়ে নিজের কাজে মন দেওয়ার আগে অন্তত দুই তিনদিন চেঁচামেচি করার মতো একটা রগরগে ইস্যু খুঁজে পাবো।
অনলাইন খবরের কাগজে একটু পরপর নানা পরস্পরবিরোধী খবর পড়ে যা বুঝলাম, জিহাদ ঐ গভীর পাইপে পড়ার পর কান্নাকাটি করে, উদ্ধার করার জন্য নিজের মাকে ডাকে। এলাকার কয়েকজন লোক তাকে পাল্টা ডেকে সাড়া পায়। তারা টর্চ আর রশি ঝুলিয়ে বাচ্চাটাকে তুলে আনার চেষ্টা করে। দমকল বাহিনী এসে তাদের সেখান থেকে সরিয়ে নিজেরা বাচ্চাটাকে উদ্ধারের জন‌্য দীর্ঘ সময় ধরে নানা কসরত করে। এ সময় টিভি সাংবাদিক নামের এক শ্রেণীর জীব এসে তাদের ঘিরে ধরে এবং জিহাদের এই প্রলম্বিত যন্ত্রণাটিকে তারা সাফল্যের সঙ্গে নিজেদের ব্যবসার পণ্য বানিয়ে ফেলে। টেলিভিশনে এই পুরো ব্যাপারটি সরাসরি সম্প্রচারের জন্য এক চ্যানেলের সাংবাদিক অন্য চ্যানেলের সাংবাদিকের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে দুর্ঘটনাস্থলটিকে মাছের বাজার বানিয়ে ফেলে। এই সরাসরি সম্প্রচারে তারা অনেক স্পনসর খুঁজে পায় অল্প সময়ের মধ্যেই, এবং জিহাদের খবরের ফাঁকে ফাঁকে স্পনসরদের বিজ্ঞাপনও প্রচারিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে পাইপের ভেতরে ক‌্যামেরা নামিয়ে বেশ কিছুদূর খুঁজে কোনো শিশুর দেহের অস্তিত্ব খুঁজে না পেয়ে উদ্ধারকর্মী ও মিডিয়া একযোগে বলতে থাকে, পাইপের ভেতরে জিহাদ নেই। এই বক্তব্য দমকলপ্রধান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দু'জনেই পুনর্ব্যক্ত করেন। এরই জের ধরে জিহাদের বাবাকে পুলিশ ডেকে নিয়ে কড়া জিজ্ঞাসাবাদ করে। এরই মাঝে দমকলপ্রধান উদ্ধারাভিযান পরিত্যক্ত ঘোষণা দেওয়ার কয়েক মিনিট পর এই উদ্ধারকাজে নবাগত তিন যুবক তাদের নিজস্ব উদ্ভাবিত যন্ত্র দিয়ে জিহাদের অসাড় দেহ পাইপের ভেতর থেকে তুলে আনেন। ডাক্তারি পরীক্ষার পর জানা যায়, জিহাদ মৃত।
পুরো ব্যাপারটি নিয়ে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরলাম।
[১] দমকল বাহিনী যে কাজটি পারেনি, তিনজন যুবক নিজস্ব উদ্ভাবন দিয়ে তা করে দেখিয়েছেন। এখন দমকল বাহিনীকে ব্যাখ্যা করতে হবে, তারা কোন কোন পদ্ধতিতে দীর্ঘ সময় ধরে জিহাদকে উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। সীমিত সম্পদ দিয়ে আমাদের দমকল বিভাগ অনেক দুর্যোগ মোকাবেলা করেন, তাই তাঁদের প্রতি পূর্ণ সহানুভূতি প্রকাশ করে বলছি, এই একটি ক্ষেত্রে তাঁরা শোচনীয়ভাবে অযোগ্য প্রমাণিত হয়েছেন। দমকল বাহিনীর প্রধান যখন উদ্ধারাভিযান পরিত্যক্ত ঘোষণা করছেন, তখন তাঁর কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে জিহাদকে গভীর কূপ থেকে তোলার চেষ্টা করছিলেন অপেশাদার উদ্ধারকর্মীরা। যারা সফল হয়েছেন, তাদের কৌশলটি দমকল বিভাগ শিখে নিচ্ছে কি না, বা এ কৌশলটির আরো শাণিত প্রয়োগ নিয়ে দমকল বিভাগ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে কি না, তা সরল ভাষায় দেশের মানুষকে জানাতে হবে।
[২] উদ্ধারকারী শাহ মোহাম্মদ আব্দুল মুন ও আব্দুল মজিদ খুব সরল একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে জিহাদের দেহ উদ্ধার করেছেন। বুয়েটের প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র তানভীর আরাফাত ধ্রুবও কাছাকাছি নকশার একটি যন্ত্র নিয়ে উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছেন। তাই এ কথা খুব স্পষ্ট যে মানুষের আইডিয়া এ ধরনের দুর্যোগে পেশাদার উদ্ধারকর্মীদের সহায়তা করতে পারে। তাই দমকল বাহিনীর কাছ থেকে আরো আধুনিক আচরণ প্রত্যাশা করি। দমকল বাহিনী খুব সহজেই একটি হেল্পলাইন স্থাপন করে উদ্ধারকাজে উৎসাহী মানুষদের বুদ্ধিবৃত্তিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারেন। দমকল বাহিনীর সদর দফতরে বসে একজন কর্মকর্তা দমকল বাহিনীর ফেসবুক পেজে একটি থ্রেড খুলে প্রকাশ্যে মানুষের মতামত নিতে পারেন, সদর দফতরে বসে সেগুলো যাচাই বাছাই করে দূরযোগাযোগের মাধ্যমে দুর্ঘটনাস্থলে উদ্ধারকাজ তত্ত্বাবধায়কের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন।
[৩] যে কোনো দুর্ঘটনাস্থলে একটি নির্দিষ্ট পরিসীমা স্থাপন করে (ঢিলছোঁড়া দূরত্বের বাইরে) দমকল বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য দাঙ্গা পুলিশ বরাদ্দ করা অবশ্যকর্তব্য। হাজার হাজার উৎসুক প্রত্যক্ষদর্শনলোভী মানুষ যদি ঘিরে থাকে, শোরগোল করে, ঠাণ্ডা মাথায় উদ্ধার কাজ পরিচালনা করা খুবই দুরূহ একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এদের এবং মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে ব্যবসা করা টিভি সাংবাদিকদের ঘটনাস্থল থেকে ভদ্র ও সভ্য দূরত্বে দাঁড় করিয়ে এক ঘণ্টা পর পর উদ্ধারকাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানানো যেতে পারে (যদি তা আদৌ সম্ভব হয়)।
[৪] দুর্ঘটনা বা দুর্যোগের শিকার যারা, তাদের ও তাদের পরিজনদের প্রতি টিভি সাংবাদিকদের আরো সহানুভূতি ও সমানুভূতির প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এই জীবগুলো জানেই না একজন শোকার্ত মানুষের সাথে কীভাবে কথা বলতে হবে। হয়তো এরা মৌগলির মতো জঙ্গলে বড় হয়েছে, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর জামাকাপড় যোগাড় করে পরে লোকালয়ে এসেছে এবং সোজা টিভি চ্যানেলে গিয়ে চাকরি নিয়েছে। সভ্য জগতে কীভাবে দুর্গত মানুষের শোককে প্রচার করা হবে, এ নিয়ে তাদের অবিলম্বে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। নীতিপ্রণেতারা সম্প্রচার নীতিমালায় এ ব্যাপারে বিশদ নজর দেবেন, এমন আশা করছি।
কোরবানির গরুর রক্তের চারপাশে মাছিও এভাবে ভিড় করে না
[৫] আমরা যারা ভদ্দরলোক, তাদের বাচ্চারা সাধারণত গভীর নলকূপের আশেপাশে খেলতে গিয়ে সেটাতে পড়ে যায় না, তাই আমরা এ ধরনের ব্যাপারগুলো "দর্শকের"চোখ দিয়ে দেখি। খেলতে গিয়ে বল ভেবে ককটেল কুড়িয়ে বিস্ফোরণে পঙ্গু বা নিহত শিশুরা, কিংবা ধর্ষণ ও হত্যার শিকার শিশুরাও আমাদের দর্শকের চোখের শিকার। এই বাচ্চাগুলোর পরিণতি যে আমাদের বাচ্চাদেরও হতে পারে, এই আশঙ্কাটুকু আমাদের সবার মধ্যে সঞ্চারিত হওয়া প্রয়োজন। আমরা গ্যালারিতে ভূট্টার খৈ হাতে দর্শকের ভূমিকা থেকে নিজেদের যতদিন বিচ্যুত করতে না পারবো, এ ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্ত হতে থাকবে। জিহাদ আমাদের কারো না কারো খুঁড়ে রাখা পাইপে পড়েই মারা গেছে। আমরা যদি এই দোষী লোকগুলোকে চিহ্নিত না করি, তাকে শাস্তি না দিই, তার ও তার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় না করি, কয়েক মাস পর দেশের আরেক জায়গায় হয়তো একই পরিণতি বরণ করবে অন্য কোনো শিশু।
[৬] ভবিষ্যতে ঠিক একই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে, এ কথা মাথায় রেখে দেশের তরুণ প্রযুক্তিবিদদের প্রতি একটি অনুরোধ। চাঁদে রোবট পাঠানো নিয়ে যেমন জমজমাট রোবোটিক্স প্রতিযোগিতা হয়, ঠিক তেমনি উৎসাহ নিয়ে গভীর কোনো কূপে আটকা পড়া মানুষকে উদ্ধারের জন্য রোবোটিক্স প্রতিযোগিতা হোক। দুর্গত মানুষটির কাছে আলো, পানি, অক্সিজেন ও যোগাযোগের মাধ্যম পৌঁছে দেবে একটি রোবোট, যেটি একই সাথে তাকে যান্ত্রিকভাবে নিরাপদে চেপে ধরবে এবং উদ্ধারকারীরা সে মানুষটিকে সাধারণ একটি উইঞ্চ দিয়ে তুলে আনবেন। চাঁদে রোবোট পাঠানো খুবই উদ্দীপক একটি প্রস্তাব, কিন্তু একজন মানুষের প্রাণ বাঁচানো এর চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। গতকাল যারা জিহাদের দুর্ভোগের সম্প্রচারে স্পনসর করে ব্যবসা করেছেন, তারা এ ধরনের একটি উদ্যোগে স্পনসর করে দ্বিতীয় জিহাদের প্রাণরক্ষায় অগ্রিম অংশ নিন। আমাদের তরুণরা অফুরান প্রাণশক্তি আর আইডিয়া নিয়ে প্রতিদিন ছটফট করেন, তাদের অংশগ্রহণে এ ধরনের একটি প্রতিযোগিতা থেকে অনেক সহজসাধ্য সমাধান বেরিয়ে আসবে বলি বিশ্বাস করি।
[৭] চলতে চলতে যেখানেই শিশুদের জন্য বিপদজনক কোনোকিছু দেখবেন, সাথে সাথে সবার গোচরে আনুন। প্রয়োজনে ঐ সমস্যাটি সমাধান না করা পর্যন্ত সমাধানের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাটিকে সম্ভাব্য সকল বৈধ চাপের মুখে রাখুন। হয়তো আমাদেরই কোনো শিশু বড় হয়ে পুরো মানবজাতির উত্তরণের ভার নিতে পারে, সে যেন একটি ১৫ ইঞ্চি পাইপের কাছে আমাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে পরাজিত না হয়।

কোবিদের কারবারে বিরক্ত হয়ে লেখা

$
0
0
দেশে কাকের চেয়ে কোবি বেশি। কোবি শব্দটার ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন। যারা কবি নয়, কিন্তু কবিতাকে আশ্রয় করে কী যেন একটা করতে চায়, তারাই কোবি। যেমন, দৈনিক কোবি। কোবতে লিখতে গিয়ে চ-বর্গীয় শব্দ ব্যবহার নিয়ে দুইদিনের বৈরাগী কোবিদের কথাবার্তা-কারবারে বিরক্ত হয়ে একটা কোবতে লিখলাম। সিস্টেমকে ধ্বংস করতে গেলে নাকি সিস্টেমের অংশ হতে হয়। যদিও কোবতের ভেতরে বর্ণিত কোবিদের একজন হতে পাল্লাম্না এখনও। বড় হয়ে হবো আশঙ্কা করি।


একটা কোবি ছায়ায় বসে, একটা কোবি রোদে
একটা কোবি ছায়ায় বসে, একটা কোবি রোদে
একটা কোবি চাঁদের আলোয় জাবদা খাতা চোদে
একটা কোবি মফস্বলের, একটা কোবি ঢাকার
একটা কোবি খাতার পাতায় ফ্যান্টাসিতে ফাকার
একটা কোবি "মদ্য"খোঁজে, একটা কোবি "মাগি"
একটা কোবি হস্ত খোঁজে সমস্ত রাত জাগি
একটা কোবির বান্ধবী নাই, একটা কোবির বিয়ে
একটা কোবি ভীষণ সুখী আপন বাঁ হাত নিয়ে
একটা কোবি "চুদবো"লেখে, একটা কোবি "চুদি"
একটা কোবি চোদার আলাপ করছে হুদাহুদি
একটা কোবি পর্নো গেলে, একটা কোবি চটি
একটা কোবি পাড়ায় গিয়ে ভাড়ায় খোঁজে নটী
একটা কোবি চিরকুমার, একটা কোবি ধ্বজ
একটা কোবি কল্পনাতে সঙ্গমে দিগগজ
একটা কোবি খ্যাতির কাঙাল, একটা কোবি ধনের
একটা কোবি সঙ্গকাঙাল বঙ্গনারীগণের
একটা কোবির কেবলা বামে, একটা কোবির ডানে
একটা কোবি কেবলা খোঁজে হাত দিয়ে মাঝখানে
একটা কোবি চোষায় রাজি, একটা কবি চাটায়
একটা কোবি সম্মত খুব পেছন পেতে খাটায়
সকল কোবির ধান্দা একই, নামটা যদি ফাটে
মেডেল নেবে আলমারিতে, মডেল নেবে খাটে
এ ধান্দাতেই একের পুটু অন্যে মারে তারা
কবিতা খায় সকল তরফ থেকেই পুটুমারা।

হিন্দি চলচ্চিত্র দেখানো হলে বাংলায় ডাবিং করা হোক

$
0
0
বাংলাদেশের রুগ্ন চলচ্চিত্র শিল্পকে চাঙা করার জন্য চাঙ্গায়নী সুধা হিসেবে হিন্দি চলচ্চিত্র বাংলাদেশের প্রে ক্ষাগৃহে প্রদর্শনের ব্যবস্থা সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো দেখিয়ে প্রেক্ষাগৃহগুলো ব্যবসায় টিকে থাকতে পারছে না, এটি হচ্ছে চলচ্চিত্র শিল্পের বিতরণ অংশের অভিযোগ। টিকে থাকার জন্য তারা হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানি করে দেখাতে চান।
এর বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে চলচ্চিত্র শিল্পের উৎপাদন অংশটি। তারা আশঙ্কা করছেন, হিন্দি চলচ্চিত্র একবার বাংলাদেশে ঢুকে পড়লে দেশীয় চলচ্চিত্র নির্মাণ হুমকির মুখে পড়বে।
আমি চলচ্চিত্র শিল্পের মানোন্নয়নের জন্য হিন্দি চলচ্চিত্র বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে দেখানোর বিরোধী। এ নিয়ে অনেক আগে একটি পোস্টে কিছু ভাবনা তুলে ধরেছিলাম। হিন্দি চলচ্চিত্র বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শন শুরু হলে তার কোনো ইতিবাচক প্রভাব আমাদের চলচ্চিত্রের ওপর পড়বে বলেও আমি মনে করি না। হলিউডের অনেক "মানসম্মত"ইংরেজি ছবি আমাদের প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হয়, তাতে করে বাংলা চলচ্চিত্রের তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। কিন্তু যারা মনে করেন হিন্দি সুঁই দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের বাতজ্বরের উন্নয়ন ঘটবে, তাদের যুক্তিগুলোও মন্তব্যের পাতায় উঠে আসুক।
নিতান্তই যদি সর্বনিকৃষ্ট পরিস্থিতিতে হিন্দি চলচ্চিত্র বাংলাদেশে দেখাতেই হয়, তাহলে কর্তৃপক্ষের কাছে আমার অনুরোধ, হিন্দি চলচ্চিত্রে বাংলা ডাবিং বাধ্যতামূলক করা হোক। বাংলাদেশের দাপ্তরিক ভাষা দুটি, বাংলা ও ইংরেজি। এর বাইরে অন্য কোনো ভাষার চলচ্চিত্র নিয়ে যদি প্রেক্ষাগৃহ মালিকেরা ব্যবসা করতে চান, সেক্ষেত্রে বাংলায় ডাবিংকে অবশ্যপালনীয় শর্ত হিসেবে রাখা হোক। একই সাথে এ ডাবিং হতে হবে বাংলাদেশের কোনো ডাবিং স্টুডিওতে, এমন শর্তও আরোপ করা হোক। বাংলাদেশের স্বীকৃত অবাঙালি নৃগোষ্ঠীর ভাষায় যদি কোনো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, সেক্ষেত্রে এ শর্ত শিথিল করা যেতে পারে।
হিন্দি চলচ্চিত্র হিন্দিতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে দেখানোর অনুমতি দেওয়ার অর্থ, হিন্দিকে কার্যত বাংলাদেশের একটি কার্যকর যোগাযোগের ভাষা হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া। আমি মনে করি, এটি কর্তৃপক্ষীয় অবস্থান হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।
পাঠকের দ্বিমত সাদরে স্বাগতম।

প্রতিভুভুজেলা

$
0
0
পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নববর্ষ উদযাপন করতে আগতা নারীদের ওপর কিছু মাদারচোদ চড়াও হয়ে তাদের বস্ত্রহরণ করেছে। কাজটা যে হঠাৎ সুযোগ নিয়ে করা হয়েছে, এমনও নয়। কিছু লোক ওঁত পেতে থেকে আচমকা শেয়ালের পালের মতো চড়াও হয়েছে সন্তানবাহিনী মায়ের ওপর, উপস্থিত যুগলের ওপর। কয়েকজন ঘিরে রেখেছে শিকারকে, কয়েকজন তাদের জামা টেনে ধরেছে। সাহায্যের জন্য করা আর্তচিৎকার শুনে যাতে কেউ এগিয়ে না আসে, সেজন্য ভুভুজেলা বাজিয়ে আর্তনাদ চাপা দেওয়া হয়েছে। এই কাজগুলোর জন্য পরিকল্পনা ও অনুশীলনের প্রয়োজন। ভিড়ের ভেতরে সুযোগসন্ধানী বখাটের হাতে মেয়েদের নাজেহাল হওয়ার বিচ্ছিন্ন ঘটনা অন্তত এটি নয়। যারা এ কাজ করেছে, তারা পহেলা বৈশাখের উদযাপনটিকেই দীর্ঘ মেয়াদে আক্রমণ করতে চায়। সে দীর্ঘমেয়াদী আক্রমণের প্রথম ধাপ নারীর ওপর করে শুরু করা বাংলাদেশে সহজ, আরো কিছু মাদারচোদ তাদের সহমাদারচোদদের সমর্থন করে আক্রান্তা নারীটির ওপর যাবতীয় দোষ চাপিয়ে দিতে অনলাইনে এবং অফলাইনে সবসময়ই হাজির থাকে।
তাই বলে কি আমাদের নববর্ষ উদযাপন থেমে থাকবে? কখনোই না।
এ অবস্থায় আমাদের কর্তব্য হতে পারে, নতুন বছর উদযাপনের পাশাপাশি প্রতিটি ঋতুকে আলাদা করে বরণ করার জন্য আরো উৎসব প্রণয়ন করা। পহেলা ফাল্গুনে বসন্তবরণ উৎসব অনেকদিন ধরেই পালিত হচ্ছে, এটিকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। এই দিনটিকে নববর্ষের মতোই আনন্দ উদ্দীপনা নিয়ে সবাই উষ্ণবর্ণের জামা পরে উদযাপন করেন, তবে কী করে দিনটিকে আরো আনন্দমুখর করা যায়, তা নিয়ে সংস্কৃতিকর্মীদের আরো ভাবতে হবে।
পহেলা ফাল্গুনের পাশাপাশি আষাঢ়ের প্রথম দিনে বর্ষাবরণ উৎসব পালন করতে হবে, সমবেত হয়ে নারী পুরুষ সকলে গান, নৃত্য, পথনাটক ও সমাবেশের মধ্যে দিয়ে বাংলার প্রাণদায়িনী বর্ষাকে বরণ করে নিতে পারেন। কদম ফুল হতে পারে এই উৎসবের প্রতীক, রংধনুর সাত রং হতে পারে এই উৎসবের মুখ্যবর্ণ। শেষ গ্রীষ্মের ফল আর বর্ষার ফুল নিয়ে হতে পারে চমৎকার সব আয়োজন আর প্রদর্শনী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা সেজে উঠতে পারে চারুকলার শিল্পীদের তৈরি করা ব্যাঙের ছাতায়।
যদিও শরৎকে এখন আলাদা করে চেনা দুঃসাধ্য, কিন্তু শরৎবরণের জন্য ভাদ্রের প্রথম দিনটিতে বিদ্যায়তনগুলো ছেয়ে যেতে পারে নীল আর সাদার বিভিন্ন শেডে। কাশের একটি করে শীষ নিয়ে তরুণ-যুবা-বৃদ্ধরা সাদা কুর্তা আর পায়জামায় সজ্জিত হয়ে সাদা-নীল শাড়িতে সেজে আসা সঙ্গিনীকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন একই রঙে সাজানো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। চারুকলার শিল্পীরা এ দিন ক্যাম্পাসকে সাজিয়ে তুলবেন কাগজের সারস আর শরতের ফুলের সজ্জায়।
হেমন্ত আর শীতকেও একই ভাবে বরণ করে নেওয়া যেতে পারে আলাদা দুটি উৎসব করে। কার্তিক আর পৌষের প্রথম দুটি দিনে সোনালি আর ধূসর রঙের পোশাকের মানুষ আরা নানা পিঠার আয়োজনে ভরে উঠবে উৎসবের চত্বরগুলো। হাসিমুখে নারী আর পুরুষের সমাগমে ভরে উঠবে রমনা, সোহরাওয়ার্দি, টিএসসি, চারুকলা, দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, উদযাপনের এলাকাগুলো।
পহেলা বৈশাখকে আক্রমণ যারা করে, তাদের শায়েস্তা করার জন্য প্রথম উদ্যোগ হোক এটিই, উৎসবের আয়োজন বহুগুণিত হোক। উদযাপনের দিক ছয়গুণ বাড়ানো হোক। হয়তো শুরুতে অনুষ্ঠানগুলো জমবে একটু কম, কিন্তু তার পরের বছর আরেকটু সরগরম হবে, আরেকটু জমজমাট হবে, তরুণ-তরুণীরা আরো নানা আগ্রহোদ্দীপক আয়োজনে ঋতুবরণের উৎসবগুলোকে আরো বর্ণিল করে তুলবেন। কাজটা খুবই সহজ, বন্ধুকে নিয়ে উপস্থিত হলেই দেখবেন উৎসবকে শূন্য থেকে গড়ে তুলছেন আপনি নিজেই।
বাপের গোয়া দিয়ে পয়দা হওয়া যেসব শুয়োরের বাচ্চা ভুভুজেলা বাজিয়ে মেয়েদের ঘিরে ধরে তাদের কাপড় ধরে টানাটানি করে, তাদের মোকাবেলার দ্বিতীয় পন্থাটি আরেকটু কম অহিংস। ওরা যদি ৪০-৫০ জন মিলে দল বেঁধে ওঁত পেতে থেকে আপনার সমাজের একজন নারীর ওপর আক্রমণ চালায়, তাহলে আপনিও পারবেন ১০০-২০০ জনের একটি দল বেঁধে এদের প্রতিহত করতে। যে পহেলা বৈশাখকে পণ্ড করার জন্য মেয়েদের জামা ধরে টানে, আর যে মেয়েটিকে ঘিরে ধরে আত্মরক্ষায় বাধা দেয়, দু'জনই সমান বাপের গোয়া দিয়ে পয়দা হওয়া শুয়োরের বাচ্চা। সামনের উৎসবে একা যাবেন না, বড়সড় দলের সঙ্গে কোঅর্ডিনেট করে যাবেন। যদি হাত-পা চালাতে না পারেন, মোবাইলের ক্যামেরা চালাবেন। স্পষ্ট ছবি তুলে নিয়ে আসবেন এই মাদারচোদদের। সেই ছবি কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষণ ও প্রচার করে এই মাদারচোদদের এক এক করে খুঁজে বের করা হবে, দশ বছর পরে হলেও। এরা যে প্রতিষ্ঠানে পড়ে বা চাকরি করে, সে প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে। পুলিশ যদি এদের জেলে না ঢোকায়, মামলা না দেয়, আদালত যদি এদের শাস্তি না দেয়, তাহলে এদের সামাজিকভাবে একঘরে করা হবে।
দেশটা আপনার, উৎসব আপনার, মানুষও আপনার। আসুন ঘুরে দাঁড়াই। কয়েকটা খানকির পোলা মিলে আমাদের হাত থেকে যেন এই দেশ-মানুষ-উৎসবকে ছিনিয়ে নিতে না পারে।
ভুভুজেলা যখন আমরা বাজাবো, তখন মাইরও হবে, সাউণ্ডও হবে।

কাঁদো ফারু কাঁদো

$
0
0
নগরপাল নির্বাচন নিয়ে একখানা কিছুমিছু ছড়া। পুরোটাই নীড়পাতায় চলে আসে বলে শুরুতে একটু ভূমিকা জুড়ে দিলাম। এই ভূমিকার ভূমিকা নিতান্তই মাহীবিচৌধ্রির মতো, কোনো কাজের কাজে আসবে না, কিন্তু রাখতে হয় বলে রাখা।


কীসে কম পড়েছিলো, ঈমানে না আকিদার?
জামানত মারা গেলো বিপ্লবী সাকি'দার।
এই নিয়ে যদি কেউ কাটা ঘায়ে চুলকায়,
জেনে রেখো, কারচুপি হয়েছিলো স্থূলকায়।
আধখানা ঢাকা ছিলো সাকি'দার লক্ষ্য
লুঙ্গি পুরোটা খুলে নিলো প্রতিপক্ষ।
রাজনীতি নিয়ে এতো কড়া জ্ঞানী মাথা যার
কোটি কোটি থেকে মোটে ভোট পেলো সাত হাজার।
ভোটাভুটি খেলা জেনো মোটামুটি দূষণের
সাকি ভাই তাই দিন গোণে রেভোলুশনের।

যানজট নিয়ে দুইআনা

$
0
0
ঢাকার রাস্তা যেহেতু সময়ের সাথে বাড়ছে না, কিংবা বাড়লেও খুব সামান্য বাড়ছে, তাই প্রতিটি নতুন গাড়ি ঢাকার যানজটকে আরেকটু বাড়ানোর খানিকটা দায় মাথায় নিয়ে পথে নামছে।
সরকার চাইলে দুটো ছোটো উদ্যোগ নিয়ে এই যানজট কমানোয় খানিকটা অবদান রাখতে পারে।
প্রথমত, সরকার তার কর্মীদের (কর্মকতা ও কর্মচারী) পরিবহন ব্যবস্থাকে অন্যভাবে সাজাতে পারে। সরকারি পরিবহন পুলে গাড়ি যোগ করে অপচয় না বাড়িয়ে বিআরটিসিকে সরকার নতুন বাস কিনে দিতে পারে। সকালে ও সন্ধ্যায় এই নতুন বাসগুলো কেবল সরকারি কর্মী বহন করবে। সরকারি কর্মীদের মাঝে সচিত্র পরিবহন পাস সরবরাহ করা হবে, এবং তারা সেই পাস দেখিয়ে বিআরটিসির এই নতুন বাসগুলোতে চড়ে সকালে ও সন্ধ্যায় কেবল সরকারি কর্মীবাহী ট্রিপগুলোতে বিনামূল্যে শহরে চলাফেরা করতে পারবেন।
দিনের বাকিটা সময় এই নতুন বাসগুলো সাধারণ যাত্রী বহন করবে।
এতে করে যা হবে, সরকারি কর্মী পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত যানের ব্যবহারাঙ্ক (প্রতি যাত্রায় প্রতি ঘণ্টায় প্রতি বর্গমিটার রাস্তায় পরিবাহিত যাত্রী সংখ্যা) অনেকগুণে বাড়বে। সরকারি গাড়ি পরিবহন পুলে যোগ হয়ে অপচয় বাড়াবে না। একটি বাস যদি ৬০ জন যাত্রী বহন করে, তাহলে রাস্তা থেকে বিকল্প অনেকগুলো সরকারী মাইক্রোবাস ও সেডান উঠে গিয়ে অন্যের জন্য জায়গা করে দেবে। যাত্রী পিছু রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় কমে আসবে বিপুলভাবে, চালক বাবদ সরকারের ব্যয়ও হবে কম, সেইসাথে সরকারি গাড়ির অপব্যবহারও কমে আসবে অনেক।
দ্বিতীয় উদ্যোগটি হবে এমন, ঢাকা শহরে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি পারতপক্ষে কোনো অনার্ন্তজাতিক অনুষ্ঠানে সশরীরের অংশগ্রহণ করবেন না। কোনো কিছুর উদ্বোধন, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানগুলোতে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি নিজ কার্যালয় বা বাসভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিঙের মাধ্যমে অংশ নেবেন। সেখানে তাঁদের বক্তৃতা এবং প্রশ্নোত্তর পর্ব (যদি থাকে) ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে হবে। প্রকাণ্ড স্ক্রিনে তাঁদের বক্তব্য অনুষ্ঠানমঞ্চে দেখানো হবে। তাঁদের পক্ষ থেকে তাঁদের মনোনীত কোনো কর্মকর্তা কৃতীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন।
এর কারণ হচ্ছে, অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যখন ঢাকা শহরে চলাচল করেন, তাঁদের যাত্রাপথ জুড়ে সব রাস্তা বন্ধ রাখা হয়। লক্ষ লক্ষ লোক এই নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘানি টানতে বাধ্য হন। যদি দশ লক্ষ লোকও যে কোনো সময় রাস্তায় যানজটে আটকে থাকে, আর ভিভিআইপিদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে তাদের একটি ঘণ্টাও যদি নষ্ট হয়, তাহলে এক কর্মঘণ্টার মূল্য একশো টাকা ধরে নিলে, এ ধরনের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির উপস্থিতির মূল্য হিসেবে ঢাকা শহরের পথযাত্রীরা দশ কোটি টাকা নিজেদের পকেট থেকে ব্যয় করছেন। অনান্তর্জাতিক অনুষ্ঠানগুলো কি আদপেই এতো মূল্যবান?
এ দুটি উদ্যোগ নিলে ঢাকায় পথযাত্রীদের জীবন আরেকটু সহজ হবে। একই সাথে সরকার নিজে প্রথম উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করতে পারলে অন্যান্য বেসরকারি "গাড়ি-ভারি"প্রতিষ্ঠানকেও একই ধরনের উদ্যোগ নিতে রাজি করানোর কাজ শুরু করতে পারে।

বলদের অভিশাপ

$
0
0
খ্রিস্টের জন্মের খোঁজ বাদার বাঘ রাখে না। খ্রিস্টের জন্মের আগেও সে গরানের শ্বাসমূলকে সচকিত করে নিঃসাড়ে নদীর জলে নেমে ওপারে কোনো হতভাগ্যের মাংসে দাঁত বসিয়েছে। বালথাজার, মেলকিওর আর গাসপার যখন বেতলেহেমের রাস্তা ভুলে হাঁ করে আকাশের তারা দেখছিলো, তখনও বাঘ শেষ রাতের অন্ধকারে নদীর ওপর ঝুঁকে পড়া গাছের ছায়া ঠেলে অনায়াসে চড়াও হয়েছে এক তরুণ চিত্রলের ওপর। ক্যালেণ্ডার বাঘের কাছে বাহুল্য। বংশ পরম্পরায় বাদার বুক চিরে তরতর করে বয়ে চলা মন্থরা সব নদী পার হতে হতে কারা দুই হাজার তেরোবার খ্রিস্টীয় ক‌্যালেণ্ডারের পাতা ওল্টালো, সে খবর রাখার ফুরসত বাদার বাঘের নেই।
পৌষের রাতে কনকনে ঠাণ্ডা জল ঠেলার শখ বাঘের ছিলো না। কিন্তু পেটের দায়ে তাকে নামতেই হয়। নদীর বুক চিরে এখন মালবাহী জাহাজ চলে সারাদিন সারারাত। কুয়াশার ভেতর সেগুলোর একটিমাত্র জ্বলন্ত চোখ নিভে যায়, হারিয়ে গিয়ে একটু পর পর মা-হারা হরিণবাছুরের মতো ভেঁপু বাজিয়ে একে অন্যকে ডাকে তারা। জাহাজগুলোর রকমসকম দেখে মনে হয়, এই বুঝি একে অন্যের সাথে বাড়ি খেয়ে কাত হয়ে পড়ে গর্ভের সবকিছু নদীর জলে বিসর্জন দিয়ে বনটাকে বিষিয়ে তুলবে তারা। নদীর এপারে হরিণের দল সেই কুয়াশাচর জলযানের রক্তচক্ষু আর আর্তধ্বনি একদম বরদাশত করতে পারেনি। তাদের করণীয় একটাই, সেটাই করেছে তারা, একের পর এক খাল আর খাঁড়ি টপকে সব সরে গেছে আরেক বাঘের তালুকে।
বাঘের চেয়ে বড় তালুকদার আর কেউ বাদায় নেই। এক বাঘের তালুকে আরেক বাঘ ঢুকে পড়লে পরিণতির গায়ে রক্তের ছিটা লাগতে বাধ্য। হরিণ যেমন নাচতে নাচতে এক বাঘের তালুক থেকে আরেক বাঘের তালুকে সটকে পড়তে পারে, বাঘ তেমনটা পারে না। কিছুদিন পর পর নিজেই পিশু করে নিজের তালুকের অলঙ্ঘ্য সীমানা দাগিয়ে রাখে সে, তার ওপারে গেলেই অন্য কোনো বিটকেল বাঘের সঙ্গে মরণপণ কুস্তির খাটনি বাধ্যতামূলক। নিজের তালুকের হরিণগুলো এভাবে শেয়ারবাজারের বখরার মতো চোখের সামনে লোকসান হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে বাঘ সাঁতরে নদী পার হয়।
নদীর ওপারে মানুষের তালুক শুরু।
ওপারে যে হরিণ নেই, সে কথা বাঘ জানে। কিন্তু আর যা-ই থাক, ঘাড় মটকে আজ সে একটা কিছু খাবেই খাবে। হপ্তাখানেক ধরে পেটে কিছু পড়েনি তার। ভুখা তালুকদারের মতো মরিয়া জীব আর কীই বা হতে পারে?
পৌষের হিমে স্নাত নদীখানা পেরিয়ে বাঘ গা ঝাড়া দিয়ে শরীর থেকে জল ঝরায়, তারপর মানুষের চলাচলে প্রশস্ত হওয়া পথ ধরে চুপচাপ চলতে থাকে। কিছুদূর গেলেই গ্রাম পড়বে, গন্ধের সূত্র ধরে টের পায় সে। মানুষের গায়ের নোনতা গন্ধ ক্রমশ তীব্রতর হতে থাকে পথের উজানে, বাঘ সে গন্ধের আঁচল ধরে চুপচাপ হাঁটে। নদীর শরীর বেয়ে বয়ে আসা হঠাৎ বাতাসে আশপাশে খাটো ঝোপঝাড় শিউরে ওঠে, বাঘের পায়ের শব্দ তাদের চেয়েও মৃদু।
হঠাৎ করেই বনের পরিচয় মুছে গিয়ে গ্রাম শুরু হয়। বাঘ নাকটা উঁচুতে তুলে বুক ভরে ঘ্রাণ নেয় একবার, তারপর নিশ্চিত পায়ে সামনে এগোয়। বলদের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে কাছেই। হরিণের পর বলদই এখন তার ভরসা।
বাদার মানুষ গরিব, গরু রাখার সামর্থ্য আছেই কয়েক ঘরের। তাদের গোয়ালের বেড়া গরুর আব্রু রক্ষা করে বড়জোর, বাঘের কাছে সেই বেড়া জাগপার শফিউল আলম প্রধানের মেঠো বক্তৃতায় হুমকির মতোই তুচ্ছ। দুই চাপড়ে বন থেকে চুরি করে কেটে আনা ধুন্দলের ডাল দিয়ে বাঁধা বেড়ার আনুষ্ঠানিকতা উড়িয়ে দিয়ে সে উবু হয়ে গোয়ালের ভেতরে ঢুকে পড়ে।
দুটো বলদ ঘুমাচ্ছিলো গোয়ালের ভেতরে, বাঘের গায়ের গন্ধ তাদের উত্তরাধুনিক স্বপ্নে খানিকটা ব্যাঘাত ঘটায়। একটা বলদ লেজ নেড়ে মাছি তাড়িয়ে বলে, ঘুমটা ভেঙে গেলো।
আরেকটা বলদ আধো ঘুমের মধ্যেই বলে, বলদের ঘুম সুন্দরী গরুর মনের মতো, অল্পতেই ভেঙে চুরমার।
বাঘের খুব মেজাজ খারাপ হয়।
বাদার হরিণ এতো বেয়াদব হয় না সাধারণত। বাঘের গন্ধ, শব্দ, দৃশ্য, কল্পনা ইত্যাদির তিলেকমাত্র উদয় হলেই তারা চম্পট দেয়। বাদার হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যই সেরকম। হরিণ দোতলা সমান লাফ দিয়ে খাল টপকে বনের মধ্যে উধাও হচ্ছে, এমন দৃশ্য না দেখলে বাঘের আঁতে মোচড় ঠিকমতো লাগে না। তার আগুন আর ধোঁয়ার ডোরায় ছাওয়া শরীরটার ভেতরে রুদ্ররস যোগায় কেবল হরিণের পলায়ন আর অন্য বাঘের আগমন। শুধু খালি পেট ভরাতেই সে গ্রামে ঢোকেনি, সঙ্গে একটু ক্রীড়ার বাসনাও তার ভুখা মনের এক কোণে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত মেহফিলের ডেকোরেটরের মতো চুপচাপ পড়ে ছিলো। কিন্তু এই অশিক্ষিত বলদ দুটো তার পেট ভরাতে পারলেও মন যে ভরাতে পারবে না, তা সে বুঝে যায় এক ঝটকায়।
একটা কাক তখনই কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে গোয়ালের ধোঁয়া তাড়ানোর ছোট্টো ঘুলঘুলিতে। গৌরচন্দ্রিকার ধার না ধেরেই সে বলে, খা খা খা। নাড়িভুঁড়ি আমাকে দিস।
বাঘের মেজাজ আরেক কাঠি খারাপ হয়। বাদার পাখিরা এতো বেয়াদব হয় না। কাকটা মনে হয় শহর থেকে এসেছে।
বলদগুলো এবার একটু ধড়মড়িয়ে উঠে বসে। চোখ মিটমিট করে কান নেড়ে কানের মাছি তাড়িয়ে এক বলদ বলে, বাঘ ঢুকলো নাকি দোস্ত?
অন্য বলদ একটু এগিয়ে গিয়ে ভালোমতো বাঘকে পরখ করে দেখে বলে, বাঘই তো মনে হচ্ছে। দাঁড়া চেটে দেখি।
বাঘ প্রথমে একটা কড়া ধমক দিতে যায়, তারপর গেরস্তের কথা চিন্তা করে জিভ কেটে ফিসফিসিয়ে গর্জে বলে, জিভ সামলে কথা বল, বলদ কোথাকার।
ঘুলঘুলিতে কাকটা এক পাক নেচে ওঠে গোয়ালের মশা তাড়ানো ধোঁয়ার মতো, বলে, বাঘ বাঘ বাঘ।
এক বলদ বলে, গেরস্তকে খবরটা দেওয়া দরকার না দোস্ত?
অন্য বলদ বলে, বিলক্ষণ। কিন্তু গেরস্ত তো ঘুমায়। ডাকলে যদি রাগ করে?
বাঘ চোখ মিটমিট করে বলদ দুটোকে দেখে কিছুক্ষণ ধরে। বলদের কথা সে ছানাবেলায় মায়ের কাছে শুনেছে কেবল, কিন্তু বাস্তবে যে বলদ এতো বড় বলদ, শীত ঠেলে নদীটা না টপকালে সে কিছুতেই বুঝতো না।
বাঘ দুই পা সামনে বাড়ে। কাকটা খুশিতে ডিগবাজি খেয়ে বলে, কা কা কা কা তব কান্তা কস্তে পুত্র? লাগ যা গলে কে ফির ইয়ে রাত হো না হো।
বলদ দুটো এবার গলাগলি করে কাকের সঙ্গে পোঁ ধরে কী যেন একটা বিটকেলে গান গেয়ে ওঠে।
কাকটাও বলদ দুটোর বলদামিতে অতিষ্ঠ হয়ে বলে, আরে তোদের গলাগলি করতে বলি নাই। বাঘকে বললাম তোদের ঘাড়ে নাজিল হতে। বলদ কোথাকার।
এক বলদ অশ্রুসজল চোখে বাঘের দিকে এগিয়ে এসে বলে, আয় ভাই ভায়ে ভায়ে গলাগলি করে একটা গজল গাই।
বাঘ একবার পেছন ফিরে গোয়ালের বেড়ার গায়ে গর্তটাকে দেখে, কান খাড়া করে গ্রামভর নিদ্রার শব্দ শোনে, ঘুলঘুলির কাকের নাচ দেখে কিছুক্ষণ, তারপর জিভ দিয়ে নিজের গাল চুলকাতে চুলকাতে বলে, এটা মানুষের গ্রাম তো, নাকি?
অন্য বলদ একগাল হেসে বলে, একদম। মানুষ ছাড়া বলদ পাবে কোথায়?
বাঘ হতাশ হয়ে কাকের দিকে তাকায়, বলে, আরে কিছু বল না এ দুটোকে। বলদ আমাকে ভাই বলে ডাকে। দেবো নাকি গলাটা টিপে?
কাকটা এবার একটু গম্ভীর হয়ে ঘুলঘুলির ওপর দাঁড়িয়ে গলা খাঁকরে বলে, বলদেরা আমার। তোমাদের গোয়ালে রাতবিরাতে বাঘ ঢুকেছে। কিছু বুঝলা?
এক বলদ সলজ্জ মুখে বলে, বলদের কাছে এসে বাঘের কীই বা লাভ? আমরা গরু হলে একটা কথা ছিলো।
অন্য বলদ গম্ভীর মুখে বলে, আমরা ওরকম বলদ নই।
বাঘ তিতিবিরক্ত হয়ে একবার ঘুরপাক খায় গোয়ালের ভেতরে। এ কেমন শিকার? বলদ দুটো বাবুরাম সাপুড়ের সাপের মতো নিরামিষ মাংস হয়ে থাকলে চলবে কীভাবে? আর্তনাদ কোথায়, আতঙ্কের ঘ্রাণ কোথায়, নিজের বুকে রুদ্ররসের দাপটে রক্তের লাফঝাঁপ কোথায়?
কাকটা বাঘের বিরক্তি টের পায়, সে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে, তোমরা বাঘের প্রেম নও, গেম। বাঘ তোমাদের মাংস চায়।
এক বলদ অন্য বলদকে ফিসফিস করে বলে, বাদায় নাকি বাঘ কমে গেছে। এখন বোঝো ঠ্যালা। অভাবে স্বভাব নষ্ট। এই বেটার মতলব তো ভালো মনে হচ্ছে না। তুই আমার পেছনটা পাহারা দে, আমি তোর পেছনটা দিচ্ছি। খুব হুঁশিয়ার।
বাঘ এবার আর মেজাজ সামলাতে পারে না, চাপা হুঙ্কার দিয়ে বলে, ধুত্তেরি!
কাকের গলায় সহানুভূতি উপচে পড়ে, আহারে। থাক, রাগ করে না। বলছি বুঝিয়ে। ওরে বলদজোড়, আপাতত গাঁড়ের চিন্তা না করে ঘাড়ের চিন্তা কর।
বাঘ কাকের দিকে তাকিয়ে বলে, এরা কি সবসময়ই এরকম কাঠবলদ, নাকি আমাকে চ্যাতানোর জন্য এমন করে?
কাক কাঁধের পালক ঝাঁকিয়ে বলে, মানুষের সঙ্গে থেকে থেকে...।
বাঘের থাবায় পলকে নখ বেরিয়ে আসে, সে গুঁড়ি মেরে এগোয় বলদ দুটোর দিকে।
বলদেরা ভয়ে ভয়ে পিছিয়ে যায়। এক বলদ অন্য বলদকে বলে, দোস্ত বাঘটা মনে হয় আমাদের ব্যথা দিতে চায়।
অন্য বলদ বলে, ও লোক ভালো না।
বাঘের মুডটাই নষ্ট হয়ে যায়, সে তড়পে উঠে বলে, খবরদার আর কথা কবি না! একদম চোপ! লড়েচ কি মরেচ!
এক বলদ শুকনো মুখে বলে, কামন ড্যুড। এইভাবে তুমি রাতবিরাতে আমাদের গোয়ালে ঢুকে মস্তানি করতে পারো না।
অন্য বলদ পাংশু হয়ে বলে, তাছাড়া দিস ইজ নট হাউ উই গো ডাউন। গেরস্ত বলেছে মরার আগে সে একবার আমাদের গাবতলি দেখাতে নিয়ে যাবে।
বাঘ গোয়ালের অন্ধকারে জুলজুল করে কিছুক্ষণ বলদ দুটোকে চোখ দিয়ে মেপে বলে, গাবতলি কী?
এক বলদ মুগ্ধকণ্ঠে স্বপ্ন-স্বপ্ন চোখে বলে, গাবতলি এক স্বপ্নপুরী। সেখানে এন্তার খৈল আর ভুষি। মীরকাদিমের ফর্সা ফর্সা সুন্দরী গরুর কাজল দেওয়া চোখের ভিড় সেখানে। সারাদিন শুধু খাও আর শোঁকো।
অন্য বলদও আনমনা হয়ে পড়ে, বলে, শুনেছি মীরকাদিমের গরুগুলো সারাক্ষণ লেজ তুলে রাখে, আর আড়ে আড়ে কেমন করে যেন তাকায়। তাছাড়া বলিউড থেকেও গরু আসে গাবতলিতে। শুনেছি তারাও খুব দুশ্চরিত্রা। তাদের কোনো বাপভাই নেই।
বাঘ ধমক দিয়ে বলে, চোপ শালা কাষ্ঠুবলদ! গাবতলিতে গরু আসলে তোদের কী? ধুন্দুল পাকলে কুমীরের কী?
এক বলদ কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, অবলোকনেও সুখ!
অন্য বলদ শিউরে উঠে বলে, রজার দ্যাট!
কাকটা কা কা করে হেসে উঠে বলে, সারা সাতক্ষীরায় গাবতলি যাওয়ার রাস্তা জামাতের লোকে কেটে রেখেছে। বাঘের বগলতলির চেয়ে বেশি কিছু দেখার কিসমত তোমাদের নাই, মাই সুইট ইডিয়টস।
এক বলদ আঁতকে উঠে বলে, সত্যি? তিন সত্যি?
অন্য বলদের পাঁজুরে বুকে তবুও অনেক আশা কিলবিল করে, সে উতলা হয়ে বলে, গাবতলিতে লঞ্চে করে যাওয়া যায় না?
বাঘ গোয়ালের মেঝেতে থাপ্পড় মেরে বলে, শাটাপ। ফাক গাবতলি। ফাক মীরকাদিমের গরু। ফাকিউ।
কাক নাচতে নাচতে বলে, কা কা কা কামড়া!
এক বলদ পিছু হটতে হটতে গোয়ালের কোণে অন্য বলদকে সঙ্গে নিয়ে ঠাসাঠাসি করতে করতে বলে, ঠিকাছে ড্যুড। যদি তোমার হাতেই আমাদের স্বপ্ন মারা পড়ে, আমরাও বলদ পীরের নামে পাল্টা অভিশাপ দিচ্ছি...।
বাঘ আবার গুঁড়ি মেরেছিলো, অভিশাপের কথা শুনে সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, কার নামে?
অন্য বলদ সব আশা ঝেড়ে ফেলে তার শীর্ণ বুক ফুলিয়ে বলে, বলদ পীর, বাদার সব বলদের ভরসা।
বাঘ বিরক্ত হয়ে বলে, বনবিবিকে চিনি, বনের মালকিন। দক্ষিণ রায়কে চিনি, বাঘের বড়ভাই। বলদ পীর কে?
এক বলদ অন্য বলদের সঙ্গে গলাগলি করে সুর মিলিয়ে বলে, শুধু বাঘেরই বড়ভাই আছে, বলদের নাই? শোনো বাঘ, ইন দ্য নেইম অফ বলদ পীর, কার্সড বি দাই পিপল, ডেথ মোস্ট ফাউল বি আনফার্লড আপন দেম। বলদের মৃত্যু যেমন তোমার হাতে হচ্ছে, তোমার আর তোমার চোদ্দোগুষ্টির মৃত্যুও যেন কোনো বলদের হাতে হয়। বাঘ জাতির চিত্ত, বিত্ত আর পিত্ত যেন কোনো মহাবলদের ইশারায় ধূলিসাৎ হয়। চিত্তে ফাকিউ, বিত্তে ফাকিউ, পিত্তে ফাকিউ!
বাঘ আর সময় দেয় না। গোয়ালের অন্ধকার এক কোণে কাকের শরীর ঠেলে ঘুলঘুলির বাকিটুকি গলে রাতের আকাশ থেকে এক ফোঁটা আলোর দুধ ছলকে পড়ে তার আগুনে শরীরে, এক বলদের শ্বাসনালী পিষ্ট হয় তার চোয়ালে, অন্য বলদের ঘাড়ের হাড় চূর্ণ হয় তার হাতের থাপ্পড়ে। এক বলদকে মুখে করে বাঘ গোয়ালের দেয়ালের ফুটো আরেকটু বড় করে বাইরে বেরিয়ে পড়ে, অন্য বলদ গোয়ালেই পড়ে থাকে নিথর হয়ে। কাক কা কা কা করে নাড়িভুঁড়ির বখরা বুঝে নিতে বাঘের পেছন পেছন ছুটে নদী পেরিয়ে নির্ভয়ে বাদাবনে ঢুকে পড়ে নাছোড় জোটসঙ্গীর মতো।
বলদের শরীর তার চোপার তুলনায় সামান্যই, তার ওপর সে খায় খড় আর ভুষি। বনের হরিণের মতো সে পত্রভূক নয় বলে তার মাংসে শুধু কোলেস্টেরোলের ইশারা। বাঘ ভোর পর্যন্ত পেট ভরে খেলেও তার একটু বদহজম হয়, তারপর কয়েকটা দিন সে চুপচাপ ঝোপের আড়ালে শুয়ে গড়াগড়ি করে আর একটা কান খাড়া রেখে ঘুমায়। স্বপ্নে সেও ছুটতে থাকে গাবতলিতে, সেটা যেন তার নিজেরই তালুক, আর সেখানে শত সহস্র মীরকাদিমের হরিণ দোতলা তিনতলা সমান লাফ দিয়ে তিড়িং বিড়িং নাচতে থাকে তার সামনে।
হপ্তা খানেক এভাবে ঘুমানোর পর এক বিকেলে বাঘের ঘুমের চটকা ভেঙে যায় কাকের কলরবে। বাঘ ঘুম ভেঙে এক গড়ান দিয়ে দাঁড়িয়ে বাদা কাঁপিয়ে বুক খোলা ধমক দেয় কাককে, কা হুয়া?
কাক একটা গেওয়া গাছের ডালে বসে কাহুতাশ করে বলে, সর্বনাশ হয়ে গেছে বাঘ। পলাও পলাও। মালয়েশিয়া চলে যাও। পুবদিকে এক মাস দৌড় দিলেই ট্রলার ধরতে পারবা। ভাগো বাঘ ভাগো।
বাঘ বলে, কা মালয়েশিয়া যামু কা?
কাক কাঁদতে কাঁদতে বলে, পাকিস্তান আবারো ভেঙে গেছে রে বাঘা। পাপিষ্ঠ বাকশাল ইজ ব্যাক।
বাঘ বলে, তাতে আমার কী? কুমীর মরলে ধুন্দুলের কী?
কাক হাহাকার করতে না পেরে কাকাকার করে বলে, এইবার বন ও পরিবেশমন্ত্রীর গদি পেয়েছে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু! তোমার চিত্ত, বিত্ত, পিত্তের খবরই আছে এইবার!
বাঘের পেটে হজমের অপেক্ষায় থাকা এক টুকরো বলদ গুড়গুড়িয়ে বলে, ইত্তেফাকিউ!

মাঙ্গালি

$
0
0
দ্য মার্শিয়ানের বাংলাদেশি সংস্করণকে কী নামে ডাকা যেতে পারে, ভাবতে গিয়ে এই শব্দটাই মাথায় এলো।
আরো কয়েক দশক পরের কথা।
বাংলাদেশ আকাশযাত্রা ও শূন্য অধিবিভাগ, সংক্ষেপে বাসার অফিসটা বাসাবোতে। কয়েক দশক আগে প্রবল ভূমিকম্পে বাসাবো এলাকার তাবত বাড়িঘর ধ্বসে পড়ার পর নতুন করে আর তেমন কিছু গড়ে ওঠেনি, ধ্বংসস্তুপ সাফসুতরো করে সেখানে নানা রকম সরকারি প্রতিষ্ঠানের সুপরিসর কার্যালয় গড়ে উঠতে শুরু করেছে দুর্ঘটনার কয়েক বছর পর থেকেই। ধ্বংসস্তুপ সরানো হয়নি, এমন একটা বড়সড় প্লট ফাঁকা পড়ে থাকায় সেটার ইজারা চেয়ে নিখিল বিশ্ব ফেনী সমিতি সরকারের কাছে অনেক দেন দরবার করে আসছিলো। দুর্ভাগ্য তাদের, তৎকালীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের জ্যেষ্ঠ সচিবের বাড়ি নোয়াখালি জেলায়। তাই তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে অবিশ্বাস্য গতিতে নাসার আদলে বাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়, যাতে ঐ প্লট বরাদ্দ করার জন্য একটা সরকারি প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায়।
সেই থেকে বাসার যাত্রা শুরু।
সমালোচনা অবশ্য কম সহ্য করতে হয়নি বাসাকে। বোম্বের নায়কের নাম সালমান খান, তাই ঢাকাই নায়কের নাম সালমান শাহ হতে হয়, নইলে ছবি চলে না। বাসাকেও তাই নাসার আদলে এরকম খটমটে একটা নাম নিয়ে জন্মাতে হয়েছে বন্দে আলী মিয়ার মতো। টিটকিরিগুলো শুরুতে নামের ওপর দিয়েই গেছে। বাজেট মিটিঙে অর্থমন্ত্রী হাবুল মালদ্বীপ আবদেল মাহুত দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের ফাইল একপাশে ছুঁড়ে ফেলে বলতেন, ওনারা তো সারাদিন বাসাতেই পড়ে থাকেন। বাসার কর্মকর্তারা সিয়েঞ্জিওলাদের হাতেপায়ে ধরে কাকুতিমিনতি করতেন, চলেন না ভাই একটু বাসায় চলেন, একশো টাকা বাড়াইয়া দিমুনে। মন্ত্রকের যুগ্মসচিব বাসার আমীরকে ফোন করে মধুর কণ্ঠে শুধাতেন, বাসার খবর সব ভালো? টিভিতে টকমারানিরা বাসাকে ব্যঙ্গ করে ডাকতেন, শূন্য অধিবিভাগ। সংবাদ সম্মেলনে বাসার কর্তারা সাংবাদিকদের অনেক প্রশ্নের সাংবাদিকপসন্দ উত্তর দিতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন, খবরে ছাপা হতো, "প্রশ্ন শুনে আকাশকর্তারা আকাশ থেকে পড়েন।"
কিন্তু সব টীপ্পনী গা ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে বাসা কোনোমতে এগিয়ে চলেছে গুটিগুটি পায়ে। চীনের সাথে যৌথ উদ্যোগে রামপালে বাংলাদেশের নিজস্ব রকেট লঞ্চিং সাইট তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠার প্রথম দশকেই, কেন যেন প্রবীণ রাজনীতিক জামায়েদ সাকী কোনো আপত্তি করেন নি। পরের দুই দশক কয়েক বছর পরপর একটা দুটো করে টুকিটাকি উপগ্রহ উৎক্ষেপণের ভেতর দিয়েই কেটে গেছে।
মঙ্গলে মনুষ্যবাহী নভোযান পাঠানোর কাজ বাসা এই দশকেই শুরু করেছে। কয়েক মাস আগে রামপালে রকেটের ফিতা কেটে উৎক্ষেপণ উদ্বোধন করেছেন বাংলাদেশের খলিফা আস্তেক শাহ আবদালি।
গিয়ানজামটা শুরুও হয়েছে তখন থেকেই।
বাসাবোতে বাসার কার্যালয়ের সামনে আজ শামিয়ানা টাঙিয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। পবিত্র কুরআন থেকে তিলাওয়াত, তর্জমা, তাফসীর ও তাশাক্কুরের পর ভাবগম্ভীর মুখে বাসার আমীর জনাব আলি আসমান মুজাহিদ মাইকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। ঘনঘন ক্যামেরার শাটারের শব্দ আর ঝলকবাতির আলোতে চারদিক মুখরিত।
আমীর মহোদয় বিষণ্ন গম্ভীর মুখে কেশে গলা সাফ করে নিয়ে বললেন, "ভাইয়োঁ, আপনারা ওয়াকিবাহাল আছেন, মঙ্গলে আমাদের একটি আসমানি জাহাজ গত জিলকদ মাসে অবতরণ করেছে। দিলভরা দুখ নিয়ে আজ আমাকে আপলোগোঁকে সামনে হাজির হয়ে এই গুজারশ দিতে হচ্ছে, আচমকা আবহাওয়া খারাপ হয়ে যাওয়ায় আমাদের আসমানি জাহাজটিকে আবার মঙ্গল ছেড়ে উঠে পড়তে হয়েছে। আমাদের ছয়জন আসমানলস্করের মধ্যে পাঁচজন সহি সালামতে জাহাজে উঠে পড়তে পেরেছেন। কিন্তু ঝিনাইদহের শৈলকূপানিবাসী বিজ্ঞানী মোবারক ওয়াটনি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে জাহাজে উঠতে ব্যর্থ হয়েছেন। মোহতারামবৃন্দ, জনাব মোবারক ওয়াটনিকে মঙ্গলে ফেলে রেখেই আমাদের আসমানি জাহাজ বিএএস মওদুদী মিশন অসমাপ্ত রেখে পৃথিবীতে ফেরত আসছে।"
সাংবাদিকদের মধ্যে প্রবল গুঞ্জন উঠলো। কে কার আগে প্রশ্ন করবেন, তা নিয়ে উপস্থিত হাজারখানেক সাংবাদিকদের মধ্যে যথারীতি মৃদু মারপিট শেষ হওয়ার পর বিজয়ী কয়েকজন পালোয়ান প্রতিযোগীর-খুন-রাঙা মুষ্ঠিতে মাইক উঁচিয়ে প্রশ্ন গর্জাতে লাগলেন।
আমীর মহোদয় আঙুল দিয়ে এক সাংবাদিকের দিকে ইশারা করলেন। সাংবাদিক হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, "মোবারক ওয়াটনি কি বেঁচে আছেন?"
আমীর মহোদয় বিষণ্ন মুখে বললেন, "তা আমরা এখনো সঠিক জানি না। কিন্তু যেহেতু মঙ্গল গ্রহে পানি বা অক্সিজেন আহরণ করা অত্যন্ত কঠিন, এবং বাতাসের চাপ অত্যন্ত কম, তাই সে যদি বেঁচেও থাকে, তার আর বেশি হায়াত নাই। মঙ্গলে সে খাবে কী? হাগবে কোথায়? ওজু-গোছল করবে কীভাবে? সর্বোপরি, সানি লিওনির চলচ্চিত্রগুলিও সব ছিলো জাহাজের কম্পিউটারের হার্ডডিস্কে। নাহ, আমি তার বাঁচার কোনো আশাই দেখছি না।"
সাংবাদিকরা অনেকেই অনেক প্রশ্ন গুছিয়ে এনেছিলেন মনে মনে, আলি আসমান মুজাহিদের কথা শুনে সবার সওয়াল যেন ফুরিয়ে গেলো।
এক সাংবাদিক তবুও পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো, "মোবারক ওয়াটনিকে বাঁচানোর জন্য বাসা থেকে কোনো ব্যবস্থা কি নেওয়া হচ্ছে?"
মুজাহিদ বললেন, "না।"
সাংবাদিকরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। বেচারা মোবারক। বাসা থেকে এখন আর কী-ই বা ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে? আপাতত গায়েবানা জানাজাটা ঠিকমতো পড়াতে হবে। আর সাংবাদিকপসন্দ মেনু সাজিয়ে হোটেল মেরিডিয়ানে একটা কুলখানির আয়োজন করলেই সব কূল রক্ষা পাবে।
তবুও চাকরিতে নতুন ঢোকা এক সাংবাদিক চেঁচিয়ে উঠলো, "এ পরিস্থিতিতে বাসার আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া কী?"
আমীর মহোদয় এবার মৃদু হেসে বললেন, "আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে।"

পদ্মা সেতু ঘিরে একটি চিন্তা

$
0
0
পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ জোরেশোরে এগিয়ে চলছে। এমন পরিসরের নির্মাণ প্রকল্প বাংলাদেশে নিকট অতীতে দ্বিতীয়টি নেই। যমুনার ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু আর পাকিস্তান আমলে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে কর্মযজ্ঞকে ছাড়িয়ে গেছে পদ্মা সেতুর কাজ।
এমন প্রকল্প ভবিষ্যতে হয়তো আরো হবে। সে সব প্রকল্পে বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা যাতে আরো বেশি দক্ষতা ও জ্ঞান নিয়ে সম্পৃক্ত হতে পারেন, সে জন‌্য পদ্মা সেতুর নির্মাণযজ্ঞটি সম্পর্কে তাদের একটি স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন। স্বাভাবিকভাবেই এই প্রকল্পে যারা অংশ নিচ্ছেন, তারা অভিজ্ঞতার বিচারে প্রবীণ। কিন্তু এই প্রকল্প থেকে আহরিত জ্ঞান বাংলাদেশের নবীন প্রকৌশলীদের মাঝেও ছড়িয়ে দিতে হবে। নইলে হাতে গোণা কিছু লোকের কাছে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জ্ঞান, আরো ভালো কোনো শব্দের অভাবে, "বন্দী"হয়ে থাকবে।
এই নির্মাণযজ্ঞের ওপর একটি ধারাবাহিক অডিওভিজুয়াল ডকুমেন্টারি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে করা যেতে পারে। সেতু ব্যবস্থাপনা বিভাগের সরাসরি তত্ত্বাবধানে সেতু প্রকল্পের নানা খুঁটিনাটি কাজের ভিডিও বিবরণ সরকারের পক্ষ থেকে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল অনুষদে পাঠানো যেতে পারে। সরাসরি নির্মাণস্থলের অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প হয় না, কিন্তু পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে দেশের সব প্রকৌশল ছাত্রকে সরাসরি নির্মাণস্থলে এক্সকারশনের সুযোগ করে দেওয়া স্বাভাবিকভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে তাদের বঞ্চিত করাও ঠিক হবে না, যেহেতু ডকুমেন্টারির মাধ্যমে প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো তাদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব।
পদ্মা সেতু আমাদের আত্মশক্তি অনুধাবনের ক্ষেত্রে একটি দৃশ্যমান কাঠামো। কিন্তু এই আত্মশক্তি কেবল এই সেতুর ব্যয় যোগানোর সামর্থ্যের ক্ষেত্রেই খাটে। আমাদের কারিগরি যোগ্যতা ও দক্ষতা যদি আনুপাতিক হারে না বাড়ে, তাহলে অনাগত ভবিষ্যতেও চীন থেকেই আমাদের বড় বড় প্রকল্পের নির্মাণকৌশলীরা আসবে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে আহরিত জ্ঞানের মালিকানাও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাগরিকদের হওয়া উচিত, আর সেই জ্ঞান আমাদের ভাবীকালের প্রকৌশলীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটুকুও সরকারেরই পালন করা উচিত।
তথ্য মন্ত্রক ও সেতু বিভাগ যদি নিজেদের মাঝে সমন্বয় করে এ দায়িত্বটুকু বহন ও পালন করে, তাহলে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি টেলিভিশনের সুদক্ষ কর্মীরাই পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের ভিডিও ডকুমেন্টারিটি তৈরি করতে পারবেন। এটি আমাদের ভবিষ্যত দক্ষ জনসম্পদ তৈরিতে একটি সহায়ক দলিল হিসেবে যেমন কাজ করবে, তেমনি আমাদের প্রকৌশলবিদ্যার ছাত্রদের মনে আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মানের জায়গাটুকুর ভিত্তি আরো মজবুত করবে।
শিক্ষাকালে চিকিৎসককে যেমন ফিরে যেতে হয় মানুষের কঙ্কালের কাছে, তেমনি নির্মাণ প্রকল্পও কঙ্কালপর্বেই প্রকৌশল শিক্ষার্থীর জন্যে সবচেয়ে বেশি তথ্যবহ। পদ্মা সেতু কঙ্কালপর্বে থাকা অবস্থাতেই এই প্রামাণ্যচিত্র প্রকল্পটি শুরু হোক।

উসকানি দিবি না: কোপা শামসু

$
0
0
শোন রে লেখক-প্রকাশক, তোরা প্রকৃত বুদ্ধিজীবী না
বই লিখে কেউ শামসু ভাইরে কোনো উসকানি দিবি না
লেজ না নাড়িয়া যে কুকুর বলে "ঘেউ", তাহারেই মুগুরে
উসকানি খাতে ঠ্যাঙায়ে সটান করিবে শামসু হুগুরে
শামসুর কথা না মানিলে জাতি মেলায় তোদেরে পাবে না 
লুসকানি যদি হয় কিছু, হোক, উসকানি হওয়া যাবে না।

রামপালে বামপাল: ০১

$
0
0
২০১৬ সালের ১২ জুলাই বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) সাথে ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যাল লিমিটেডের (বিএইচইএল) একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় []। এ চুক্তির আওতায় বাগেরহাটের রামপালে ৬৬০ মেগাওয়াটের দুটি কয়লাচালিত ইউনিটের মাধ্যমে মোট ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে চলনতৈরি অবস্থায় বিআইএফপিসিএলের কাছে হস্তান্তর করবে বিএইচইএল।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের উত্তর সীমান্ত থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হওয়ায় দেশের অন্যতম বৃহৎ বনাঞ্চল এবং বহু বিপন্ন প্রজাতির একমাত্র আবাসভূমি সুন্দরবনের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন বিভিন্ন মহল। সুন্দরবন নিয়ে দেশের নাগরিকদের উদ্বেগকে তাচ্ছিল্য করার কিংবা ক্ষতির সম্ভাবনাকে অস্বীকার করার কোনো অভিপ্রায় আমার নেই। সুন্দরবনের ওপর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব বিশ্লেষণও এই লেখার আধেয় নয়। আমি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে একটি মহলের প্রচারণার পেছনে কয়েকটি ভুল ধারণা এবং/অথবা মিথ্যাকে ধরিয়ে দিতে চাই কেবল।
সুন্দরবন বাংলাদেশের অন্যতম সুরক্ষাপ্রাচীর। ঘূর্ণিঝড়প্রবণ বঙ্গোপসাগরে প্রতি বছর যে অমিত শক্তিশালী ঝড় ভূখণ্ডের দিকে ধেয়ে আসে, তার একটি বড় অংশ কাবু হয়ে পড়ে সুন্দরবনের কারণে। সুন্দরবনের ক্ষতি তাই কেবল এর একক জৈবমণ্ডলের জন্যেই নয়, বাংলাদেশের মানুষের জন্যেও এক বড় ও সরাসরি হুমকি। তাই সুন্দরবন প্রসঙ্গে কারোই শৈথিল্য প্রদর্শনের অবকাশ নেই। কোনো নাগরিক যদি সুন্দরবন নিয়ে উদ্বিগ্ন হন, সরকারকে সে উদ্বেগ প্রশমনের জন্যে ব্যবস্থা নিতে হবে। রামপাল নিয়ে সরকারের তরফ থেকে নাগরিক উদ্বেগ প্রশমনের জন্যে কোনো সমন্বিত পদক্ষেপ দেখা যায় নি। নীতিনির্ধারক পর্যায়ে কিছু মৌখিক আশ্বাস দেওয়া হয়েছে কেবল, যা প্রমাণ করে, সরকারের সংশ্লিষ্ট অংশ তার নিজের দায়িত্ব পালনে উদাসীন বা অপারগ।
কিন্তু এর বিপরীতে জনমনে উদ্বেগ ছড়ানোর জন্যে প্রচুর লেখালেখি চলছে। সেগুলোর বেশির ভাগই যৌক্তিক। কিন্তু একটি অংশ সুন্দরবনের আশু ধ্বংসের চিত্র এঁকে যাচ্ছে ক্রমাগত, যার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে সুন্দরবন ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে নাগরিকদের অজ্ঞতা বা অস্বচ্ছ ধারণা, সেইসাথে কিছু অসত্য আর অপ্রযোজ্য যুক্তি। সেগুলোর খানিক ব্যবচ্ছেদ করাই আমার প্রয়াস।
সুন্দরবন নিয়ে আমরা প্রতিটি মুহূর্তে সজাগ আর উদ্বিগ্ন থাকতে চাই, কিন্তু ভুল বা মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে নয়।

সচলায়তনে প্রকাশিত একটি পোস্টে জনৈক অতিথি লেখক সুন্দরবনের ওপর রামপালের কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে গবেষণালব্ধ সূত্রসহ আলোচনা করেছেন []। পাঠকের আলোচনায় প্রসঙ্গটির কয়েকটি দিক আমাদের সামনে প্রসারিত হয়েছে।
এর মাঝে একটি আগ্রহোদ্দীপক দিক হচ্ছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ভারতীয় কোম্পানির সংশ্লিষ্টতা থাকায় জনমনে বিরূপ ধারণা। ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের একটি বড় অংশ বৈরী মনোভাব পোষণ করে, যার পেছনে সঙ্গত ও অসঙ্গত কারণ রয়েছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্যে দরপত্রে অংশ নেয় দুটি কনসোর্শিয়াম ও একটি কোম্পানি [], যথাক্রমে:
(১) জাপানের মারুবেনী করপোরেশন ও ভারতের লারসেন এন্ড টুবরো লিমিটেড কনসোর্টিয়াম,
(২) চীনের হারবিন ইলেক্ট্রিক ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি লিমিটেড ও ইটিইআরএন এবং ফ্রান্সের আলসটম কনসোর্টিয়াম
(৩) ভারতের কোম্পানি ভারত হেভি ইলেক্ট্রিক্যালস লিমিটেড (বিএইচইএল)।
দরপত্রের বিচারে চীনের হারবিনগোষ্ঠী ভারতের বিএইচইএলের কাছে হেরে যায়। রামপালে চীনের উদ্যোগে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে একটি মহলের তরফ থেকে সুন্দরবন নিয়ে এখন যে অ্যাপোক্যালিপ্সু প্রচার চালানো হচ্ছে, সেটা দেখা যেতো না বলেও অনেকে মনে করেন। চীনের প্রতি তাত্ত্বিক ও আর্থিক কারণে দুর্বল এই গোষ্ঠীটি কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের সম্ভাব্য ক্ষতির ওপর ভারতবিদ্বেষের প্রলেপটি সুচারুভাবে মাখিয়ে জনসমক্ষে উপস্থাপন করায় বয়স ও লিঙ্গ নির্বিশেষে জনমানসে সুন্দরবনকে ইতিমধ্যে খরচের খাতায় ধরে নেওয়ার একটি প্রবণতা দৃশ্যমান হয়েছে।
সুন্দরবনের সাথে ভারতবিদ্বেষের সেতু হিসেবে একটি কথা এই গোষ্ঠীটি প্রবলভাবে প্রচার করছে। সেটি শুনতে অনেকটা এমন:
ভারতের আদালত (প্রচারান্তরে সুপ্রিম কোর্ট) তো সুন্দরবনে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র হতে দেয় নি। তাহলে ভারত কেন বাংলাদেশের সুন্দরবনে এই কেন্দ্র বানাচ্ছে?
খোঁজ-না-রাখা শ্রোতা/পাঠকের কাছে এ প্রশ্নটির সাথে প্রশ্নের আড়ালে উত্তর আকারে থাকা এক গোপন গভীর ষড়যন্ত্রও উন্মোচিত হয়। নিশ্চয়ই ভারত বাংলাদেশের সুন্দরবন ছারখার করার জন্য এই কাজ করেছে, যেভাবে তারা সানি লিওনকে দিয়ে আমাদের তরুণ সমাজের বাম হাতের পেশী ছারখার করে যাচ্ছে। কারণ দুশ্চরিত্র ভারত তো সারাক্ষণ এগুলোই করে, তাই না? যদিও "সুন্দরবন ধ্বংস করার এই হীন চক্রান্তে"শামিল হওয়ার জন্য কেন "জাপান", "চীন"ও "ফ্রান্স"ও দরপত্রে অংশ নিয়েছিলো, সে ব্যাপারে (বিশেষ করে চীনের ব্যাপারে) মহলটি চুপ থাকে।
"সুন্দরবনে"কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানোর ব্যাপারে ভারতের আদালতের নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারটি নিয়ে আরো খোঁজ করলে আমরা একটা সাধারণ, আটপৌরে গল্প জানতে পারবো। এই পোস্টের সেটিই উপজীব্য।
ইউনিভার্সাল ক্রিসেন্ট পাওয়ার প্রাইভেট লিমিটেড (ইউসিপিপিএল) নামে একটি বেসরকারি কোম্পানি, যেটি ইউনিভার্সাল সাকসেস এন্টারপ্রাইজ [] নামে একটি ব্যবসাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় হুগলি নদীব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হলদি নদীর মোহনায় অবস্থিত নয়াচর নামের একটি দ্বীপে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি একটি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্যে পরিবেশ ছাড়পত্র চেয়ে ভারত সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের কাছে ধর্ণা দেয়। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ক্রমান্বয়ে মোট ১০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্যে ইউসিপিপিএলের একটি বোঝাপড়া হয়, এটি তারই প্রথম ধাপ।
পরিবেশ ছাড়পত্রের প্রক্রিয়ায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড গণশুনানির আয়োজন করে ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রক বরাবর যাবতীয় তথ্য ও দলিল পাঠায়। সেখানে ২০১২ সালের ৫-৬ মার্চ বিশেষজ্ঞ কমিটি শুনানির তথ্য যাচাই বাছাই করে সিদ্ধান্তে আসেন, প্রস্তাবিত স্থানটি পরিবেশগত দিক থেকে সংবেদনশীল, তাই সরজমিন পরীক্ষা করে দেখতে হবে, নয়াচরে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা যাবে কি না। ২০১২ সালের ১০-১২ এপ্রিল তাঁরা নয়াচরে গিয়ে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন, যাতে বলা হয়, নয়াচর হুগলি নদীর মোহনায় গড়ে উঠেছে বলে এটি একাধারে মোহনার পরিবেশ ও হুগলি চ্যানেলের নাব্যতার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল। এখানে কোনো ধরনের নির্মাণকাজ করলে হুগলির মোহনার পরিবেশ ও নাব্যতা দুটিই ব্যাহত হবে। সেই সাথে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্গমন এই নয়াচরে গড়ে ওঠা ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদবলয়ের ক্ষতি করলে নয়াচরের গাঠনিক ভারসাম্য পরিবর্তিত হতে পারে (পোস্টলেখকের নোট: যা আবার ঘুরে ফিরে হুগলি চ্যানেলের নাব্যতাকে প্রভাবিত করবে)।
মোদ্দা কথা, নয়াচরে বিদ্যুৎকেন্দ্র করলে কলকাতা বন্দরে জাহাজ ঢুকতে সমস্যা হবে।
ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের বিশেষজ্ঞ কমিটির এই প্রতিবেদনে নয়াচরের সাথে সুন্দরবনের কোনো সম্পর্ক নেই। মাতলা নদীকে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের পশ্চিম সীমান্ত ধরলে সেখান থেকে নয়াচর প্রায় ৫০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। পাঠকের জন্যে গুগল ম্যাপে নয়াচর ও সুন্দরবনের অবস্থান পরিবেশন করা হলো।
নয়াচরের সাথে সুন্দরবনের সম্পর্কের একটি (প্রথম) সূত্র এখানে প্রাসঙ্গিক। সেটি হচ্ছে ম্যানগ্রোভ। ম্যানগ্রোভ বা গরানজাতীয় উদ্ভিদ ক্রান্তীয় সকল উপকূলেই দেখা যায়। নয়াচরে যেমন ম্যানগ্রোভ রয়েছে, তেমনই রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে, তেমনই রয়েছে মহেশখালীতে। সাতক্ষীরা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত যেসব ভূভাগ জোয়ারের পানিতে ডুবে যায় আর ভাটার পানিতে জেগে ওঠে, তার সবটুকুই ম্যানগ্রোভের দখলে। পাঠক, এই সূত্রটা একটু স্মরণে রাখুন।
এদিকে সরজমিন হন্তদন্ত তদন্ত শেষে ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের বিশেষজ্ঞ কমিটি প্রতিবেদনের সিদ্ধান্তে জানালেন, মোহনায় গড়ে ওঠা চরে কোনো ধরনের ভারি শিল্প স্থাপন চলবে না। নয়াচর যেমন ছিলো তেমন রেখে দিতে হবে। এটাকে ম্যানগ্রোভের বিস্তার সম্পর্কে জানার জন্যে এক প্রাকৃতিক গবেষণাগার হিসেবে দেখতে হবে। বড়জোর এখানে পরিবেশপর্যটন করা যেতে পারে, নয়তো নোনাপানির ঘের।
সেইসাথে তারা উল্লেখ করেন, এই প্রকল্পের প্রস্তাবে কোথাও বলা নেই যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি মোহনায় অবস্থিত এমন একটি চরে স্থাপন করা হবে। অর্থাৎ, ইউসিপিপিএল গোড়াতেই ব্যাপারটা চেপে রেখে কাগজপত্র জমা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞ কমিটি এই প্রতিবেদন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আমলাদের সামনে ইউসিপিপিএলের প্রতিনিধিদের কাছে উপস্থাপন করে বলেন, আপনারা এটা ভালোমতো পড়েশুনে আবার আমাদের কাছে আসবেন। ইউসিপিপিএলকে বিকল্প জায়গা খোঁজার পরামর্শও তারা দেন।
কিন্তু অচিরেই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার একটি পাল্টা কমিটি গঠন করে ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের বিশেষজ্ঞ কমিটির এই প্রতিবেদনকে নাকচ করে দেন। পাল্টাকমিটি বলে, সবকিছু ঠিকাছে। নয়াচর মোটেও সিআরজেড বা উপকূলীয় নিয়ন্ত্রণ এলাকা নয়। আলবাত বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানো চলবে।
পাঠক, এখানে আলগোছে বলে রাখি, উপকূলীয় নিয়ন্ত্রণ এলাকা হচ্ছে ভারতের পরিবেশ (সুরক্ষা) আইন, ১৯৮৬তে বর্ণিত এলাকা, যা মূলত জোয়ারের সময় ডুবে যায়, আবার ভাটার সময় জেগে ওঠে [ এবং ]। জোয়ারসীমা থেকে দূরত্ব হিসাব করে এই এলাকাকে আবার চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রথম ভাগ সিআরজেড ১ সবচেয়ে নাজুক।
প্রিয় পাঠক, আপনারা যারা আমলাতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ গুতাগুতির সাথে সামান্য হলেও পরিচিত, তারা জানেন, সরকারের এক অংশের কমিটির সাথে সরকারের অন্য অংশের কমিটির লড়াইকে সংক্ষেপে "লালফিতা পর্ন"বলা যেতে পারে। তার ওপর ভারতে এ ঘটনায় লড়াই আবার কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে রাজ্য সরকারের। তাই একটা পর্যায়ে এসে ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের বিশেষজ্ঞ কমিটি বললো, সবই তো বুঝলাম, এইবার তিনমাসের মধ্যে আটখান দলিল দাখিল করেন দেখি। এই আট দলিলে তারা সাত ধরনের বিশেষজ্ঞ প্রতিবেদন আর মামলার বৃত্তান্ত চেয়ে বসেন।
এরপর দিন গেলো, মাস গেলো, কিন্তু প্রকল্পের প্রস্তাবকদের আর খুঁজে পাওয়া গেলো না। তারা বিবেকের মতো, ঈশ্বরের মতো, তথ্যসূত্রের দাবির মুখে বামাতি বিপ্লবী ভাইদের মতো নির্বাক, মৌন মেরে রইলো।
ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রক তিন মাসের মধ্যে জিনিসপাতি না পেয়ে এই প্রকল্পের প্রস্তাব তাদের নথি থেকে ডি-লিস্ট করে দেয়। যদিও তারা ২০১৪ সালের ১০ জানুয়ারিতে একটা চিঠি আর ২১ অগাস্ট একটা তাড়া দিয়ে প্রকল্পের বাপমাদের তাগাদা দিয়েছিলেন, কিন্তু ঐ আট দলিলের ঘায়ে ঘায়েল ইউসিপিপিএল আর সাড়াশব্দ করে নি।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য উপকূলীয় এলাকা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (এসসিজেডএমএ) সেই ২০০৮ সালে ২৮ জানুয়ারি নয়াচরের কিসিম পাল্টে সিআরজেড-১ থেকে সিআরজেড-৩ করার প্রস্তাব করেছিলো, কিন্তু পরিবেশ ও বন মন্ত্রক সেখানেও দুটো খাটনি ধরিয়ে দেয়। বলা হয়, এসসিজেডএমএ তাহলে নতুন করে নয়াচরের জন্য উপকূলীয় এলাকা ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা করবে, আর নয়াচরে তীরসুরক্ষা কাঠামো নির্মাণ করতে গেলে তার জন্যে মন্ত্রকের অনুমোদন নিতে হবে।
এই হচ্ছে নয়াচর নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে ভারতের রাজ্য সরকারের (যারা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করাতে চেয়েছিলো) মধুর লালফিতা-পূর্বরাগ। এ একটা ফাইল দিয়ে মারে, তো ও আরেকটা ফাইল দিয়ে মারে।
এদিকে নয়াচরে যেসব জেলেরা মাছ ধরে খান, তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকেন নি। নয়াচরে তাদের লোনাপানির ঘের রয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়লে সেটা পয়মাল হবে। তাই তারা সোজা চলে গেছেন কলকাতা উচ্চ আদালতে, রিট ঠুকে দিয়েছেন।
পাঠক, ম্যানগ্রোভের পর নয়াচরের সাথে সুন্দরবনের দ্বিতীয় সম্পর্ক এই রিটে রয়েছে। রিটে এই জেলেরা বলেছিলেন, নয়াচরে বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়লে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। লক্ষ্য করুন, এটা রিটের ভাষ্য, আদালতের বক্তব্য নয়, বা কোনো বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদন নয়।
রিটের জের ধরে ভারতের জাতীয় পরিবেশ ট্রাইবুনাল নয়াচরের জেলে সমবায় সমিতির দাবি পূরণ করে রায় দেন এবং বলেন, যেহেতু নয়াচর নাজুক সিআরজেড ১ এলাকা হিসেবে শ্রেণিকৃত, কাজেই এখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ চলবে না।
ঘটনা এতটুকুই []।
চীনের হারবিনগোষ্ঠী যখন রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো, দেশে ময়দানে নামলো বামপাল গোষ্ঠী। তারা গলা ফাটিয়ে বলে যেতে লাগলো, এবং এখনো বলে যাচ্ছে, ভারতের আদালত সুন্দরবনে বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে দেয় নাই আর ভারত আমাগো সুন্দরবনে আইসা বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাইতেছে, সুন্দরবনটারে জ্বালাইয়া কালা বানাইবো, আমি দ্যাশের মালিক আমি এইসব চাই না, হ্যানোত্যানো। তাদের কল্যাণে বিদ্যুৎকেন্দ্রের গরু আদালতের গাছে উঠে যাচ্ছে প্রতিদিন। কেন সুন্দরবন জ্বালিয়ে কালো বানানোর জন্যে চীনা হারবিন দরপত্রে অংশ নিয়েছিলো, সে প্রশ্নটা আপাতত চাপা আছে।
ফ্যাক্ট হচ্ছে:
১. ভারতে কেউ "সুন্দরবনে"বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে চায় নি, করতে চেয়েছে নয়াচরে, যেটা সুন্দরবন থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে।
২. আমাদের দেশেও কেউ "সুন্দরবনে"বিদ্যুৎকেন্দ্র করছে না, করছে রামপালে, যেটা মংলা বন্দরেরও উত্তরে, সুন্দরবনের উত্তর সীমা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে (ক্ষয়ক্ষতি হবে কি হবে না, সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মত কাম্য)।
৩. নয়াচরে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল হয়েছে কলকাতা বন্দরের হুগলি চ্যানেলে নাব্যতা হারানোর আশঙ্কা থেকে, সুন্দরবনের ক্ষতির সম্ভাবনা থেকে নয়।
৪. সুন্দরবনের সাথে এই পরিবেশ ট্রাইবুনালের রায়ে নিষিদ্ধ নয়াচর বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটির সাথে কেবল দুটো সূত্র জড়িত, এক, "ম্যানগ্রোভ"শব্দটি, দুই, মামলার বাদী জেলেদের রিটে বর্ণিত আশঙ্কা (আমাদের দেশেও রিট ঘাঁটলে "তরুণ সমাজ ধ্বংস"হওয়ার কথা পাওয়া যায়)। আদালতের রায়ে বা বিশেষজ্ঞদের মতামতে নয়াচরের প্রকল্পের সাথে সুন্দরবনের কোনো সংযোগ নেই।
৫. নয়াচরের সাথে একই কষ্টিপাথরে রামপালকে যাচাই করলে দেখা যাবে, রামপাল কোনোভাবেই সিআরজেড ১ বা এমন নাজুক কোনো এলাকা নয়। রামপাল জোয়ারের সময় পানির নিচে তলায় না, ভাটার সময় জেগে ওঠে না।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে কি তাহলে সুন্দরবনে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হবে না? আমরা কি সুন্দরবন নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকবো না? পান থেকে চুন খসলেই কৈফিয়ত চাইবো না সরকারের কাছে?
নিশ্চয়ই আমরা উদ্বিগ্ন থাকবো, সরকারকে এই প্রসঙ্গে দৌড়ের ওপরে রাখবো, সুন্দরবনের ওপর রামপালের প্রভাব নিয়ে সরকারকে সম্ভাব্য সব রকমের বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে মত জানাতে চাপ দেবো, সেগুলো নিয়ে নিত্য কথা বলবো, চিৎকার করবো, প্রয়োজনে রাস্তায় নামবো।
কিন্তু ধান্ধাবাজদের ছড়ানো অসত্যের ওপর ভিত্তি করে নয়। সুন্দরবনকে বাঁচানোর জন্যে মিথ্যুক বামপালের ছাতার নিচে আমাদের মাথা ঢোকাতে হবে কেন?
তথ্যসূত্র:

[১] বিডিনিউজ২৪.ডম: রামপালে মূল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি
[২] সচলায়তন.কম: আসেন সুন্দরবনকে ধ্বংস করি
[৩] দৈনিক ইত্তেফাক: রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ভেল-এর সাথে চুক্তি মার্চে
[৪] www.usel.biz
[৫] ভারতের পরিবেশ (সুরক্ষা) আইন, ১৯৮৬
[৬] উপকূলীয় নিয়ন্ত্রণ এলাকা প্রজ্ঞাপন, ১৯৯১
[৭] নয়াচরে বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প নিয়ে ভারতের জাতীয় পরিবেশ ট্রাইবুনালের পূর্ণাঙ্গ রায়
Viewing all 119 articles
Browse latest View live


<script src="https://jsc.adskeeper.com/r/s/rssing.com.1596347.js" async> </script>